- ২১. হলের জীবন - সেন হল
আবার একটু এগিয়ে যাই, স্মৃতিচারণের পথ ধরে। হোস্টেল দশের পাঠ শেষ করে এলাম সেন হলে। আমরা আসার পরেই হোস্টেল দশ হয়ে গেলো ইউনিভার্সিটির অফিস। প্রথমে জানতাম না, পরে একদিন মুচিপাড়ার দিকে গিয়ে দেখি অনেক ঘরে এসি লেগেছে। মেসস্টাফদের বদলি করে দেওয়া হয়েছে হোস্টেল ১৩ বা অন্য হলে। সেই থেকে হোস্টেল দশ আর ছাত্রাবাস নয়। কিছুদিন আগে বিভিন্ন সময় দশের পুরোনো কিছু বাসিন্দা নিজেদের হোস্টেল দেখতে গিয়ে আবিস্কার করে দশের চারতলার কিছু ঘর শুধু স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে। তবে টয়লেট বা করিডোর দেখে কান্না পায়। টয়লেটের অবস্থা দেখে কে বলবে এটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেলের। মনে হবে কোনো পান্ডববর্জিত রেল স্টেশনের সার্বজনীন টয়লেট। বারান্দায় ঝাঁট পড়েনি বেশ কয়েক বৎসর। রুমগুলো ঝুলে ভর্তি আর তার মাঝে কিছু বিদ্যার্থী। দেখে মনে হবে যে কোনদিন "এখানে ভুতের ভয়" সিনেমার শুটিং করা যাবে। এটাও জানা গেলো যে শীতের রাতে বা প্রচন্ড ঝড়জলের মধ্যেও তাদের খেতে যেতে হয় পার্শ্ববর্তী কোনো হোস্টেলে।
যাইহোক এই পর্যায়ে একটু অতীতের দিকে হাঁটা দিয়ে যাওয়া যাক ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সেন হলে। সবার জন্যে বরাদ্দ ছোটো মাপের একটা করে ঘর। হলগুলো সব তিনতলা, পান্ডিয়া বাদে - যেটা অনেক আগেই একতলার বাড়ানো হয়েছে। সবথেকে চাহিদা বেশী দোতলার ঘরগুলির। নিচের তলায় জল জমার ভয়, মশা আর মাঝে মাঝে সাপের উৎপাত। আঁতকে ওঠার কিছু নেই, বি ই কলেজের সাপ খুব শান্তশিষ্ট আর বিভিন্ন ধরনের। তবে সে গল্প অন্য এক অধ্যায়ে হবে। এছাড়া তিনতলার ঘরগুলো নিলে বারবার সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলা উঠানামা করতে হবে। আর তার সাথে শীতের সময় একটু বেশী ঠান্ডা হাওয়া আর গরমকালে একটু বেশী গরম।
আমাদের ব্যাচের যারা আগের বছর মানে তৃতীয় বর্ষেই হলে চলে এসেছিলো, তারা পুরনো বাসিন্দা হবার সুবাদে দোতলার ঘরগুলো দখল করলো। ফাঁকা থাকতো কয়েকটা "খুশবু" রুম। বানভট্টদার কথা অনুসারে, ভাবছেন "খুশবু" রুম কি? কারণ ঘরগুলোর উল্টোদিকেই ছিলো "মোরারজী রেস্তরাঁ", মানে সার্বজনীন স্নানাগার ও শৌচাগার। সেগুলোতে সহসা কেউ না গেলেও, অনেক সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের একটা দল মিলে একটা উইংসের সবকটা ঘর দখল করে নেওয়া হতো।
অনেক সময় অন্য দুয়েকটা ঘরে একসাথে দুজন করে থেকে যেত। আর "খুশবু" রুমগুলো ব্যবহার হতো অদরকারী বা কম দরকারী জিনিসপত্র - যেমন বইখাতা বা শীতের জামাকাপড় মজুত করে রাখার জন্যে। কখনো কারু বাড়ী থেকে লোকজন বা বাইরের বন্ধুবান্ধব এলে শোবার কাজেও ব্যবহার হতো। আর একটা কাজে এইরুম গুলো ব্যবহার হতো - ভোলে বাবা বা মা কালীর প্রসাদ খাবার জন্যে। তখন ঘরের ভিতরের গন্ধ আর বাইরের গন্ধের মধ্যে একটা দারুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত, কে কাকে ছাপিয়ে যাবে তার। এছাড়াও কারু পোষ্টিকতন্ত্র উপরের বা নিচের দিকে বেয়াড়া রকম চাপ দিলে "খুশবু" রুম থেকে এক দৌড়ে চলে গেলেই হতো "মোরারজী রেস্তরাঁয়"। তারপর যে কোনো একটা গর্তওয়ালা সাদা পাত্র - হয় বেসিন বা প্যান - খুঁজে সদ্ব্যবহার করার অপেক্ষা।
আমরা যারা নতুন এলাম তারা দখল করলাম তিনতলার রুমগুলো। সব হলের তিনটে তলাতেই মোটামুটি চারটে করে উইং থাকতো, চারটে নামে। সেন হলের তিনতলার ম্যাক উইং-এ ইলেকট্রিকালের পাঁচজন - বিধান সরকার (৯৪), কল্লোল সরকার (৯৫), অরিন্দম বসু (৯৬), দেবব্রত বিশ্বাস (৯৭), সৌমিক বসু (৯৮); তারপর সিভিলের আমি (৯৯), মেটালার্জির দ্যুতিমান হাজরা (১০০) আর শেষ ঘরে সিভিলের সুব্রত পান্ডা (১০১)। হলে এসে শুরু হলো একা থাকা আর সেই সুবাদে সন্ধ্যে থেকে অনান্য ঘরে আড্ডা মারা বা তাস খেলা।
অনেকের সাথে আগে থেকেই পরিচয় থাকলেও, কয়েকজনের সাথে নতুন করে আলাপ হলো। অনেক স্বল্প পরিচিত হয়ে উঠলো ভালো বন্ধু। যেমন তিনতলার হোস্টেল চোদ্দর দিকের উইং-এ সিভিলের গৌতম (গাবি), প্রণব পন্ডিত আর কিছু মাইনিং ও মেটালার্জির জনগণ। তিনতলার হোস্টেল পনেরোর দিকের উইং-এ সিভিলের রাজীব ব্যানার্জী, পার্থ প্রতিম ব্যানার্জী, মলয় বিশ্বাস, দিবেন্দ্যু বাগ। তিনতলার সুপার উইংসে সিভিলের বরুন বিশ্বাস, প্রদ্যুত কুমার রায়, সুবর্ণ দত্ত, সুপ্রিয় বর্মন মাঝি ইত্যাদি।
এছাড়াও বিভিন্নতলার বাকি রুমগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে - ইন্দ্রনীল ভঞ্জ, সৌগত বসু, বিকাশ কুমার জওসয়াল, সুরজিত মিদ্দ্যা, জয়ন্ত ঘোষ, সুজিত কুমার ঘোষ, অরূপ দাস, রনজিত দে, অভিজিত দে, সৌগত মজুমদার, শীর্ষেন্দু সেনগুপ্ত, সোমনাথ মণ্ডল আরো অনেকে। প্রায় কুড়ি বছর কেটে গেলো, লিখতে গিয়ে অনেকের 'ভালো' নাম মনে আসছে না, অনেকের শুধু মুখ মনে পড়ছে। হয়তো পরে কখনো মনে হবে, "ইস, তোর নামটা কি করে ভুলে গেলাম"।
তবে অনেক পরের বছরের ছেলেও ছিলো, তাদের অনেকের সাথে বেশ ভালো দোস্তি হয়ে গেলো। ভাটা, শীর্ষেন্দু এরকম আরো কজন। আগেই বলেছি ইয়ারলি সিস্টেম হোস্টেলের জন্যে পরের বছরের ছেলেদের সাথে ঠিকমতো আলাপ না হলেও হলে এসে এদের কয়েকজনকে নতুন করে চিনলাম। সিভিলের শিলাদিত্যা, ধীমান, অংশুমান আর ছাত্রীদের মধ্যেও অনেকের সাথে আলাপ হলো সিভিলের তথা কলেজের ১৪০ বছর পূর্তির কাজকর্ম করতে গিয়ে। পূর্তির সময়ের ফুর্তির গল্প পরের এক অধ্যায়ে।
হলে এসে শুরু হলো ফাইনাল রাউন্ড। টানটান উত্তেজনা: চাকরি হবে কিনা? সব মিলিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাবো কিনা? তার সাথে একটা বিদায়ের সুরও আবহসঙ্গীতের মতো বেজে উঠতো। আর তো একটা বছর, তারপর বাবার পয়সায় খাওয়া আর কলেজের মস্তি শেষ করে ইঁট, কাঠ, কংক্রিটের এই শহরে একটা কোনো চাকরী। যাই হোক এসব ভেবে কলেজের শেষ একটা বছরে শোক করার কথাই নেই। তাই আমরা মেতে উঠলাম প্রাণভরে আরো একটা বছর উপভোগ করতে। কেউ কেউ ক্লাসে একটু নিয়মিত হাজির থাকার চেষ্টা করতাম। আবার কাউকে কাউকে তখনো কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না, একমাত্র ক্যান্টিন ছাড়া। তাদের মানুষ হবার পিছনে কলেজের অধ্যাপকদের থেকেও বেশী অবদান মনে হয় ক্যান্টিনের খুরশিদদার।
মনে আছে হলে আসার পর টিভি রুমে সুপারহিট মুকাবিলাতে বিভিন্ন গানের সাথে প্রবেশ পথের মুখে উদ্দাম নৃত্য। কিছু কিছু গান ছিলো যরা হাটকে। যেমন প্রভু দেবা, অরবিন্দ স্বামী ও কাজলের একটা তামিল রোমান্টিক সিনেমা ছিলো 'মিনসারা কানাভু', যেটা পরে হিন্দিতে 'সপনে' নামে মুক্তি পায়। এটার একটা ভারী সুন্দর গান ছিলো 'আওয়ারা ভোনরে যো হলে হলে গায়ে'। অথবা শাহরুখ খান আর জুহি চাওলার মিষ্টি প্রেমের সিনেমা 'ইয়েস বস'-এ অভিজিত আর অলকা ইয়াগনিকে গলায় 'ম্যায় কোই অ্যায়সা গীত গায়ু' কিংবা দিল তো পাগল হ্যায় থেকে 'আরে রে আরে ইয়ে কেয়া হুয়া'; বর্ডারের দেশাত্মবোধক গান 'অ্যায় যাতে হুয়ে লামহ' কিংবা গুপ্ত বা ইসক-এর গানগুলি।
আমরা মিঠুনের উত্থান দেখিনি। মিঠুন তখন মধ্যগগনে। সদ্য 'তাহাদের কথা'য় অভিনয়ের জন্যে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। তার ডিস্কো ডান্স তখন চেনা ম্যাজিক, জানা জিনিস। কিন্তূ আমরা হাঁ করে দেখেছি প্রভু দেবার ওইরকম শরীরটাকে ভেঙ্গেচুরে অসাধারণ নাচ। তখন জাতীয় পুরষ্কার ছাড়া আর দুয়েকটা পুরস্কার বিতরণী হতো, যেমন ফিল্মফেয়ার আর স্টারডাস্ট। তখনও অস্কার বা মিস ইন্ডিয়া বা মিস ওয়ার্ল্ড টিভিতে সরাসরি স্রম্প্রচার হতো না। যদিও ঐশ্বর্য্য রাই (১৯৯৪-র মিস ওয়ার্ল্ড) বা সুস্মিতা সেনের (১৯৯৪-র মিস ইউনিভার্স) দৌলতে এসবের একটু আধটু কাটাছেঁড়া অংশ প্রচারিত হতো। সেসব দেখেই আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতাম। আর তাছাড়া তখনতো আর ইন্টারনেট ছিলো না তাই আমরা সেই ঘোলেই বেশ সন্তুষ্ট হতাম।
………………………
এবারে আসি কিছু মজার ঘটনায়। কতকগুলো আমাদের সময়ের, কতকগুলো আগের বছরের সিনিয়ারদের কাছে শোনা। ম্যাকডোনাল্ডের একটা উইং-এর নাম ছিলো 'ধোপা উইং'। সেটা বলতে গেলে বলতে হবে একটা কোকিল কাহিনী, বানভট্টদার ভাটচরিত থেকে নেওয়া। রবিবার সকাল থেকেই ম্যাকডোনাল্ডের সেই উইং-এর নাম হয়ে যেত 'ধোপা উইং'। কারণ বানভট্টদার এক উইংমেট "ধোপু" সকাল হতে না হতেই গামছা পরে সমস্ত জামাকাপড় একটা বালতির সাবানজলে ডুবিয়ে দিত। তার পরণের গামছাটি ছিলো লিমিটতত্ত্বের এক গোলমেলে উদাহরণ। মানে লম্বায় তিনফুটের বড় নয় আবার চারফুটের ছোটো নয়। গামছাটিতে অস্বচ্ছতার পরিমান এমনই ছিলো যে তাতে লজ্জা নিবারণের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যেত। কিন্তূ "ধোপু"দার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। সে কাপড় ভিজতে দিয়ে সদর্পে উইং-এর একদিক থেকে অন্যদিকে পায়চারী করতো আর গাইতো - 'ও কোকিলা তোরে শুধাই রে'।
ঠিক এইরকম একটা সময়ের অপেক্ষায় কিছু কোকিল বসে থাকতো। এরা শার্ট প্যান্ট কাচাকে বিলাসিতা মনে করে সেসবের দিকেই যেত না। তারা তাদের বহুদিনের সাবান সম্পর্কহীন মোজা, গেঞ্জি এবং ডট ডট (অন্তর্বাস গুলো) চুপিসাড়ে ধোপুর বালতিতে গুঁজে দিত। ওইসব মোজা আর অন্তর্বাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে পড়লে প্রাকৃতিক জৈব অস্ত্র হিসেবে ভালোই চাহিদা হতো। যাইহোক এই 'ডট ডট' মানে অন্তর্বাস নিয়ে কয়েকটা জিনিস মনে পড়ে গেলো।
আমাদের এক জুনিয়র ছেলে ছিলো, সে একটা অন্তর্বাসকে বিশুদ্ধভাবে চারদিন ব্যবহারের একটা বিজ্ঞানসন্মত উপায় বার করেছিলো। যখন আমরা পরে সরস্বতী প্রজ্ঞানন্দ স্কুলের কাছে ভাড়া থাকতাম তখন সেই সহজ তত্বটা শুনেয়েছিল। নিউটনের আপেলের মতো, সহজ জিনিস, সবার মাথায় আসেনি। সে প্রথম দুদিন সামনে ও পিছনের দিক করে ঘুরিয়ে পরে, তিন ও চার নম্বর দিনে উল্টো করে আর একবার সামনে ও পিছনের দিক করে পড়ে অফিস চলে যেত। আর এক সিনিয়ার ছিলো হোস্টেল ১৫ তে। সে অনান্য জিনিসপত্রের সাথে একপিস 'ডটডট'ও কাচতে দিয়েছিলো ফার্স্ট গেটের সামনের ধোপাকে। ধোপা সব ফেরৎ দিলেও সেই 'ডটডট' ফেরৎ দিতে পারে নি। ধোপার কথায় সেটা কেচে ইস্ত্রি করতে গিয়ে নাকি মুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিলো!
যাইহোক ফিরে আসি "ধোপু"দার গল্পে। একটু পরে বাথরুমের আলোআঁধারী থেকে গান ভেসে আসতো - 'আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও'। সবাই বুঝতে পারতো ধোপুদা এবার কাপড় ধুতে শুরু করেছে। কাপড় ধুতে ধুতেই আবিষ্কার হতো কোকিলের ছানাপোনা - মোজা, গেঞ্জি ইত্যাদি। আর যায় কোথায়, শুরু হতো অত্যাধুনিক ত্রিমাত্রিক রামায়ন পাঠ। সেই রামায়নের ভাষা এতই নাকি মহাভারতীয় ছিলো যে সেটা এই দ্বিমাত্রিক মাধ্যমে লেখা সম্ভব নয়। তবে তার সাথে ছোটো ছোটো ইত্যাদিগুলো বারান্দায় নিক্ষিপ্ত হতো। কোকিলরা নির্লিপ্তমুখে সেগুলো তুলে এনে রোদে মেলে দিত আর মনে মনে বলতো 'একটু সহানুভুতি কি, মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু'।
আমাদের নিচের ফ্লোরেই থাকতো ইন্দ্রনীল ভঞ্জ, মোটামুটি এক রুটিন। পরে একসাথে কিছুদিন সরস্বতী প্রজ্ঞানন্দ স্কুলের সামনে ভাড়াও থেকেছি। মুড ভালো থাকলেই গুনগুন করতো, 'বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও, লা লা লা লা লা লা লা লা .....', মানে প্রথম লাইনের পর বাকিগুলো শুধুই 'লা'। ওই একটা লাইনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতো। হলে বেশ যত্ন করে সাবান তেল নিয়ে চান করতে ঢুকতো। প্রতিদিন চান করতে ঢুকলে একটু পরেই গান ভেসে আসতো - 'ঠান্ডে ঠান্ডে পানি মে নাহানা চাহিয়ে'। আমরা বুঝতে পারতাম এবার শাওয়ার খুলেছে। তৈরী থাকতাম, সবকটা শাওয়ার এক সাথে খুলে দিলে জলের বেগ অনেক কমে যেতো। ভঞ্জ হাঁক মারতো, 'ওই কে রে কে রে'? সেই ফাঁকে আর একদল দরজায় খুলে রাখা গামছা বা পাজামা নিয়ে কেটে পড়তাম। তবে ভঞ্জ ছিলো বাঁকুড়া জেলায় প্রথম হওয়া, একদম ভালো ছেলে। রেগে গেলে হাত বা মুখ চলতো না, শুধু একটা হুঙ্কার ছাড়তো, "ফোট ফোট ফোট ফোট ফোট"। কিছুদিন আমরা গবেষণা করেছিলাম ভঞ্জ রেগে গেলে কটা 'ফোট' বলে? তিনটে না চারটে? তবে পরে সবাই নিশ্চিত হয়েছিলাম, সংখ্যাটা পাঁচ ছিলো।
………………….
গান আর হলের কথা যখন এলোই তখন একটা ভুতের গল্পও হয়ে যাক। 'ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অমিতাভ' স্পেশাল। সাহেবদের আমলে বি ই কলেজে বেশ কিছু আইরিশ প্রফেসর ছিলেন। তাদের নামের শুরু ম্যাক দিয়ে, যেমন ম্যাকক্লাস্কি, ম্যাককর্মিক, ম্যাকডোনাল্ড ইত্যাদি। এদের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ড সাহেবের নামে একটা হোস্টেলও হয়। আর একজন ধরা যাক, ম্যাককর্মিক সাহেব বাংলা শিখে বাঙলা সংস্কৃতির প্রেমে পরে গিয়েছিলেন। তিনি আবার বাংলা গান শুনতেও বেশ ভালবাসতেন। কলেজে পড়াতে পড়াতেই তাঁর অকালমৃত্যু হয় এবং তিনি শিবপুর ক্যাম্পাসের মায়া কাটাতে না পেরে কলেজের একটা বট গাছে ডেরা করেন।
সেই বট গাছের নীচ দিয়ে কোনো ছাত্র গেলেই ম্যাককর্মিক সাহেবের ভূত সাঁ করে গাছ থেকে নেমে এসে তাকে কঠিন কঠিন ক্যালকুলাসের অংক জিজ্ঞেস করতেন। আর সে উত্তর দিতে না পারলে নিজের মাথাটা খুলে তার হাতে তুলে দিয়ে খিল খিল করে হাসতেন, যেন বিরাট একটা রসিকতা করছেন। ক্যাম্পাসের যে বাগানে ওই বটগাছ, সেই বাগান দিয়ে এক হল থেকে অন্য হলে যাবার একটা শর্টকাট রাস্তা। কিন্তূ সন্ধ্যের পর কেউ আর ম্যাককর্মিক সাহেবের ভূতের খপ্পরে পড়ার ভয়ে ওই বাগানের রাস্তায় পা মাড়াতো না।
অমিতাভদের হলে একটি ছেলে ছিলো বেশ ভালো গান গাইতো এবং গান শোনাবার জন্যে তাকে বেশী অনুরোধও করতে হতো না। যে কোনো অজুহাতে, যে কোনো আসরেই সে গাইবার জন্যে তৈরী। একদিন বন্ধুদের সাথে গান গাইতে গাইতে খেয়াল নেই বেশ দেরী হয়ে গেছে। এবার দেরী হলে নিজের হলে ফিরে খাবার পাবে না। তাড়াহুড়োতে সে নিজের হলে যাবার জন্যে বাগানের মধ্যে দিয়ে সেই শর্টকার্টটাই ধরলো। সাহেব ভুতের কথা তার মাথায় ছিলো না। গুনগুন করে নিজের মনে গাইতে গাইতে ছেলেটি বটগাছের তলায় আসতেই ম্যাককর্মিক সাহেবের ভূত গাছ থেকে নেমে পথ আটকে বললো, "বাঃ, তোমার গলাটি তো বেশ ভায়া। একটা ভালো গান শোনাও তো দেখি! বহুদিন ভালো বাংলা গান শুনিনি।"
সর্ব্বনাশ! ভুতের সামনে পড়ে ছেলেটির তো হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার যোগাড়। ভূতকে কি গান শোনানো যায়? তাও আবার সাহেবের ভুত! ভয়ে ভয়ে, কাঁপাকাঁপা গলায় ইনিয়ে বিনিয়ে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের স্টাইলে সে একটা গান ধরলো, "ও কি এলো, ও কি এলো না / বোঝা গেল কি বোঝা গেল না / ওকি মায়া কি স্বপন ছায়া / ওকি ছলনা?"
ভুতকে শোনাবার জন্যে এর থেকে উপযুক্ত গান আর কি হতে পারে? কিন্তূ দুলাইন গাইবার পরই ম্যাককর্মিক সাহেবের ভূত বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, "দূর, এ আবার কি গান! গানের কথার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। বোঝা গেল কি গেলনা! হুঁ, কেন রে বাপু? এতো জলের মতো পরিষ্কার। হয় এলো, নয় এলো না। এর মধ্যে আবার বোঝাবুঝির কি আছে?"
বলে সাহেব ভূত ভরসন্ধ্যায় গোমড়া মুখে সাঁ করে বটগাছের মগডালে উঠে বসে রইলেন।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.