Monday, July 1, 2013

- ২০. প্রেম ও না-প্রেম: ক।। স্বাতী, চিত্রা, অরুন্ধতী

 

এই পর্বে বি কলেজের প্রেক্ষাপটে শোনা, দেখা, ভাবা বা ঘটা কিছু প্রেম না-প্রেমের কাহিনী। যদিও কয়েকটা আগেই বলা হয়েছে

 

ক।। স্বাতী, চিত্রা, অরুন্ধতী

 

"আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে,

সারা রাত জেগে জেগে,

দেখেছি অনেক তারার ভিড়,

অরুন্ধতী, স্বাতী, সপ্তঋষির

খেলা, সব দেখেছি।

শুধু চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি

তোমায় দেখে ফেলেছি"

 

শুরু করলাম পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা সুরে মান্না দের গাওয়া একটা চিরনবীন গান দিয়ে আশাকরি অনেকেই নারায়ন সান্যালের 'সত্যকাম" পড়েছেন না পড়লে একটু সংক্ষেপে কাহিনীটি বলে নেওয়া যাক পুরো উপন্যাসটি ওনাঁর কোনো এক বন্ধু নবদ্বীপের স্বনামধন্য স্মার্ত পন্ডিত সত্যানন্দ তর্করত্নের নাতি, জন্মেই পিতৃমাতৃহীন কিন্তূ আজন্ম সততার অন্ধপূজারী সত্যপ্রিয় আচারিয়া বা প্রিয়দার জীবনের কাহিনী। দ্বিতীয় বর্ষে ফিল্ড সার্ভেতে ছেলেদের দল জরীপ করতে বেড়িয়ে গেলে, অধ্যাপক মহাশয় চুপিচুপি ডেটাম লেভেল মাপার খুঁটির মাথায় হাতুড়ির ঘা মেরে সাড়ে‌​ তিন ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সবাই নিজের ভুল হয়েছে ভেবে গোঁজামিল দিয়ে উত্তর মিলিয়ে দিলেও, সততার জন্যে প্রিয়দা সেই ভুল হিসেব জমা দিয়ে একমাত্র ছাত্র হিসেবে পাশ করেছিলেন। আবার সেই সততার মূল্য দিয়ে কেমিস্ট্রি ল্যাবের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ঘুষ না দেওয়ার খেসারত হিসেবে এক বছর ফেল করে নারায়নবাবুর সাথে পাশ করেন। তারপর প্রিয়দা একটা বেসরকারী ঠিকাদার কোম্পানির কাজে যোগদান করেন।

 

প্রথম কোম্পানি স্বাধীনতার ঠিক আগে তাকে জরীপ করতে পাঠায় মধ্যপ্রদেশের ভবানীগড় বলে এক করদ রাজ্যে। সেখানে পাকেচক্রে বিভিন্ন হাতবদল হওয়া এক নামী ডাক্তারের কন্যার বংশপরিচয়হীন সুন্দরী অনাঘ্রাতা আত্মজা রঞ্জনাকে তার পালিত পিতা প্রিয়দার ঘরে আটকে দিয়ে চলে গেলেও, সেইরাতে সত্য, শিব সুন্দরকে রক্ষা করেছিলেন নিজের পৌরষত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার আঁচ পেয়েও সাহসের অভাবে রঞ্জনাকে চরম সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে পারেননি। আবার অনতিবিলম্বেই নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যখন সেই কন্যাকে গ্রহণ করতে উদ্যোগী হন, তার ঠিক আগের রাতেই রঞ্জনা ভবানীগড়ের রাজপুত্রের লালসার শিকার

 

বংশগৌরবের কথা ভেবে দাদু প্রিয়দাকে পরিত্যাগ করছিলেন  প্রিয়দা রঞ্জনার গর্ভে জন্মানো সেই লালসার শিকারকে নিজের পুত্র হিসেবে মেনে নিলেও, ক্যান্সারে অকালে মারা যাবার আগেও তাকে মুখাগ্নির অধিকার দিয়ে যাননি।  সারাজীবন কখনো কর্তৃপক্ষ, কখনো সাপ্লায়ার বা কখনো ঠিকাদারদের অন্যায় আবদার মেনে না নিয়ে একের পর এক চাকরি পরিবর্তন করেছেন, এমনকি শেষদিকে অনুজ বন্ধু নারায়নবাবুর অধীনে পূর্তবিভাগেও চাকুরী নেন সারাজীবন অন্যায়ের সাথে আপস না করলেও, শেষদিনে বউ বা বলা ভালো আশ্রিতা তার ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এক কন্ট্রাকটরের অন্যায় দাবীর সাথে আপস করে যান।

 

যদিও কাহিনীতে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। নারায়ন সান্যাল বি কলেজ থেকে স্নাতক হন ১৯৪৮ সালে, এবং স্বভাবতই ওই বছর বা তার আগের এক দু বছরের মধ্যে সত্যপ্রিয় আচারিয়া বলে কেউ স্নাতক হননি। তাই ধরে নেওয়া যায় কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয় এবং প্রতিশ্রুতিমতো সচেতনভাবে আসল চরিত্রকে অন্তরালে রেখে দিয়েছিলেন নারায়নবাবু। এই ছলনাই স্বাভাবিক এই ধরনের কাহিনী বা সত্যঘটনা অবলম্বনে লেখায়। পুরো বইটায় আছে টানটান উত্তেজনা, কলেজের কিছু ঘটনা, ভালোলাগা, ভালবাসা প্রেম। সেই প্রেমও আবার বিভিন্ন রকমের, কোথাও আত্মিক, কোথাও নৈসর্গিক, কোথাও মানসিক, কোথাও শারীরিক বা কোথাও শুধুই কামলালসা।

 

কোথাও পড়েছিলাম ভালোলাগা আর ভালবাসার একটা সহজ সংজ্ঞা। ধরা যাক এক শরতের বৃষ্টিস্নাত সকাল, আপনি আপনার দোতলা বাড়ির ঝুলবারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়ছেন। সামনের বাগানে  টুকটাক খসে পড়ছে ভোরের শিউলি ফুল। সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল এক সুন্দরী রমণী। আপনার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো, "বাঃ, অপূর্ব" এটা হলো ভালোলাগা। কিন্তূ পরের দিন আপনি একটু তাড়াতাড়ি ঝুলবারান্দায় এসে বসলেন, কাগজ সরিয়ে রেখে বার বার হাতঘড়ি দেখছেন আর নজর চলে যাচ্ছে সামনের রাস্তার দিকে। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে নজর নেই। মন খুঁজছে কখন আসবে সেই সুন্দরী, কখন হবে এক পলকে একটু দেখা। এটা হলো ভালবাসা। যেটা এক তরফা হতেও পারে। এরকম একতরফা ভালবাসা হয়তো সবার জীবনেই আসে একসময়। সেক্ষেত্রে ভালবাসার পাত্র বা পাত্রী বয়সে বড় না ছোটো, বাস্তবে না কল্পজগতে, মানুষ কিংবা না-মানুষ বা কোনো দূর দিগন্তের নক্ষত্র। নারায়ন বাবুর কথায়:

 

"কী ছেলেমানুষ ছিলাম আমরা তখন। আজ ভাবলেও হাসি পায়। আমাদের দুজনের তখন ছিল তারা চেনার বাতিক। আমরা দু'জনেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বিবাহ করব না কেউ। স্ত্রী মানেই শাড়ি-গাড়ি-গহনা। এবং তার মানে জাল জুয়াচুরি ঘুষ। আমাদের পথ নয়। আমাদের ঠিকাদারী নাটকের নেপথ্যেও থাকবে না কোন স্ত্রী-চরিত্র। এখন স্বীকার করতে লজ্জা হয়, কিন্তূ সত্যদার গল্পের খাতিরেই শুধু নয়, সত্যের খাতিরেও স্বীকার করছি সে ছেলেমানুষী। আমরা দুটি বন্ধু মনে মনে ভালবেসেছিলাম দুটি নক্ষত্রকে। রোজ রাতে ওরাই হবে আমাদের সঙ্গী। কর্মক্লান্ত দিবসান্তে ওরাই হবে আমাদের নর্মসহচর। প্লেটনিক লাভের ধ্বজাধারী আমাদের কাছে সে রোমান্টিক যুগে এটা মোটেই অস্বাভাবিক অদ্ভুত মনে হয়নি। প্রিয়দার প্রিয়া ছিল ব্যুটশ নক্ষত্র-মন্ডলের একনম্বর ম্যাগনিচুডের তারকা - আর্কটরাস, যার বাঙলা মিষ্টি নাম হচ্ছে - স্বাতী। আমি মনে মনে মন দিয়েছিলাম কন্যারাশির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র স্পাইকাকে; - চিত্রাকে।"

 

সত্যি বলতে কলেজে আমাদের অনেকেরই মনে হতো বিয়ে করে ফালতু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। অনেকে সেই বয়সের নারীবিদ্বেষী মনোভাব থেকে, অনেকে হয়তো প্রেমে ধাক্কা খেয়ে, অনেকে প্রেমে না পড়তে পারার দুখেঃ, অনেকে প্লেটনিক বা আত্মিক প্রেমে বিশ্বাস করে। তাই ছেলেমানুষীর মতই হোক না কেন; আমাদের অনেকেরই জীবনে থাকতো একটা চিত্রা, অরুন্ধতী, অশ্বিনী, রোহিণী, বিশাখা, অনুরাধা, রেবতী বা স্বাতী - কখনো কল্পজগতে, কখনো স্বল্পবাস্তবে।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.