একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়
#### "এই কাহিনী একটি 'কাল্পনিক' ঘটনার অনুলিখন। এই ঘটনার সাথে বাস্তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তির কোনভাবে মিল থাকিলে, তাহা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং অনিচ্ছাকৃত। গল্পের সূত্রধরের সঙ্গে বাস্তবে লেখকের কোনো মিল নাই। গল্পের প্রয়োজনে কিছু সমসাময়িক বাস্তবানুগ ঘটনা, স্থান ও চরিত্রের অবতারণা করা হইয়াছে মাত্র।" ####
আমার কাজের সুবাদে ভারতবর্ষের ভিতরে এবং বাইরে অনেক কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুচার দিনের জন্যে ওয়ার্কশপ বা লেকচার দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে একটা দীর্ঘমেয়াদী বা নিয়মিত চুক্তিতে কিছুটা শিক্ষাদান করার চেষ্টা করেছি। যেমন কলকাতা ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিযার্সে পরপর দুবছর সেকশন বি-এর শীতকালীন ক্লাস; ফুন্টসলিং-এ রয়্যাল ভুটান পলিটেকনিকে (যা এখন রয়্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ভুটান) ওখানকার পূর্ত এবং টাউন প্ল্যানিং বিভাগের সঙ্গে পরপর তিনবছর দু সপ্তাহের ওয়ার্কশপ; রাঁচিতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কোল ম্যানেজমেন্টের ক্যাম্পাসে বার চারেক সপ্তাহব্যাপী ওয়ার্কশপ। এছাড়াও অন্যকিছু জায়গার সাথে দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম বি ই কলেজে একটা টেকউইপ (TEQIP) স্কীমের স্বল্পমেয়াদী ওয়ার্কশপ পরিচালনা করার, যেখানে অংশগ্রহন করেছিলেন আমার সিভিল ডিপার্টমেন্টের শ্রদ্ধেয় প্রফেসরগণ।
………………….
বি ই কলেজের আমার এক প্রাক্তন অধ্যাপক কিছুদিন আগে আমাকে যোগাযোগ করেন। উনি তখন এক প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আংশিক সময়ের জন্যে চুক্তিবদ্ধ। উনি আমাকে যোগাযোগ করেন সিভিল তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের নিউমারিকাল মেথডস ও কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন সংক্রান্ত একটি বিষয় পড়ানোর জন্যে। পড়াতে আমার ভালোই লাগে, তাও আবার সেটা যদি আমার মনোমত বিষয় হয়। তবে এই ভাবে একটা গোটা সেমিস্টার কোনো কলেজে গিয়ে পড়ানোর সুযোগ বা পরিস্থিতি হয়নি। প্রথমে প্রস্তাব ছিলো দুটো বিষয় পড়ানোর। আমি আমার তৎকালীন কর্মস্থলে এসে কথা বললাম। সবদিক বিবেচনা করে জানালাম কর্মস্থলে কোনোরকম অসুবিধে না করে শনিবার করে একটা বিষয় পড়াতে যাব।
অফিসের কাজে বাইরে গেলে, সপ্তাহের কাজের দিনগুলোর সুযোগ পুরোমাত্রায় নেবার জন্যে সাধারনতঃ আমার সফরগুলো রবিবারে শুরু হয় আর পরের শনিবারে শেষ হয়। তাই এটাও জানিয়ে রাখলাম যে অফিসের কাজের জন্যে বাইরে যেতে হলে সেই সপ্তাহে ক্লাস নিতে পারবো না। ভেবেছিলাম এইসব শর্ত শুনে কর্তৃপক্ষ পিছিয়ে যাবে। কিন্তূ দেখলাম আমার সব শর্তই ওনারা মেনে নিলেন। পরে দেখেছিলাম এইসব জায়গায় কোনো রকমে একজন অধ্যাপক বা শিক্ষক বা নিদেনপক্ষে একজন সহকারী দিয়ে কাজ চালাতে পারলেও কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হয়।
তাই একদিন গুটি গুটি পায়ে গিয়ে হাজির হলাম। জায়গাটি কলকাতার বেশ কিছুটা উত্তরে। হযবরল-র মতো তিব্বত যেতে না হলেও আমার যাত্রাটিও ছিলো বেশ অভিনব। আমার বাসা থেকে প্যাডেল করা তিনচাকার রিকশা করে যেতাম একটি মোড়ে। সেখান থেকে দুবার অটো বদল করে পৌঁছাতাম মেট্রো রেলের এক ভূগর্ভস্থ স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে গিয়ে উঠতাম এক প্রান্তিক স্টেশনে। তারপর লোকাল ট্রেনে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে আধঘন্টার যাত্রা, সবশেষে ভ্যানরিকশা চেপে সোজা সেই কলেজ। উজান ও ফিরতি পথে, দুবারই পাক্কা দু থেকে আড়াই ঘন্টার যাত্রা।
………………….
বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বেশ অমায়িক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বি ই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। প্রাথমিক কথাবার্তা বলে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন পরিচালন অধিকর্তার (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) কাছে। দেখলাম আমার আর্থিক চাহিদা এবং কদিন ও কখন আসতে পারব সেই নিয়ে অধিকর্তা চিন্তিত। আমি একই কথা সোজাসাপটা ভাবে বললাম, "পড়ানো আমার প্যাশন, আর তাছাড়া আমার প্রাক্তন অধ্যাপকের কথায় এখানে আসা। আমি যেহেতু চাকরি করি তাই মাসমাহিনা নেওয়াও বেআইনী। তবে বিনে পয়সায় বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রদানও অনুচিত, তাই যাওয়া আসার খরচ হিসেবে সান্মানিক একটাকা দক্ষিণা হিসেবে দিলেও আমার আপত্তি নেই।" তিনি আমার সাধুপ্রস্তাবে খুশী হয়ে বললেন যে ওনাদের নিয়ম মেনেই একটা দক্ষিণা দেওয়া হবে। আমি যেন পরের শনিবার থেকেই কাজে লেগে যাই।
দর কষাকষির কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। তাই নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে আমার কিছু আপত্তি না থাকলেও মনের মধ্যে অনেক আশা ছিলো। একটা বেশ গুরূগম্ভীর ইন্টারভিউ হবে, কিছু কাগজ পত্র জমা দিতে হবে। কয়েকদিন পরে সব দেখে শুনে একটা ফোন আসবে বা বাড়িতে একটা চিঠি আসবে। সেসব কিছুই নেই। আমতা আমতা করে জানতে চাইলাম কাছের রেলস্টেশন থেকে কলেজে আসার কোনো গাড়ি থাকবে কিনা। কোনো নিশ্চয়তা পেলাম না। শুধু মৌখিক ভাবে কাজে বহাল হয়ে গেলাম। মানে বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের মতো ঠিকে প্রফেসর। তাও ঠিকে ঝি হলে মালিকপক্ষ টাকা পয়সার কথাটা হয়তো স্পষ্টভাবে ঠিক করে দিত। যাই হোক যা হবে দেখা যাবে বলে চলে এলাম। আর টাকা রোজগার করতে তো যাইনি, তাই ঠিক করলাম মাঝপথে কেটে পড়বো না।
………………….
দুয়েকদিন পর একটা ফোন এলো, এক মহিলা আমায় মনে করিয়ে দিলেন আগামী পরশু মানে শনিবার থেকে আমার ক্লাস। ফোনেই জানালেন সম্ভাব্যসূচী এবং প্রস্তাবিত দক্ষিণা। গাড়ি চালাচ্ছিলাম, অংকটা শুনে আরেকটু হলে সামনের গাড়ির পিছনে ধাক্কা মারতাম। যদি আমার বাসা থেকে কলেজ ট্যাক্সি করে যাই তাহলে যা খরচ হবে প্রস্তাবিত দক্ষিণাটি তার থেকেও একটু কম। তবু আমি সেই ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো বললাম, একটাকা সান্মানিক হলেও যাব, কিন্তূ একটা প্রশংসাপত্র যেন থাকে। উনি ফোনে ভরসা দিলেও তারপর পুরো একটা সেমেস্টারেও ওনার কখনো দেখা পাইনি। অশরীরী নন, কারণ শুনেছিলাম এরকম একজন আছে আর কলেজের মধ্যে একটা নোটিশবোর্ডে ওনার নাম ও চলফোন নাম্বারটাও দেখতে পেয়েছিলাম।
আমার বাড়ির লোকজন, সহকর্মী বা বন্ধুবান্ধব নিরূৎসাহ করলেও; কথার খেলাপ করবো না বলে শনিবারের সাপ্তাহিক অভিযান শুরু করে দিলাম। কলেজটা বেশ সাজানো গোছানো হলেও কিছুটা যেতে হতো একটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে। ব্যাগ তৈরির কারখানা আর মুলিবাঁশের আড়তের পাশ দিয়ে। কুকুর, বিড়াল, ছাগল, মানুষ আর মুরগির ছানাদের পাশ কাটিয়ে। কিছুদিন পরে দেখলাম স্থানীয় রেলস্টেশন থেকে ভ্যানরিকশা ছাড়াও প্যাডেল করা রিকশা পাওয়া যায়, যদিও ভাড়ার বিস্তর ফারাক। কারণ জানতে চাওয়ায় এক প্যাডেল রিকশাওয়ালা বললো, "ভ্যানের ভাড়া কম হবে না কেন, ওরা তো জ্যান্তও বয় আবার মড়াও বয়। আমরা তো শুধু জ্যান্তই বই।" বুঝিয়ে বললো সামনের হাসপাতালে কোনো রুগী বা রাস্তায় কোনো কুকুর বেড়াল মারা পড়লে ভ্যানওয়ালারা সেগুলো শ্মশান বা ভাগাড়ে ফেলে ভ্যানটা ধুয়ে নিয়ে স্টেশনে চলে আসে, জ্যান্ত সত্তয়ারি নিয়ে যাবার জন্যে। জানিনা কতটা সত্যি বা মিথ্যা তবে তারপর থেকে ভ্যানে চাপলে একটা অন্যরকম অনুভুতি হতো।
………………….
প্রথম দিকে সিভিলের এক সহ-অধ্যাপক ছিলেন, যিনি নিজের পরিচয়ে বলেছিলেন যে, উনিই নাকি প্রায় সব বিষয় পড়ান এবং একাই বিভাগটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অল্পদিনের মধ্যেই জনান্তিকে আমাকে বলেছিলেন, 'সব ছাত্রছাত্রীরাই একদম ভুষিমাল, কিছুই জানেনা'। অনান্য অধ্যাপক বা অধ্যাপিকারা 'সব হয় ফাঁকিবাজ অথবা পড়াতে পারে না'। গোপন কথা না বলাই উচিত, কিন্তূ পরে দেখেছিলাম সেই তালিকায় আমার দুয়েকজন জনপ্রিয় অধ্যাপক আছেন আর কিছু ছেলেমেয়ে পড়ুয়া হিসেবে বেশ ভালো। উনি ছিলেন সর্বজ্ঞ, কিছু না বুঝলেও সবই জানেন। আমার বিষয়ের পাঠক্রমের মধ্যে একটি সফটওয়্যার ছিলো। আমি বারংবার বলেছিলাম সেটি যেন আমার উপস্থিতিতেই সরবরাহ করা হয়। পরের সপ্তাহে গিয়ে দেখলাম উনি নিজেই সব বুঝে নিয়েছেন, কারণ সেটা নাকি 'সামান্য ব্যাপার'। আর 'সামান্য ব্যাপার' বলেই আর মনে রাখতে পারেননি, ভুলে গেছেন কিভাবে লাইসেন্সগুলো চালু করতে হয়। এটা নিয়ে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। কর্তৃপক্ষেরও সেরকম 'গয়ংগচ্ছ' মনোভাব, শেষে ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে কিছু ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোনোরকমে সেই সফটওয়্যার চালু করেছিলাম।
সেই অধ্যাপক বলেছিলেন উনি সফটওয়্যারটা পুরোটাই জানেন আর যারা সরবরাহ করতে এসেছিলো তারা কিছুই জানেনা। অনেক সফটওয়্যার কোম্পানিতে একদম অনভিজ্ঞ লোকেদের পাঠিয়ে দেবার স্বভাব জানা ছিলো বলে সেটাই মেনে নিয়েছিলাম। দুদিন পরে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরুলো, উনি আমাকে বললেন একদম একটা ছোটো কাঠামো নিয়ে ওনাকে ধাপে ধাপে একটু দেখিয়ে দিতে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, "আপনি যে বলেছিলেন আপনি এ ব্যাপারে সব জানেন"। উনি বললেন, "আসলে সব জানতাম, কিন্তূ এই সব গরু ছাগলদের পড়াতে এসে চর্চা করা হয়নি তো, তাই ভুলে গেছি"। আমি মনে মনে মুচকি হাসলাম। কলেজ জীবনে হাসি পিছনে মোছার শিক্ষাটা কর্মজীবনে মাঝে মাঝেই কাজে লাগে। আর একবার লাগলো!
মনে মনে বিরক্ত হলেও উনি বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, তাই নিমরাজি হয়ে গেলাম। বললাম, "ঠিক আছে আজ একটু তাড়া আছে, পরের দিন দেখিয়ে দেবো"। পরের দিন একটু আগে এসে বললাম, "চলুন আপনাকে আধঘন্টা দেখিয়ে দি"। উনি নিরাসক্ত মুখে বললেন, "আসলে পরেরদিন আমার একটা ক্লাস আছে। সব ভুষিমাল, তবু নিজের একটু প্রস্তুতিতো করে নিতে হবে। আপনি বরং ক্লাস শেষ করে নিয়ে আমায় দেখিয়ে দেবেন। ওই অল্প একটু"। শেষ বিরক্তি তখনো বাকি ছিলো। ক্লাস শেষ করে এসে আবার ওনাকে বললাম দেখে নিতে। এবার উনি বললেন, "আমার আর দশ মিনিট লাগবে এই অধ্যায়টা পড়ে নিতে, তারপর আমি টিফিন করে নেব। আপনিও বরং টিফিন করে আসুন।" উনিই প্রথম দিন আমাকে ভয় দেখিয়ে ছিলেন এই বলে যে কলেজে কোনো খাবার দাবার পাওয়া যায় না। যদিও পরে দেখেছিলাম বেশ চালু একটা ক্যান্টিন আছে, তাছাড়াও চা-টা-য়ের দোকান আছে ভিতরে ও বাইরে। সেদিন টিফিন নিয়ে যাইনি, ক্যান্টিন একটু নাকে মুখে গুঁজে চলে এলাম। ভাবলাম ওনারও শেখার আগ্রহে টিফিন হয়ে গেছে। দেখলাম উনি সেই বইটা বন্ধ করে দুহাত উপড়ে তুলে একটা হাই তুলে বললেন, "আপনার হয়ে গেলো? আমার আর আধঘন্টা লাগবে টিফিন করতে। আর আমার তো বয়স হয়েছে, তাই খেয়েই একটু বিশ্রাম নিতে হয়। নাহলে মাথা কাজ করে না। ওই আধঘন্টা - পঁয়তাল্লিশ মিনিট একটু ঘুমিয়ে নি। তারপর আপনার সাথে গিয়ে বসবোখন"।. শিখবেন উনি, আর দায়টা আমার!
জানিনা সেদিন নিজেকে কিভাবে সামলেছিলাম। কোনোরকমে কাজের অজুহাতে কেটে পড়ার সময় মনে মনে ভাবলাম এনার অত্যাচারেই আমাকে জবাব দিতে হবে। যাইহোক পড়ুয়াদের সুবাদে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। পরের শুক্রবার বেশ রাতে সেই অধ্যাপকের ফোন, "কাল কলেজে আসবেন না। ছেলেরা ক্লাস বয়কট করবে ঠিক করেছে।" আমি বিভাগীয় প্রধান এবং কলেজের কিছু কর্মচারীকে ফোন করলাম। কেউ কিছু বলতে পারলো না, তাই ঠিক করলাম গিয়েই দেখি।
দেখলাম সত্যিই ক্লাস বয়কট হয়েছে, কয়েকজন ছাত্র এসে জানিয়ে গেলো, "স্যার আপনাকে কষ্ট করে আসতে হয়েছে, তাই আমরা দুঃখিত। কিন্তূ কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে প্রচুর পয়সা নিচ্ছে, অথচ অর্ধেক বিষয়ের অধ্যাপক নেই। কেউ কেউ পড়াতে পারেন না, অথচ একাধিক বিষয়ের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। কিছুই শিখতে পারছি না। কিছু বললেই কর্তৃপক্ষ ললিপপ দেখিয়ে বলছে, পড়া শেষে চাকরির ব্যবস্থা পাকা। শুধু যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার"। সেদিন জানলাম টিউশন ফী আর অনান্য খরচ মিলিয়ে কলেজ নেয় বছরে প্রায় একলক্ষ টাকার কাছাকাছি। তার উপর হোস্টেলের খরচ প্রায় মাসে চার পাঁচ হাজার। মনে পরে গেলো আমাদের সময় টিউশন ফী ছিলো বছরে আড়াইশো টাকা আর হোস্টেলে মাসে চার-পাঁচশ। তবে দেখতে দেখতে প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল আর তাছাড়া আমাদের ছিলো সরকারী কলেজ, তাই ফারাক তো থাকবেই। তা বলে এতটা! কিছুক্ষণ বসে রইলাম, এটা সেটা উল্টে দেখলাম, মোবাইলে গেমস খেললাম। তারপর কয়েকজন এসে বললো, "স্যার, ক্লাস হবেই না। কর্তৃপক্ষ ধমক চমক দিচ্ছে। আমরা গেট আটকাবো। আপনি বরং বেড়িয়ে পড়ুন"। আমিও মানে মানে কেটে পড়লাম। আসার পথেই শুনে এলাম এবং পরের সপ্তাহে নিশ্চিত হলাম - ছাত্রদের আপত্তিতে সেই সর্বজ্ঞ অধ্যাপককে কর্তৃপক্ষ ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
………………….
কলেজ যাওয়া আসার পথে টুকরো টাকরা জীবন চোখে পড়ত। অনেকদিন ট্রেন বাস ছেড়েছি। আবার সেই নতুন করে লোকাল ট্রেনের গাদাগাদি ভিড়। একটা অন্যরকম পরিবর্তন। আমি পাশের লোকের জামায় ঘামছি, পাশের লোকের মাথার ঘাম অন্য এক জনের গায়ে বা পায়ে পড়ছে। টিকিট চেকার এলে বা হকারের কাছে কিছু কিনতে ইচ্ছে হলে একটু ফাঁকা দিকে সরে গিয়ে মানিব্যাগটা বার করছি। নাহলে কে জানে নিজের পকেট ভেবে কার পকেটে হাত ঢুকিয়ে গণধোলাই খাবো।
কেউ বেচছে চা, কেউ ডালমুট, কেউ গরম দিলখুশ তো কেউ আবার ঠান্ডা কুলফী-আইসক্রিম। যাতায়াতের পথে বিকিকিনি হচ্ছে আঙ্গুর, লিচু, কাঁচা আম, পাকা মুসুম্বী বা কচি শসা। কাশি হলে আছে শুখনো আদা বা কবিরাজী লজেন্স, বদহজম হলে হজমীগুলি বা আমলকী। এর মাঝে কেউ বক্স বাজিয়ে ঠোঁট মিলিয়ে শুনিয়ে যাচ্ছে কয়েকটা বাংলা বা হিন্দী গান। কোনো কিছুরই অভাব নেই, সব কিছুর এক চলন্ত সহাবস্থান। একদিকে কিছু নিত্যযাত্রী তাস পেটাতে ব্যস্ত, কেউ কেউ মারছে রাজা উজীর। বিষয়েরও শেষ নেই, মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গল, রাজনীতি, নারীনিগ্রহ, দ্রবমূল্য বৃদ্ধি থেকে শুরু করে আজকের আবহাওয়া। মন দিয়ে শুনলে যে কেউ সর্বজ্ঞ হতে বাধ্য। এর মধ্যেই এগিয়ে আসতো দুয়েকটা হাত, কোনো অথর্ব বুড়িমা বা অন্ধ গায়ক বা কোনো স্বভাব ভিখারী।
একদিন ফেরার পথে দেখলাম এক অন্ধ, বোবা লোক নাকের সাহায্যে একটা বাঁশি বাজাচ্ছে। এর থেকে অনেক কম বাহাদুরী দেখিয়ে কতো লোকে কতো পয়সা উপার্জন করে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত মঞ্চে প্রদর্শনী করে। কিন্তূ ওই যে বলে এখন মার্কেটিংয়ের যুগ। সেটা না থাকলে অনেক প্রতিভা মাঠে গড়াগড়ি খায়। কত রকম হারিয়ে যাওয়া জিনিস পাওয়া যেত। বেনীমাধব শীলের পঞ্জিকা, ছবি নকল করার ম্যাজিক সল্যুশন, জমাট বাঁধা দই, হরিদাসের বুলবুলভাজা।
একদিন ফেরার পথে এক জংশন স্টেশনে দেখলাম বিশাল ভিড়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম একটা লোক কোনো মেল ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে প্লাটফর্মে হোঁচট খেয়ে লাইনে গিয়ে পড়েছে। মুণ্ডুটা দুটো লাইনের মাঝে আর দেহটা প্লাটফর্ম ঘেঁষে উবুড় হয়ে পড়ে আছে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। চলন্ত ট্রেন থেকে নামাটা লোকটার দোষ হলেও, দায়ী আসলে রেল কর্তৃপক্ষের বেখেয়ালে প্লাটফর্মের ধারগুলো এবড়ো খেবড়ো ভাবে কেটে রাখা। কিছু লোকের গাফিলতিতে একটা জীবন চলে গেলো। সাথে কেউ ছিলো না, তাই জানিনা বাড়ির লোক আদৌ কোনো খবর পেয়েছিল নাকি। না একটা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দেহটা চালান হয়ে গিয়েছিল। তবে অনেক উৎসাহী জনতা মোবাইলে দৃশ্যতা তুলে রাখতে খুব ব্যস্ত ছিলো।
………………….
আর একদিন কলেজ থেকে ফিরছি, এক কুখ্যাত রাস্তা দিয়ে। যেখানে দুপাশে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কুঠী, কোর্ট ও কাছারী; কিন্তূ মাঝে মাঝেই সেই এলাকা সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে কোনো জঘন্য নারী নিগ্রহ বা খুনের জন্যে। একটা বাজার বসে, কিন্তূ শনিবারের দুপুরেই প্রায় জনশূন্য। গা ছমছম করে। হঠাৎ নজর পড়লো একটা ল্যাম্পপোষ্টের লেখার দিকে, "এখান থেকে মা বোন চলাচল করে, কেহ প্রস্রাব করিবে না। - By Order D. M."। ইচ্ছে থাকলেও জানা হয় নি D.M. মানে জেলাশাসক সত্যিই এরকম কোনো নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা। তবে পড়ে বেশ মজা লেগেছিলো, ভাষার গুনে না লেখার ধরনে - তা জানিনা।
আর একবার এর কাছেই এক ভাতের হোটেলে হাজির হয়েছিলাম, ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্যে। বাংলায় লেখা মূল্য তালিকায় বেশ কিছু অদ্ভুত পদ ছিল, যেমন 'হাপ' ভাত বা 'বনলেস' চিকেন বা 'পরটা'। নিচে আবার ইতি গজর মতো লেখা "বিঃ দ্রঃ - পরটার সাথে ঘুগ্নী অথবা আলুর টরকারী দেওয়া হয়"।. আমি মাছ ভাতের অর্ডার দেওয়ায় ছেলেটি সবিনয়ে নিবেদন করে গেল যে শনিবার কোর্ট বন্ধ, তাই মাছটা আগের দিনের, তবে 'ভালো' মাছ। আসার পর দেখলাম সেটা এতবার 'ভালো' করে ভাজা মাছ, যে সেটাকে মাছ না বলে মাছের আমসত্ব বলা যেতে পারে।
স্টেশনের পাশে কয়েকটা গজিয়ে ওঠা গুমটি ছিলো। কেউ বেচত ফল, কেউ চপ, কেউ সিগারেট। এরমধ্যে একটা দোকানে ঠান্ডা বিয়ারও পাওয়া যেত। প্রথম দিন ছোটো বড় রঙিন বোতল আর গায়ের লেখা দেখেও বিশ্বাস হয়নি। এতো দিনদুপুরে সর্বসমক্ষে বেআইনী কারবার! এক গরমের দুপুরে ফেরার পথে জানতে চাওয়ায় দোকানী আশ্বস্ত করলো যে সত্যিই ঠান্ডা বিয়ার পাওয়া যায়। জানতে চাইলাম কিন্তূ লোকে খাবে কোথায়? দোকানী সুর করে ব্যঙ্গ করে উঠলো, "ঠান্ডা বিয়ার দেব, তারপর খাওয়ার জায়গা দেব? এরপর তো মশাই শোবার জায়গা খুজবেন"। কথাটার মানে বুঝে বা 'না বুঝে' আমি নিরস্ত হলাম।
………………….
এবার আসি কলেজ কর্তৃপক্ষের কথায়। প্রথম দিকে ফোনে কথা বলা সেই ভদ্রমহিলার দেখা পাইনি। এদিকে দুসপ্তাহের ক্লাস নেওয়া হয়ে গেছে। একটা কাগজ হাতে থাকা দরকার, তাই অফিসের দিকে গিয়ে নিজের তাগিদে বিস্তর ভুলে ভরা নিয়োগপত্রটা নিয়ে এলাম। আমাদের ফ্যাকাল্টি রুমে পিওন ছাড়াও একজন সহকারী ছিল। সেই মোটামুটি ক্লাসের জন্যে মার্কার পেন, ডাস্টার আর রোলকলের খাতার ব্যবস্থা করে দিত। এছাড়াও একজন আমি গেলেই এসে হাজির হতেন। মাঝে মাঝে কাকে বললে একটু চা বা জল পাওয়া যাবে সেসব বলে দিতেন। কিছু সময় এসে বলতেন আজকে আপনার পড়ানোটা একটু দ্রুত হয়েছে, ছেলেদের মাথায় ঢোকেনি। যদি একটু আস্তে পড়ান, তাহলে ভালো হয়। যদিও জানতে চাইলে ছেলেরা উল্টোটাই বলতো!
আমার বেশ ভালোই লাগতো, ভাবতাম আমার মতো এক নগন্য ঠিকে অধ্যাপকের জন্যেও কর্তৃপক্ষের কতো নজর। পরে বুঝলাম নজরটা আমার 'জন্যে' নয়, আমার 'উপরে'। কটায় ক্লাসে আসছি, কটায় যাচ্ছি সেটা গোপনে নজর রাখার জন্যে। আর আমাকে একটা চাপে রাখা যাতে ভুল করেও না ভেবে বসি আমি ভালো পড়াচ্ছি। সেই ভেবে যদি কিছু অতিরিক্ত পয়সাকড়ি চেয়ে বসি – তাই! এরমধ্যে নিজের পড়াশোনার কাজে আমাকে এক সপ্তাহে বাইরে যেতে হয়েছিলো। আমি আগে থেকেই বিভাগীয় প্রধান এবং ছাত্রছাত্রীদের সেটা জানিয়ে রেখেছিলাম। আমি অন্য শহরে একটা সেমিনার দিতে ব্যস্ত, হঠাৎ সেই ব্যক্তির ফোন। আমি আসিনি কেন সেই কারণ জানার জন্যে। আমি যখন বললাম যে সবাইকে বলা আছে, উনি দাবী করলেন সবাই জানলেও উনি জানেননা, তার মানে কর্তৃপক্ষও জানে না। পরবর্তী কালে আমি যেন এরকম কিছু হলে ওনাকে অবশ্যই জানিয়ে রাখি। অদ্ভুত লাগলেও আপত্তি করিনি। সব জায়গায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কিছু কাছের লোক বা চামচা থাকে। তাদের দাবীদাওয়াগুলো এরকমই হয়, কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন মদতে।
কিছুদিন পরে আমাকে একবার বিদেশ যেতে হয়। সেই শনিবার একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিল। কিন্তূ অনেক সময় যা হয়, দরকারে বা অদরকারে আটকে যেতে হয়। শেষমুহুর্তে কিছু আকস্মিক পরিবর্তন হয়ে ঠিক হয় আমি প্রায় সারারাত বিমানযাত্রা করে শনিবার ভোরে কলকাতায় নামবো। যাইহোক এরজন্যে অফিসের কাজের সঙ্গে আপস করি নি বা ক্লাস নেবার কথাটা মনে করিয়ে অনায্য সুবিধে নেওয়ার ইচ্ছেও মনে জাগে নি। প্রথমে ভেবেছিলাম সেই শনিবার ক্লাস নেব না। এদিকে পরীক্ষা প্রায় চলে এসেছে, তাই শেষমেশ বিভাগীয় প্রধানকে জানিয়ে দিলাম আমি একটু দেরী হলেও আসবো, হয়তো দমদম থেকে সোজাসুজি। সেই ব্যক্তিকেও জানিয়ে রাখলাম সব কিছু, কর্তৃপক্ষ বলে কথা!
অবশেষে সময়মতো ফিরে এলেও সারারাত না ঘুমিয়ে শরীর খুব কাহিল, সোজা বাসায় চলে গেলাম। কিন্তূ কিন্তূ করেও স্বভাববিরুদ্ধভাবে কথা দিয়ে হঠাৎ শরীর খারাপ অজুহাতে শেষ মুহুর্তে ডুব মারতেও ঠিক মন চাইলো না। দুটো সেকশন কে পরপর ক্লাস না নিয়ে, সময় সংক্ষেপ করার জন্যে বলে দিলাম একটু দেরী করে সবাই যেন ক্লাসে আসে। দুটো সেকশনের এক সাথে ক্লাস হবে। সেইমতো একটু দেরী করে গিয়ে, একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম। যাবার পথে প্রায় প্রত্যেক স্টেশনে সেই কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বা কর্তাব্যক্তির ফোন এসেছিলো, কোথায় আছেন, কতো দেরী হবে। চার-পাঁচ বার হবার পর শেষ দিকে এই অমানবিক ব্যবহারে খুব বিরক্ত হয়ে বললাম, "আর ফোন করবেন না। আমি ক্লাস শুরু করার আগে আপনাকে জানিয়ে দেব"।
সেদিনও ক্লাসে গিয়ে দেখি সেই কর্তাব্যক্তি ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ফিরতি পথে ওনার আর একটা ফোন পাই। জানতে চান "তাহলে কি আপনার দুটো ক্লাস হলো?" আমার সাধারনতঃ চারটি করে ক্লাস নেবার চুক্তি ছিলো। আমি বললাম "দুটো সেকশনের আড়াই ঘন্টা, মানে মোট পাঁচটা ক্লাস হলো।" উনি ফোন রেখে দিলেন, আমি তখন এর মানে বুঝিনি। বিভাগীয় প্রধানের সাথে আলোচনা করে বিষয়টিকে পাত্তা দিলাম না। কিন্তূ বুঝতে পারলাম পরের মাসের মাঝামাঝি গিয়ে।
ওখানে আবার একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিলো, মাসের মাঝামাঝি গিয়ে হিসাবরক্ষকের কাছে গিয়ে একটা কাঁচের ছোটো জানলার কাছে মুখ ও 'মাথা' নামিয়ে 'মজুরী' ভিক্ষা করে আনা। কয়েকটা টাকা বা একটা চেক হাতে ধরিয়ে দিত, একটা খামে পুরেও দিত না। মানে কাজের মাসিরা যেভাবে গৃহকর্ত্রীর কাছে মজুরী চায়। তবে কাজের মাসিরা পায় মাসের প্রথমে আমি পেতাম মাসের মাঝামাঝি। এর নাম নাকি "সান্মানিক দক্ষিনা" (honorarium)!
পরের মাসে দেখলাম হিসেব অনুসারে যা পাওয়ার কথা তার থেকেও কিছুটা কম। হিসেবরক্ষক চিনির বলদ, তাই তাকে কিছু না বলে এসে বললাম বিভাগীয় প্রধানকে। বললাম, "হয় হিসেব ভুল করেছে, তাহলে ভালো। কিন্তূ যদি রাত জেগে আসার পর দুটো ক্লাস এক সাথে নেওয়া সত্বেও যদি পুরো পয়সা হিসেব করে কেটে রাখে তাহলে আমি আর আসছি না। আশা করি ডিগ্রীধারী ইঞ্জিনিয়ার আর অশিক্ষিত মজুরের মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে। তাছাড়া অনেকদিন আমি অতিরিক্ত সময় ক্লাস নিলেও তার জন্যে কিছু দাবীও করিনি বা পাইওনি"।. সঙ্গে আমি সেই কর্তাব্যক্তির নজরদারীর কথাও বললাম। উনি বিষয়টি নিন্দা করে বললেন, "এইসব দালালদের সাথে কথা বলে লাভ নেই, তুমি বরং পরিচালন অধিকর্তাকে জানিয়ে রাখো, তারপর আমি কথা বলছি"।
যদিও বিভিন্ন কারণে সেই কথা আর হয়ে উঠেনি। অধিকর্তা ব্যস্ত অথবা হাসপাতালে ভর্তি এইভাবে দু-তিন সপ্তাহ কাটলো। এদিকে সেই কর্তাব্যক্তি যথারীতি নজরদারী চালিয়ে যাচ্ছেন আড়ালে আবডালে। আমি ধৈর্য্য হারিয়ে একটা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলাম ব্যক্তিগত অসুবিধের কথা জানিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সবার টনক নড়ে উঠলো। সেই কর্তাব্যক্তির ফোন। আমি প্রথমে না বললেও পরে যখন জানতে চাইলাম আগের মাসের হিসেবটা, উনি কবুল করলেন হিসেব করে টাকা কাটার কথা। আমি বললাম যে "আপনারা আমাদের মনে করেন ঠিকে ঝিদের মতো"। .উনি লজ্জিত হয়ে একটু ধানাই পানাই শুরু করলেন, পদ্ধতির দোষারোপ দিতে লাগলেন। আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। বললাম, "আপনি যে নজরদারী করছিলেন আমাকে না জানিয়ে সেটা একটা অপরাধ এটা মানেন তো? তারপর আপনারা যে হিসেব করে আমার দক্ষিনা বা মজুরী কেটেছেন সেটা জানাবারও কি প্রয়োজন মনে করেন না?" উনি এর একটা সাফাই দেবার চেষ্টা করায় বলেছিলাম, "যদি মেরুদন্ড থাকে তাহলে আপনার বাড়ির কাজের মাসি একদিন কামাই করলে তার মাইনে থেকে না বলে পাঁচ টাকা কেটে দেখুন তো! আমি যেটা ভদ্রভাবে করতে পারছি না, সেটা কাজের মাসি করে দেবে।" উনি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন "সেটা কি?" আমি বললাম, "আপনাকে ঝেড়ে কাপড় পড়িয়ে দেবে।"
………………….
অনেকক্ষণ আমার কাছে ঝাড় খেয়ে বললেন উনি দেখবেন ব্যাপারটা, আমি যেন সামনের শনিবার ক্লাস নিতে যাই। আমি জানালাম, "আপনাদের দেখার উপড় আমার ভরসা নেই। আপনারা সব দিকেই কামাচ্ছেন। আমাদের যে অনুপাতে আর যে আগ্রহ নিয়ে টাকা কাটেন, ক্লাস না হলে বা শিক্ষক জোগাড় না করতে পারলে সেই অনুপাতে কি ছাত্রদের টাকা ফেরৎ দেন? আপনি হয় আপনার নজরদারীর কথা আর সজ্ঞানে টাকা কাটার কথা স্বীকার করে আমাকে একটা লিখিত মুচলেকা দিন। নাহলে আমি আর যাচ্ছি না।" উনি জানতে চাইলেন তাহলে পরীক্ষার কি হবে? আমি বললাম, "কেনো আপনারা যখন টাকার মূল্যে সব দেখেন, তখন লোক যোগাড় করুন বা আমার মজুরীটা সামনের চায়ের দোকানের ছেলেটাকে দিয়ে দেবেন আর বলবেন পরীক্ষা নিয়ে নিতে। আর না পারলে আপনি নিজে নেবেন। আর সেটাও না পারলে বা আপনাদের মুরোদে না কুলালে আমাকে লিখিত মুচলেকা দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন। এবার যা ইচ্ছে আপনি ঠিক করুন।"
এরপর ফোন রেখে দিয়েছিলাম। মাত্র কুড়ি মিনিট পরেই ক্ষমা চেয়ে একটা মেসেজ এলো। তারপরেই আবার ফোন যে কোনো কিছু না কেটেই আমাকে পুরো দক্ষিনা দেওয়া হবে এবং আমার শেষ ক্লাসের দিনই আমার ওইদিন পর্যন্ত্য সব হিসেব করে মিটিয়ে দেওয়া হবে, প্রশংসাপত্রসহ। স্টেশনে গাড়ি না পাঠালেও আর পরিচালক আসেননি অজুহাতে প্রশংসাপত্রটি না দিলেও বাকিটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুনেছিলাম বিভাগীয় প্রধানের কাছেও ভালোই দাবড়ানি খেয়েছিলেন। তবে শেষদিন সেই কর্তাব্যক্তি ফোনে কথা বললেও একবারও দেখা করতে আসেননি। আমারও তেমন কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কর্মক্ষেত্রে কখনো পয়সা বা মাইনের জন্যে সাধাসাধি না করলেও আমার মনে হয়েছিলো এদের একটা ঝটকা দেওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে অন্যদের এইসব দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। আর তাছাড়া পুরো পদ্ধতিটাই শুরু থেকেই কেমন যেন দরকোঁচা মেরে গেছে মনে হয়েছিলো।
………………….
উপরের এই কর্তাব্যক্তির সাথে আর একটা ছোট্ট ঝামেলা হয়েছিলো, যখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে উনি আমার উপড় নজরদারী করতে আসেন। একদিন ক্লাসে বেশী ছেলে আসেনি, তাই বেশ কিছু এলে আমাকে খবর দিতে বলে আমি ফ্যাকাল্টি রুমে চলে গেলাম। যথারীতি ৫ মিনিটেই এসে হাজির হলেন সেই কর্তাব্যক্তি। প্রথমে মিষ্টি করে জানতে চাইলেন, "কি ক্লাস হচ্ছে না?" আমি কারণ বলে চলে গেলেন। দুমিনিট পরেই এসে বললেন ছেলেরা সব ক্লাসের বাইরে তাস খেলছে আমি যেন শীঘ্রই ক্লাসে যাই। আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, "বি ই কলেজে তো কিছু ছেলে ক্লাসের বাইরে গাঁজা খেত। আমি এখানের দারোয়ান নয়, তাই ক্লাসের বাইরে কি করছে দেখার দায়িত্ব আমার নয়।" সহশিক্ষকদের হাসতে দেখে লজ্জা পেয়ে চলে গেলেন। আমি একটু পরেই ক্লাসের দিকে পা বাড়াতেই দেখি উনি করিডোরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সোজা বলে দিয়েছিলাম "আপনি এখানে গোয়েন্দাগিরী করলে আমি ক্লাস না নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাব"।. তারপর থেকে সামনা সামনি না এলেও পিছনে বা কিছু ছাত্রর মাধ্যমে নজর রাখতেন।
আমাকে টানা চার ঘন্টা ক্লাস নিতে হতো বলে মাঝে মাঝে করিডোরে গিয়ে একটু পায়চারী করে আসতাম। একদিন দেখি এক রামগরুড়ের ছানা দুহাত মুঠো করে বেশ গম্ভীর চালে আসছে। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি ভাবলাম মনে হয় সি আই ডির লোক। পরিচয় পেয়ে বললেন, "এদিকে স্টুডেন্টদের টয়লেট, আপনি উল্টোদিকে ফ্যাকাল্টি টয়লেটটা ইউজ করবেন"।. আমি ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, "আপনার কি আমাকে দেখে ডায়াবেটিস রুগী মনে হচ্ছে?" উনি কথাটার মানে ধরতে না পেরে সেই ভঙ্গিতেই চলে গেলেন। পরে জেনেছিলাম উনি ছিলেন কলেজের সাফাইকর্মীদের মোড়ল। আরেক কর্তাব্যক্তি!
………………….
আমরা সুদীপ্ত সেন-দের বিচার করি ভাঁওতা দিয়ে টাকা নিয়ে, প্রতিশ্রুতিমত টাকা ফেরৎ দেয় না বলে। কিন্তূ এরা তো দু হাতে লুটছে। এখন নাকি জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা না দিলেও হয়। একটা নম্বর থাকলে আর যোগাযোগ রাখলে এমনিতেই এসব জায়গায় ভর্তি হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাওয়া যায়। সরকারিভাবে এরজন্যে নাকি কোনো গোপন সেলামী দিতে হয় না। কিন্তূ এরা টাকা নিয়ে প্রতিশ্রুতিমত শিক্ষা দেয় না এবং শেষে অনেক জায়গায় দেখি আন্দোলন হচ্ছে প্রতিশ্রুতিমত চাকরী না দিতে পারার জন্যে। কিন্তূ তার বেলা বেশী হৈচৈ নেই। আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত সেরা দুহাজার ছেলেমেয়ে, এখন অনেকের ক্রমতালিকায় আশিহাজার, নব্বই হাজারে আবার অনেকে কোনো তালিকায় না থেকেও সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। তাই ইদানীং একটা রসিকতা চালু হয়েছে বছর কুড়ি আগে একজন আগুন্তুক একটি পাড়ায় এসে মোড়ের দোকানে এসে যদি জানতে চাইতো ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাড়ী কোথায়? উত্তর পেতো ওই যে লাল রঙের বাড়িটা বা ওই রাস্তার ডানদিকে গিয়ে শেষ বাড়িটা। এখন সেই প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, যেকোনো বাড়িতেই কড়া নাড়ুন, দুয়েকটা পেয়ে যাবেন।
রবীন্দ্রনাথের কথায়, "ভালো জিনিস যত কম হবে ততোই ভালো। নাহলে নিজের চাপেই সে মাঝারী হয়ে যাবে।" হয়তো এটাই যুগের পরিবর্তন, সময়ের দাবী। আগে দেখতাম বাবা মা গর্ব করে বলতো যে ছেলে বা মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ছে। সেটা শুনে লোকে চমকিত হতো। এখন এতো সহজলভ্য কারিগরী শিক্ষা যে বাবা মা গর্ব করলেও কেউ খুব বেশী চমকিত হয় না। একদিন ট্রেনে আসতে আসতে শুনলাম এক ভদ্রলোক তার সহযাত্রীকে বলছেন, "বুঝলেন মশাই এই বাজারে আমার ছেলে সুযোগ পেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায় নি। অংকে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছে। মাস্টার ডিগ্রী করে স্কুল মাস্টারী করবে। কাদার তালের মতো বাচ্ছাগুলোকে গড়ে তুলবে নতুন মানুষ হিসেবে।" শুনে খুব ভালো লেগেছিলো, এটাই হয়ত ভবিষ্যৎ। শুধু বুকের একদিকে হয়তো একটু চিনচিন করে উঠেছিলো আমার অপূর্ণ থেকে যাওয়া ফিজিক্স অনার্স পড়ে শিক্ষকতা করার বাসনাটা।
………………….
শেষে আসি কিছু ছোটো খাটো চরিত্রের কথায়। এক সহকর্মিনী ছিলেন, যাদবপুরের ছাত্রী। একমাত্র সম্পূর্ণ সময়ের অধ্যাপিকা, মানে ঠিকে নয় স্থায়ী। ফাঁকা সময়ে মাঝে মাঝে আড্ডা জোড়া হতো। এছাড়াও ছিলো এক সহকারী, শেষ দিনে পরীক্ষা নেবার সময় ওর সাহায্য না পেলে মনে হয় বেশ ভালোই বেগ পেতাম। এছাড়াও দুয়েকজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আর পিওন। বাকি সব অধ্যাপকরাই আমার মতো ঠিকে। সব মিলিয়ে মাত্র চারজন শিক্ষক দিয়ে পুরো বিভাগটা চলতো। আর একটা মিল ছিলো, সবারই শুনতাম মাঝে মাঝেই এই সব দালালরা পয়সাকড়ি না বলেই কেটে নিত। আর মোটামুটি প্রায় সবাই সেমেস্টারের শেষের দিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন বা ছাড়তে পারলে বাঁচি অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এমনকি কিছু সহকারীরাও। আমরা সবাই ছিলাম শ্রমিকপক্ষ আর ওইসব দালালরা মালিকপক্ষ। আর ছাত্রছাত্রীরা হলো সোনার ডিম পারা হাঁস। সোনার ডিমগুলো আমরা সবাই ভাগ করে নিতাম। ডিমের স্বর্ণালী কুসুমটা পেত কর্তৃপক্ষ, সাদা রুপালী অংশটার ভাগ পেতো ওইসব কর্তাব্যক্তি বা চামচারা, আর আমরা পেতাম ডিমের বর্জ্য খোলাটা।
………………….
ছাত্রছাত্রীদের কথা না বললে অন্যায় হবে। কয়েকজন তো বেশ ভালো ছিল। আশা করি ভবিষ্যৎ জীবনে সফল ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনেককেই আমি প্রথমবার দেখি শেষদিনে। সেদিন পরীক্ষা ছিলো যে! আমি সাধারনতঃ হাজিরা নিতাম না। প্রথমতঃ সময় নষ্ট আর তার সাথে সিস্টেম আর হাজিরা খাতার বিস্তর গরমিল। মাঝে মাঝে দুয়েকদিন নিতাম। একদিন হঠাৎ হাজিরা নিয়েছি। ক্লাস শেষে ক্যান্টিন থেকে খাবার খেয়ে ফিরে আসছি। হঠাৎ একটি অচেনা ছেলে এসে বললো, "স্যার আজকের একটু অ্যাটেনডেন্সটা নিয়ে নেবেন? আপনি অ্যাটেনডেন্স নেবার সময় আমি একটু টয়লেট গিয়েছিলাম।" আমি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, "তোমাকে তো কখনো দেখিনি? ক্লাসে এসেছিলে?" চোখ নিচের দিকে নামিয়েই বললো, "হ্যাঁ স্যার। আপনি যখন ডিজাইন, ডিজাইন বলছিলেন আমি তো তখন আপনার সামনেই বসেছিলাম।"
অবর্থ্য যুক্তি, ডিজাইনের ক্লাসে কখনো তো ডিজাইন ডিজাইন বলবই। ঢপ মারার ক্ষমতা দেখে ভাবলাম এ বড় হয়ে নিশ্চয় কিছু করবে। কিছু না হোক রাজনীতিতে নাম করতে পারবে। তাই রোল নাম্বারটা টুকে নিলাম, সঙ্গে সঙ্গে আব্দার হলো, "স্যার আর একজন আমার সাথেই ছিলো। ওর রোল নাম্বারটাও একটু টুকে নেবেন?" দেখলাম নেতা না হয়ে যায় না। তখন হয়তো কোনো কাজে আসবে। তাই দুটো নাম্বারই হাজিরা খাতায় তুলে নিলাম!
আরোও দুজন তো পরীক্ষার দিনেও আসেনি। একজনের হয়ে তার কাগজপত্র নিয়ে কয়েকটি ছেলে এসে বললো, তার নাকি খুব জ্বর। যারা এসেছিলো তারা যেহেতু আমার পছন্দের তালিকায় ছিলো, তাই কথাটা বিশ্বাস করে তার খাতাটা জমা করে নিলাম। আর একজন হাজিরও হয়নি, খবর পাঠাবার প্রয়োজনও মনে করেনি। পরে বিভাগীয় প্রধান বললেন, "কি করবো? কলেজ বলবে পয়সা দিচ্ছে। পাশ তো করাতেই হবে। তুমি সবার নম্বর দিয়ে তোমার মতামত সহ পাঠিয়ে দাও। দেখি কি করা যায়।" সেইমতো ডাকযোগে কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়ে সব যোগ ছিন্ন করলাম। আমার কথাটি ফুরোলো। নটে গাছটি মুরোলো।
#### "এই কাহিনী একটি 'কাল্পনিক' ঘটনার অনুলিখন। এই ঘটনার সাথে বাস্তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তির কোনভাবে মিল থাকিলে, তাহা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং অনিচ্ছাকৃত। গল্পের সূত্রধরের সঙ্গে বাস্তবে লেখকের কোনো মিল নাই। গল্পের প্রয়োজনে কিছু সমসাময়িক বাস্তবানুগ ঘটনা, স্থান ও চরিত্রের অবতারণা করা হইয়াছে মাত্র।" ####
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.