- ১৮. দশচক্রে বাকি কজন
থার্ড ইয়ারে (১৯৯৫-৯৬) দশের সব ঘটনা আর সবার সম্বন্ধেই হয়তো কিছু না কিছু লেখা যেতে পারে। প্রথম বছর হোস্টেল ১৫ আর তৃতীয় বছর হোস্টেল ১০-এর প্রায় সবাইকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। যেটা দ্বিতীয় বর্ষে হোস্টেল ৯-এ আর চতুর্থ বর্ষে ৫ নং বা সেন হলে সম্ভব হয়নি। এদের যতজনের কথা মনে পড়ছে সেটা একে একে লেখার চেষ্টা করছি। শুধু এমন কিছু ঘটনা যেগুলো নামসহ উল্লেখ করলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশী অসুবিধে হতে পারে, সেগুলো থাকলো নাম না করে। তবে সব নাম পরিবর্তন করে দিলে কাহিনীর মজাটাই চলে যাবে। আর কয়েকজন খোলাখুলি বলে দিয়েছে তাদের নাম উল্লেখ করলে কোনো অসুবিধে নেই।
পাঁচতলায় একমাত্র ঘর ৫১২ তে থাকতো দুই বিখ্যাত চরিত্র, ইলেকট্রিকালের সুরজিত মিদ্যা আর মেটালার্জির সৌরভ দিন্দা। দুজনের সাথেই এখন যোগাযোগ নেই। দিন্দা ছিলো সেই ব্যক্তি যার অধিকারে উল্ফেন্ডেনে হোস্টেল ১৫-র সেই খুলিটা ছিলো। সে নাকি ম্যানেজমেন্ট করে এখন দিল্লিতে আছে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। একটা সাম্প্রতিক ছবি দেখলাম, তাতে আমাদের ব্যাচের দেবাঞ্জন সেনগুপ্তর একটা ফুটকাটা পড়ে দেখলাম, সত্যিইতো যখন কলেজে পড়তাম তখনও যতকটা চুল ছিলো মাথায়, এখনও প্রায় সেই কটাই আছে। মানে টাকের মাপ কুড়ি বছরেও একটুও বদল হয়নি! দিন্দার অনেক উদ্ভাবনী পরিকল্পনা থাকলেও, বাস্তবে সেগুলো মাঠেই মারা পড়ত। মানে কলেজের ভাষায় ছড়িয়ে ফেলতো। তাই সেসময় ও ছিলো ছড়ানোর একক। দিন্দার একবার ইচ্ছে হলো ট্যাংকে নেমে চান করবে, যা ভাবা তাই কাজ। এক দুপুরে তেল মেখে উলঙ্গ হয়ে নেমে পড়লো ট্যাংকের মধ্যে। সেই নিয়ে হোস্টেলে বিশাল ঝামেলা হলো। আমরা কেউ রাজি ছিলাম না, দিন্দার ওই এক মাসের স্নান না করা গায়ের ময়লা ধোয়া আর মুত্র বিসর্জন করা জলে চান করতে বা মুখ ধুতে। তাই কেয়ারটেকার কুলমনিদাকে বলে সব কল খুলে জল ফেলে আবার ট্যাংকে জল তোলা হলো।
তখনো এফ টিভি বা কেবল টিভি আসেনি। এক ইংরেজি সিনেমায় দেখে দিন্দার ইচ্ছে হলো ক্যাটওয়াক করবে। সেইমতো সব জামা কাপড় খুলে মশারী জড়িয়ে চারতলায় হলো সেই অভিনব ক্যাটওয়াক। এই প্রসঙ্গে আর একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। এখন অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্সের অধ্যাপক অমিতদার (মানে নকশালদা) কাছে শোনা। ওদের সময় হোস্টেল এগারোতে ঘ্যাওড়াদা বলে এক জনতা ছিলো, যার স্বভাব ছিলো গায়ে মাথায় তেল মেখে একেবারে উলঙ্গ হয়ে হাতে বালতি আর মগ নিয়ে বাথরুমে যাওয়া এবং চান করে রুমে এসে তোয়ালে দিয়ে গা মোছা। এইরকম একদিন ঘ্যাওড়াদা যখন চান করতে গেছে তখন ঘ্যাওড়াদার বাবা এসে হাজির ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। ঘ্যাওড়াদার রুমমেট ঘ্যাওড়াদাকে বাথরুমে এই খবর দিয়ে সেকেন্ড হাফে ক্লাস করতে চলে গেছে। ঘ্যাওড়াদা পড়েছে মহা বিপদে। সবাই প্রায় ক্লাসে, সাথে কিছু নেই, শুধু ওদের রুম পেরিয়ে একটা রুমের দরজা খোলা । যাই হোক একটু পরে ঘ্যাওড়াদা একটা ঢোলা ফতুয়া আর একটা টাইট প্যান্ট পরে রুমে এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে অন্য কারোরটা গলিয়ে এসেছে। ঘ্যাওড়াদাকে দেখেই অর বাবা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, "ছিঃ ছিঃ, জানিস তোদের হোস্টেলের ছেলেগুলো কি অসভ্য। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি একটা ছেলে পুরো ল্যাংটো হয়ে মাথায় বালতি দিয়ে দৌড়ে কোণার ঘরটায় গিয়ে ঢুকলো।" ঘ্যাওড়াদা মনে মনে হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো।
এসব ঘটনা এখন সম্ভব নয়, এখন মোবাইল আছে তাই হোস্টেলে আসার আগেই একটা ফোন চলে আসে। কিন্তূ তখন ভাবতেও অবাক লাগে কোনো মোবাইল ছাড়াই, বুথে গিয়ে ফোন করে আমরা জীবনের এতোগুলো বছর কাটিয়েছি, বাড়ির সাথে যোগাযোগ রেখেছি। খুব দরকার পড়লে বাড়ি থেকে নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টে বা পিকসার বাড়ির অথবা অফিসের নাম্বারে ফোন করতো। হঠাৎ করে কারো বাবা মা এলে রুম মেটদের দায়িত্ব পড়ত, রুমের বাইরে পাহারা দেওয়া আর আশেপাশের সবাইকে জানান দেওয়া অমুকের বাবা বা মা এসেছেন। আসলে সচরাচর আমরা দূর থেকে যেসব চার বা পাঁচ অক্ষর দিয়ে অন্যদের সম্বোধন করতে করতে আসতাম, সেগুলোর জন্যে। একবার হোস্টেলে আইডি হয়েছে। আইডির শেষে একটা করে আইসক্রীম আর একটা করে দামী সিগারেট দেওয়া হতো। যারা সিগারেট নিতো না তাদের জন্যে দুটো করে চকোলেট। একবার আইডির সময় একটা করে রথম্যানস সিগারেট দেওয়া হয়েছে। আমি আর সৌমিক ভাগাভাগি করে একটা শেষ করে ঠিক করেছি, পরেরদিন দুপুরের খাবার খেয়ে অন্যটার সদগতি করা হবে। বাবা তখন হাওড়া জেলার জেলা অবর্নিবন্ধক, বি ই কলেজের কোনো একটা জমি রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত ব্যাপারে এসেছেন। ছেলের খোঁজ নিতে হঠাৎ হোস্টেলে হাজির। মায়ের দেওয়া কিছু মিষ্টি লকারে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে যেন বাবার চোখেই পড়ার জন্যে সেই রথম্যানসটা সামনের দিকে গড়িয়ে এলো। কি করবো? খুব ভালো ছেলের মতো বললাম, "কাল আইডিতে দিয়েছে, তোমার জন্যেই রেখে দিয়েছিলাম, বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেব বলে"। বাবা বিশ্বাস করেছিলেন বলে মনে হয়না।
…………...
আজকের দিনে মনে হয়, বাবা সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী বা বিভাগীয় প্রধান মানে সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো, মাস গেলে বিশাল মাইনে, ঝাঁ চকচকে বাড়ি, শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়ী ইত্যাদি। সেটা কিন্তূ ঠিক নয়। একজন জেলা আধিকারিকের মাহিনা ছিলো ১৯৭৬ সালে ৫০০ টাকা (Rs 545/-), ১৯৯৭ সালে ৮,০০০ টাকা (Rs. 4700/-) আর এই ২০১৩ সালে সেটা প্রায় ৭৫,০০০ টাকা (Rs. 29,000/-)। একটা গাড়ী থাকতো সেটা হয় সাধারণ অ্যাম্বাসেডর বা জীপ। এখনকার নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু জিনিস তখনো বিলাসসামগ্রী হিসেবে ধরা হতো। যেমন বাড়িতে বা গাড়িতে এসি, টেলিফোন, ফ্রিজ এমনকি গ্যাসও। ফিরে আসি সুরজিত মিদ্যার কাহিনীতে। ওর বাবা ছিলেন বর্ধমান রাজ কলেজের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান। একটু বিরল পদবী হলেই আমাদের স্বভাব হলো তাকে ডাকার জন্যে নাম না ব্যবহার করে সেই পদবী ব্যবহার করা। তাই অবিভক্ত মেদিনীপুরের সুরজিত মিদ্যা আমাদের কাছে মিদ্যা। শুনেছিলাম ওর বাবাকেও ওনাঁর কলেজে বা বন্ধুমহলে মিদ্যা বলেই ডাকতেন। তখন অনেকের বাড়ি থেকেই কুশল জানতে পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটার আসতো। একটা পোস্টকার্ড এসেছিলো যেটার শুরু আর শেষ ছিলো এইরকম, "কল্যানীয় মিদ্যা, ............ ইতি অশির্বাদক তোমার বাবা মিদ্যা"।
একবার মিদ্যার বাবা হোস্টেলে এসেছেন মিদ্যা দাবী করলো অনেক বই কেনা হচ্ছেনা তাই বেশ কিছু টাকা লাগবে। কাকু কি কি বই জানতে চাওয়ায়, মিদ্যা যার যার রুম খোলা ছিলো সেখান থেকে মোটামোটা আর দামী কিছু বই নিয়ে গিয়ে হাজির করে। এর মধ্যে কিছু বই ছিলো যেগুলো হয়তো ইলেকট্রিকালের নয়, সিভিলের। যাইহোক বাবাকে বিদায় দিয়েই, সেই টাকা নিয়ে মিদ্যা আর একজনের সাথে ধর্মতলা থেকে বাস ধরে দীঘা ঘুরতে চলে যায়। সারারাত দীঘার সমুদ্রসৈকতে কাটিয়ে দেয় আর ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকাল হতে খেয়াল পড়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হবে। যেটা ইতিমধ্যে জনাকীর্ণ সৈকতে সম্ভব নয়। আবার শুধু এই কারণে হোটেল ভাড়া গোনারও মানে হয় না। দুজনে একটা হোটেলে ঢুকে রিসেপশনে মালপত্র রেখে বেশ গাম্ভীর্যের সাথে বলে আগের রাতে একদম বাজে হোটেল পেয়েছিলো, তাই এবার রুম দেখে তবেই হোটেলে থাকবে কিনা সেটা ঠিক করবে। হোটেল মালিক দুটো রুমের চাবি দিয়ে এক বেয়ারাকে পাঠিয়ে দেয় ওদের সঙ্গে, দুজনে দুইরুমে ঢুকে "দেখি টয়লেটটা কেমন" বলে শৌচকর্ম ও চান করে "ধুর মশাই দীঘার সব হোটেল বাজে" বলে ঘ্যামের সাথে বেড়িয়ে পড়ে।
আমি আর মিদ্যা ধর্মতলায় এলিট বা নিউ এম্পায়ারে বেশ কিছু সিনেমা দেখেছিলাম। সবগুলো দেখতে যেতাম পকেটে খানকুড়ি টাকা নিয়ে। যাওয়া আসার সিটিসির ভাড়া মায়া করে দিতাম, তাই খরচ বলতে ছিলো চারটাকা দিয়ে সিনেমার টিকিট আর কিছু খাওয়া দাওয়া। একটা রোল বা ধোসা তখন তিন থেকে পাঁচ টাকা। নিউ এম্পায়ারের পাশে একটা মুরগির খাঁচার মতো দু'তিন ভাঁজে লাইন দেবার একটা জায়গা ছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো টিকিটের কালোবাজারী বন্ধ, যদিও টিকিট দেওয়া শুরু হলেও ব্ল্যাকাররা অদ্ভুত দক্ষতায় লাইন আমাদের মাথার উপড় দিয়ে পৌঁছে যেত একদম কাউন্টারের সামনে। আর উপরের অংশে আমাদের মতো লুচ্চাদের জন্যে ছিলো একজন স্টান্টম্যান চেহারার গার্ড। একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে হেঁটে যেতে যেতে ঠিক ধরে ফেলতো কে পিছন থেকে শিস দিচ্ছে বা নিচে পয়সা ছুঁড়ছে।
মনে হয় ফিফথ সেমেস্টারের মিড টার্ম শেষ হবার পর দেখতে গিয়েছিলাম স্পীড বা উল্ফ। ব্ল্যাকারদের মধ্যে মারামারি শুরু হলো, সোডার বোতল ভেঙ্গে, আধলা ইঁট নিয়ে। তার ফাঁকেই সুযোগ পেয়ে আমি আর মিদ্যা দুঃসাহসী হয়ে একটা করে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল হাতসাফাই করে দিলাম। দাঁত দিয়ে ছিপি খুলে সেটা শেষ করে সুড়ুৎ করে চালান দিয়ে দিলাম আমাদের দিক থেকে মারামারি করা ব্ল্যাকারদের দিকে। এখন মনে পড়লে ভাবি, যদি আমাদের হাতসাফাই দেখে একটা ভাঙ্গা বোতল কেউ ছুঁড়ে দিতো বা মাথায় একটা ভাঙ্গা বোতল দিয়ে আঘাত করতো, তাহলে আর এই ঘটনা মনেও পড়ত না, আর লেখাও হতো না।
যাইহোক সিনেমা শুরু হতে দেরী হলো আর শেষ হতেও। হল থেকে বেড়িয়ে দেখি শেষ সিটিসি চলে গেছে। হাতে পয়সাও নেই আর ধর্মতলা থেকে বি গার্ডেন ভায়া হাওড়া ব্রিজ মিনিবাসের কন্ডাক্টর আমাদের এতো হাড়ে হাড়ে চেনে যে ভাড়া না নিয়ে ছাড়বে না। এদিকে খিদে পেয়েছে, তাই পকেটে যা পড়ে আছে সেই দিয়ে ঠিক করলাম আগে রাতের খাবার খেয়ে নেবো। ধর্মতলায় এখন যেখান থেকে সারাদিন দুর্গাপুর-আসানসোলের দক্ষিনবঙ্গ রাজ্য পরিবহণের বাস ছাড়ে সেখানে আগে শুধু কয়েকটা উত্তরবঙ্গ যাবার রকেট বাস ছাড়তো রাতের দিকে। এখন যেটা টিকিট কাউন্টার ওখানে একটা সরকারী অনুদানে চলা রেস্তোরাঁ ছিলো। অতি সস্তায় অতি জঘন্য খাবার পাওয়া যেত। খেতে বসে একটা ইঁদুর দেখেছিলাম, প্রায় একটা বাচ্চা ছেলের মাপের। জীবনে এতো বড় ইঁদুর স্বচক্ষে আর দেখিনি। যাইহোক ইঁদুর, ছুঁচো আর আরশোলাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের খাবার খেলাম। চাল না বলে বলা চলে খুদের ভাত আর তার সাথে টলটলে একটা হলুদ তরল যার নিচে দুয়েকটা ডালের দানাও ছিলো। একটা মাছ যেটা মনে হয় বার দশেক ঝোলে চোবানো আর পোড়া তেলে ভাজা হয়েছে। কদিন ধরে ভগবানই জানে, তবে দাঁত দিয়ে টেনে ছেঁড়ার পর একটু মাছের স্বাদও পেয়েছিলাম। এবার ঠিক করলাম লঞ্চ করে গঙ্গা পার হবো। আউটরাম ঘাটে এসে দেখি শেষ লঞ্চ চলে গেছে। যদি পরেরটা থেকে পাই এই আশায় এগিয়ে গেলাম একে একে বাবুঘাট, ফেয়ারলি, আর্মেনিয়ান। কিন্তূ অভাগা যদ্যপি যায়, শেষ লঞ্চ চলিয়া যায়। রাত প্রায় একটায় রবীন্দ্র সেতু মানে হাওড়া ব্রীজ পায়ে হেঁটে পাড় হলাম। এরপর পুরোটা পায়ে হেঁটে, প্রায় আড়াইটের সময় কনকনে শীতের রাতে হোস্টেলে ঢুকলাম। সবাই বাড়ি চলে গেছে, গোটা মুচিপাড়ায় শুধু আমি আর মিদ্যা। ভুতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে প্রায় ভোরের দিকে দুজনেই সেই রাতে ৫১২-তে শুয়েছিলাম।
শেষ করি মিদ্যার যেটুকু খবর জানি তা দিয়ে। মিদ্যা পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো, কিন্তূ বি ই কলেজে এসে সবার যা হয়, তাই হলো। প্রায় অর্ধেক বিষয়েই সাপলি পেতো, এক দুবারের চেষ্টায় সেটায় উতরানোর আগেই আরো কিছু সাপলি। কোনো সেমেস্টারে দেখা যেতো ছটার জায়গায় হয়তো বারোটা বিষয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। তবু ভালো, একজন'তো অনেকে বছর নষ্ট করার আগে একবার মোট আঠারোটি বিষয়েই পরীক্ষা দিয়েছিলো। যাইহোক এসব সামলে মিদ্যা আমাদের সঙ্গে পাশ করে চাকরি খুঁজতে দিল্লী চলে যায় আর একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কিছুদিন কাজ করে। তারপর সব ছেড়ে দিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য গেট পরীক্ষা দেয়। দারুন ফল করে, মনে হয় জাতীয়ক্রম হয়ছিলো ছয় কি আট। ঢুকে পড়ে আই আই এস সি ব্যাঙ্গালোরে। একটাই প্রতিজ্ঞা যেন কোনো সাপলি না জোটে। শোনা যায় সব বিষয়ে এক সুযোগেই পাশ করে গেলেও খুব ভালো নম্বর পায়নি। সকলের হাসির পাত্রও হয় দুবার চেষ্টা করেও জিআরইতে সুযোগ না পাওয়ায়। তারপর বিনা সুপারিশে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করে শেষে সুযোগ পায় এক সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিনা স্কলারশিপে এক বছর প্রতিকুল অবস্থায় সঙ্গে কঠিন লড়াই করে মন জয় করে উপদেষ্টার মন জয় করে এবং ডক্টরেট শেষ করে যোগ দেয় সুইডিশ রেলওয়েতে। ওখানে নাকি মিদ্যার একটা কাজও দারুনভাবে প্রসংশিত হয়।
…………...
চারতলায় থাকতো বিমল বৈদ্য, প্রথমদিন দেখে ভাবলাম যাঃ শালা, এতো গম্ভীর ছেলে হয় নাকি! তবে অনেক সময় বেশ হাসি ঠাট্টা, রঙ্গ তামাশা হতো, তখন একদম অন্যরকম। মেটালার্জির চিন্ময় মুখার্জী বা চিনুর বাবা ছিলেন চেন্নাই-এর এক আই এ এস অফিসার। কথা বলার একটা অদ্ভুত ধরন ছিলো আর ছিলো হিন্দি গানের চলন্ত বিশ্বকোষ। একবার খুব বাওআলি হলো হোস্টেলে, কি নিয়ে সেটা কেউ জানে না, কিন্তূ একটা কিছু নিয়ে দিন্দা আর চিনুর মধ্যে ঝামেলা লেগেছে। কেউ বুঝতে পারছে না, কিন্তূ দুজনেই খুব উত্তেজিত। দেখতে দেখতে গোটা চারতলায় ঝামেলা শুরু হয়ে গেলো, তারপর আস্তে আস্তে দেখা গেলো দশ নম্বরের সবাই তাতে জড়িয়ে পড়েছে। নয় থেকে জুনিয়ররাও উঁকি মারছে। ঘটনাটি ছিলো "আজ কি বার?" সেদিন রাত বারোটা নাগাদ চিনুর রুমে এসে কথা বলতে বলতে দিন্দা বলে ফেলেছে, "আজ মঙ্গলবার", চিনুর দাবী রাত বারোটা বেজে গেছে তাই "আজ বুধবার"। এরকম ছদ্ম বাওআলিও মাঝে মাঝে হতো, আর আমরা সবাই তাতে দুপক্ষে ভাগাভাগি হয়ে বেশ উপভোগ করতাম। যদিও একটু বাড়াবাড়ি হলে অনেকে শুধু শুধু সেন্টু খেয়ে যেত।
থার্ড ইয়ার থেকে আমার অন্য একটা ভুমিকা শুরু হয়। তাত্ত্বিক বিষয়গুলি মাথায় বেশী ঢুকতো না, কিন্তূ ব্যবহারিক বিষয়গুলো, কম্পিউটার আর ডিজাইনের বিষয়গুলো দারুন লাগতো। তবে কম্পিউটার রুমে বসে থাকতাম বলে সব ক্লাস নোট নেওয়া হতো না। একটু মাঝামাঝি যারা থাকতো, তারা আমার জন্যে নোটগুলো যোগাড় করে রাখতো। আমার কাজ ছিলো শেষবেলায় সেই সব নোটে প্রথমবার চোখ বোলানো আর একইসঙ্গে বাকিদের পড়ানো। আমার এই অবৈতনিক টোলের ছাত্রসংখ্যা নেহাত খারাপ ছিলো না। তবে স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, অন্যদের বোঝাতে গেলে পড়াটাও বেশ ভালোই তৈরী হতো। ডিপার্টমেন্টাল বিষয়ে কখনো চোতা করিনি, কিন্তূ অনেক সময় অন্য অনেক ল্যাদের জনতার হয়ে চোতা তৈরী করে দিতাম। এটা করতে গেলে একবার মন দিয়ে পুরো নোটটা লেখাও হতো আর নিজের প্রস্তুতিটাও বেশ ভালই হতো।
চারতলায় ছিলো সিভিলের অনির্বান সেনগুপ্ত, আমার কাছে পরীক্ষা বা সাবমিশনের ঠিক আগে সেশনাল বা স্টীল আর কংক্রিট ডিজাইন বুঝতে আসতো। একদম যাকে বলে মরণকালে হরির নাম। তবে অনির্বানের প্রতিভা ছিলো শেষবেলায় সামলে নেবার, সে কোনো ল্যাবের ড্রয়িং হোক বা এল এস নেগির কয়েকটা নিশ্চিত অংক। কিছু ছেলে থাকে ক্লাসের প্রথমদিকে, কিন্তূ আলুভাতে মার্কা, চাকরি পেতে পেতে বছর ঘুরে যায়। আবার কিছুজন থাকে ক্লাসের একদম শেষের দিকে কিন্তূ সবাই নিশ্চিত এই ছেলে প্রথম সুযোগেই সবাইকে মেরে বেড়িয়ে যাবে। অনির্বান ছিলো শেষের দলে। মনে হতো কোনোরকমে পাশ করতে পারলে বাঁচে, কিন্তূ পাশ করে টপাটপ একেকটা চাকরি বদল করার মাঝে আই আই টি মাদ্রাস থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করে একটা বেসরকারী কোম্পানির বেশ উঁচু পদে কর্মরত। প্রচুর দেশ ঘুরেছে আর যতোরকম অখাদ্য, কুখাদ্য বেশ মজা করে উপভোগ করেছে। ওর মতে ওগুলো নাকি সবই সুখাদ্য এবং উপাদেয়।
এছাড়াও চারতলায় কয়েকজন পিজির ছাত্র থাকতো, অমিতাভদা, সৌগতদা এরা। দুজন মেকানিকালের ছেলে ছিলো, ভালো নাম মনে নেই, ডাকনাম ছিলো ঝোল আর বান্টি। ওরা সন্ধ্যের পরে ঘরে থাকলেই বোঝা যেতো। আশেপাশের বেশ কয়েকটা ঘর থেকে পাওয়া যেতো কোলে মার্কেটে এক বৌদির দোকান থেকে আনা গাঁজার গন্ধ। বান্টির ছিলো খুব সুন্দর তবলার হাত। তিনতলায় ৩১১তে থাকতো সিভিলের হাম্পু মানে সুনন্দন লাহিড়ী আর মেকানিকালের সৌমাভ চন্দ্র। আমি, সৌমিক, সৌমাভ, সিতাংশু এরাসব ছিলাম বর্ধমানের ছেলে। একদিন ৩১১ তে বসে বান্টির তবলা শুনেছিলাম। তবলায় শুনিয়েছিলো,
"ধীরে সে যানা খাটিয়ান মেঁ ও খাটমল,
ধীরে সে যানা খাটিয়ান মেঁ,
সোয়ী হ্যায় রাজকুমারী দেখ রহি মিঠে সপনে,
যা যা ছুপ যা তাকিয়ান মেঁ ও খাটমল,
ধীরে সে যানা খাটিয়ান মেঁ।"
মনে হয়েছিলো শুধু তবলা নয়, কেউ যেন তবলাসঙ্গতে গানটাই গাইছে। তবে পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিলো না। বাঁকুড়ার ছেলে, ফিফথ সেমেস্টারে শোনা গেলো বান্টি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে বিষ্ণুপুরে একটা যাত্রাপার্টির সঙ্গে তবলা বাজাতে চলে গেছে। আবার বছর খানেক পরে ফিরে এসেছিলো, কারণ বাড়ি থেকে বলেছিলো স্নাতক পাশ না করলে এসব গানবাজনা করা যাবে না। সাধারণ লাইনে ভর্তি হলে কমপক্ষে দুবছর লাগবে আর ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করতে একবছরের একটু বেশী। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটাই শেষ করতে এসেছিলো, যাতে তারপর মনের সুখে তবলা বাজাতে পারে।
মেকানিকালের অসিতেশের সঙ্গে থাকতো সিভিলের সৌগত বা বিধবা। সৌগত দারুন টিটি খেলত, নেটের কাছে পাক খাত্তয়া বল বা সজোরে চাপ মারা বল অবহেলায় অপরপক্ষের কোর্টে ফেরত পাঠাতো। আর সেরকম দাবা খেলতো, ওকে এই দুটো খেলাতে হারানো প্রায় অসম্ভব ছিলো। জীবনে একটাই আফশোষ ছিলো, যাদের ভালো লাগতো তারা সবাই বড়পর্দার নায়িকা কেউ বাস্তবে ছিলো না। অসিতেশ অনেকটা রুগীর মতো খুব কমই হোস্টেলে থাকতো। পড়াশোনা করতে চলে যেতো হলে কোনো গাঁতু জনতার রুমে।
আমাদের পাশের রুমে ৩০২-তে ইলেকট্রিকালের বিধান আর কল্লোল ছিলো রুমমেট, কিন্তূ দুজনে প্রায় দুই মেরুর। কল্লোল ছিলো বেশ প্রাণোচ্ছল, মিশুকে। আর বিধান ছিলো চুপচাপ, সবসময় গম্ভীর, পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে দুজনের হাতাহাতিও লেগে যেত, বিধান তখন নাক দিয়ে একটা ঘোঁত ঘোঁত করে শব্দ করতো। কল্লোল একটা ডায়েরি লিখতো, আমরা ভাবতাম হয়তো সেটা কোনো কবিতা লেখার খাতা অথবা কল্লোল ওখানে রোজনামচা লেখে। কিন্তূ কিছুতেই আমাদের ওর ডায়েরি দেখতে দিত না। একদিন পরিকল্পনা করে ডায়েরি হাতানো হলো। দেখা গেল সেটাকে ডায়েরি না বলে গুপ্তকামের সুপ্ত প্রকাশ বলা যেতে পারে।
দোতলায় ছিলো সিভিলের রাজীব ব্যানার্জী, পার্থ প্রতিম ব্যানার্জী আর মলয় বিশ্বাস। পার্থ প্রতিম ব্যানার্জী প্রথম কনস্ট্রাকশন বা নির্মান কোম্পানিতে যোগ দেয়। পরে এক প্রখ্যাত সিনিয়ারের অফিসে এবং একটি মালয়েশিয়ান ডিজাইন কোম্পানিতে কাজ করে এখন দিল্লীতে ব্রিজ ডিজাইনে মোটামুটি এক পরিচিত নাম। রাজীব নির্মান কোম্পানিতে যোগ দিয়ে কয়েকটা বিভিন্ন সাইট ঘুরে এখন উত্তর ভারতের কোথাও থিতু হয়েছে। এখন আমেরিকার বাসিন্দা মলয় সবসময় ফিটফাট থাকতো, বেশ পরিচ্ছন্ন বেশভুষা, গায়ে দামী সুগন্ধী। শেষ বছরেও মলয়, রাজীব ও পার্থর সাথে সেন হলে থাকতাম। খুব একটা মনে পড়েনা, মলয়কে কোনদিন বারমুডা বা কোনো ঘরোয়া পোশাকে দেখেছি বলে। কলেজ জীবনে যেটা ছিলো প্রায় অস্বাভাবিক।
…………...
এরকম আরো কয়েকজন ছিলো যাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা থাকলেও, সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু মনে আসছে না। এবার নোঙ্গর তুলে একটু উজানে যাবো। নাম না করে কয়েকটি ঘটনা বলার জন্যে আর কয়েকজনের সম্বন্ধে আরও কিছু অভিজ্ঞতা জানাবো বলে। যাদের কথা বললাম তাদের একজনের কথা চোতাকাহিনীতে বলেছিলাম, হারমোনিয়াম চোতার মাষ্টার ছিলো। সেই ব্যক্তি যে মাধ্যমিকে অংকে একশয় একশ আর উচ্চমাধ্যমিকে অংকে দুশয় দুশ পেলেও চারটি সেমেস্টারেই অংকে এক সুযোগে পাশ করতে পারেনি। একটা সাপলি দিতে যাবার আগে আমরা দেখেছিলাম এক সন্ধ্যেবেলায় তিনঘন্টা ধরে গ্রেওয়ালের মোটা অংক বইটাকে একটা হারমোনিয়াম চোতায় টুকে ফেলতে। আর একজন হঠাৎ খুব মনমড়া হয়ে পড়েছিল। খুব ভয়ে আর আতঙ্কে ছিলো। যতদুর জানি হোস্টেলে শুধু আমাকেই বলেছিলো কারণটা। বান্ধবীকে নিয়ে দীঘা ঘুরতে গিয়েছিলো। অসাবধানতার পরিনামে কয়েকমাস পরে বান্ধবীকে গোপনে গর্ভপাত করাতে হয়। কিন্তূ যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বাড়িতে জামা প্যান্ট কাচতে গিয়ে মায়ের চোখে পড়ে যায় নার্সিং হোমের কাগজটা। তারপর বেশ কিছুদিন বাড়িতে ঝামেলা চলেছিলো। ছেলেটি নিজের মনের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছে অনেকদিন। তারপর হয়তো সব সমস্যার মতো সময়ই এই সমস্যারও সমাধান করে দিয়েছিলো, বা সবাই আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছিলো।
আর একজন ছিলো সেই বইমেলায় হাত সাফাই করতে ওস্তাদ ছেলেটি। এছাড়া বিভাসদা আমাদের থেকে অনেক সিনিয়ার হলেও বন্ধুর মতো মিশত। অনেকসময় একসাথে আমি, দেবু, নিমাই, বিভাসদা চলে যেতাম গঙ্গার ধারে, বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে বা কোলে মার্কেটের দিকে। সঙ্গে অনেকসময় যোগ দিতো সৌমিক বা রুগী বা অন্য কেউ। দেবুর আলো জ্বালিয়ে রাখা ছাড়াও আর একটা ভুমিকা ছিলো। টিভি রুমের প্লাগে মাঝেমাঝেই শর্টসার্কিট হতো। আমরা হাঁক মারতাম দেবুকে। দেবু লুঙ্গি পরে আর পায়ে একটা মিলিটারী গামবুট চড়িয়ে এসে হাজির হতো, হাতে একটা টেস্টার নিয়ে। আমরা হাসাহাসি করলেও দেবুর বক্তব্য ছিলো এতে নাকি শক লাগবে না।
…………...
মনে আছে রবিবার বর্ধমান থেকে হোস্টেলে ফেরার সময় বিকেল ৩:১৫-র লোকাল ধরতাম। কারণ পরের লোকাল ৪:৪০-এ, সেটা ধরলে রবিবার সন্ধ্যের বাবা সায়গলের পরিচালনায় সুপারহিট মুকাবলার প্রথম কয়েকটা গান মিস করে ফেলব। তখন এতো টিভি চ্যানেল ছিলো না। গানের অনুষ্ঠান বলতে সুপারহিট মুকাবলা, রবিবার সকালে হেমা মালিনীর রঙ্গোলী আর বুধবার সন্ধ্যেবেলায় চিত্রহার। আর মাঝে মাঝে কোলে মার্কেটের ভিডিওর দোকান থেকে ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে আসা হতো। জনতার ভোট নিয়ে একটা বাংলা, একটা হিন্দী আর একটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে। অবধারিতভাবে পরদিন গিয়ে বলা হতো কমপক্ষে একটা ক্যাসেট খারাপ ছিলো, যাতে একটু কম পয়সা দিতে হয়। সেই ফিতে দেওয়া ভিডিও ক্যাসেট চালানোর যন্ত্র বা ভিসিআর-এর হেডে মাঝে মাঝেই ময়লা পরে যেতো, সিগারেটের রাংতাতে আফটার শেভ লোশন লাগিয়ে সেটা পরিষ্কার করা হতো, সেসব এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
……………
এছাড়াও থার্ড ইয়ারের শীতের ছুটিতে আমাদের সার্ভে ক্যাম্প হয়েছিলো। আসলে সেবার ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রোঃ পি কে রায় (পিকসা) আর প্রোঃ প্রতীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (আমজাদ) উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাইরে কোথাও সার্ভে করতে যাবার। অর্থনৈতিক কারণে ঠিক হয় কাছাকাছি কোথাও যাওয়া হবে। যদিও কিছু জনতার ইচ্ছে ছিলো কলেজেই সার্ভে করার আর চেনা পরিবেশে আগের বছরের মতো হুল্লাট মস্তি করার। অনেক টালবাহানার পর ঠিক হলো ব্যান্ডেল সার্ভে ইনস্টিটিউটে যাওয়া হবে যাতে একটা অনুকূল পরিবেশ এবং পরিকাঠামো পাওয়া যায়। শেষে প্রদ্যুতের বাড়ি নৈহাটি বলে ওর উপড় ভার পড়ল সরজমিনে দেখে আসার জন্যে। আমরা জানতাম প্রদ্যুত সেই দলে যারা চায় কলেজেই সার্ভে করতে। যতদুর মনে পরে প্রদ্যুতের সাথে যোগ দিয়েছিলো দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত, অনিরুদ্ধ সেন, অনির্বান সেনগুপ্ত, সন্দীপ মন্ডল, রাজেশ মিত্র, ব্রততী সেন, সোমা সিনহা, পারমিতা রায়, শর্মিলা শিকদার এরা। মূল উদ্দেশ্য চেনা পরিবেশে মস্তি, জানা গাঁজার দোকান, রোজ বাড়ি থেকে যাতায়াতের সুবিধে আর অচেনা জায়গার সম্বন্ধে অজানা সব সন্দেহ। আর কিছুজন মানে আমি, অপূর্ব মণ্ডল, সুনান্দন লাহিড়ী, অরূপ মুন্সী, সংযুক্তা রায়, বিকাশ জওসোয়াল, সমিত রায়চৌধুরী, নীলাঞ্জন রায়, তন্ময় সাঁবুই, সন্দীপ রায় এরা চাইছিলাম বাইরে কোথাও যেতে। অবশেষে প্রদ্যুত সার্ভে ইনস্টিটিউটে না গিয়েই এক সোমবারে এসে বললো, জায়গাটা সার্ভে করার উপযুক্ত নয়; ঝোপঝাড়, সাপখোপ আর আগাছায় ভর্তি। অতএব সেই আবার কলেজ চত্বরেই সার্ভে শুরু হলো।
এই বছর আমাদের হাতে এলো নির্ভুল জরীপের জন্যে ব্যবহৃত উন্নত যন্ত্র থিওডোলাইট। এর বীক্ষণ যন্ত্রটি যেকোনো অনুভূমিক এবং উল্লম্বতলে ঘোরানো যেত। আমাদের সময় কিছু ট্রানজিট, আর কিছু ননট্রানজিট থিওডোলাইট ছিলো। ট্রানজিট মানে যেগুলো ভার্টিকাল বা উল্লম্বতলে পুরোপুরি বৃত্তাকারে ঘোরানো যেত, মানে ৩৬০ ডিগ্রী। ননট্রানজিটগুলো শুধু অর্দ্ধবৃত্তাকারেই ঘোরানো যেত, মানে ১৮০ ডিগ্রী। থিওডোলাইটের ব্যবহার শিখে নেবার পর দেখা গেলো খুব সহজেই আমরা এক বিশাল ক্ষেত্র জরীপ করে ফেলতে পারতাম। এছাড়া বীক্ষণযন্ত্র বা দুরবীনটা দিয়ে অনেক দুরের জিনিস পরিষ্কার দেখতে পেতাম। কাজ হয়ে গেলেই হোস্টেলের ছাদে থিওডোলাইট লাগিয়ে বিভিন্ন স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে, মডেল স্কুলের দিকে অথবা গঙ্গার দিকে নজর চালাতাম। থার্ড ইয়ারের সার্ভেতে শেখানো হতো ট্রাভার্সিং, ট্যাকোমেট্রি, কার্ভসেটিং, ত্রিকোণমিতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করে উচ্চতা মাপা ইত্যাদি। একটা মনে হয় টোটাল স্টেশন এসেছিলো যতদুর সম্ভব সোকিয়ার, যেটা শেষদিকে একদিন একটু দেখিয়ে আবার তুলে রাখা হয়েছিলো স্টোররুমে। এই থিওডোলাইট নিয়ে দেখতে গিয়ে আমাদের আসার আগে মানে ১৯৯১ সাল নাগাদ শঙ্খকর ভৌমিক বা ল্যামিদার একটা অভিজ্ঞতা তুলে দিলাম:
"ক্যাম্পাসের পেছন দিকে, কলেজ আর গঙ্গার মাঝামাখি কিছু গাছপালা ঘেরা জায়গা ছিল যেখানে কখনো মানুষের পা পড়ে বলে মনে পড়ে না। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে কিছু পরিত্যক্ত লঞ্চ বা জাহাজের কংকাল বা পুরনো লাল ইঁটের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ত। আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে, তখনকার থার্ড ইয়ারের সিভিলের দাদাদের সার্ভে ক্যাম্প চলছিল। সেই সুবাদে কে যেন একটা থিওডোলাইট এনে হোস্টেলে রেখেছিল। সেই কদিন, সিনিয়রদের অনুমতি নিয়ে আমরা পাঁচতলার ছাদে যন্ত্রটা খাটিয়ে থিওডলাইটের শক্তিশালী দূরবীনে গঙ্গার ধার বা আশপাশের এলাকা দেখতাম।
একদিন দেখি জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙ্গা বাড়ির ছাদে তিন চারজন লোক একটা নীল প্লাস্টিকের শিট পাতছে, মনে হয় কিছু মালপত্র প্যাক করা হবে। ঐ বাড়িটায় মানুষ থাকে বলে কখনো মনে হয় নি (থাকবেই বা কি করে, দেয়ালগুলো ভগ্নপ্রায়, একটাও জানালার পাল্লা নেই), তাই হঠাৎ তিন চারটে উটকো লক দেখে কৌতূহল হল- থিওডোলাইটে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলাম।
একটু পরে দুজন লোক গিয়ে প্যাক করার জিনিসটা ধরাধরি করে নিয়ে এল- একটা মানুষ, তার মুন্ডুটা নেই। চেঁচিয়ে আশপাশের ছেলেপুলেদের ডাকলাম। সবাই পালা করে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে দেখল- লোকগুলো নীল প্লাস্টিক দিয়ে মৃতদেহটাকে প্যাক করে বাড়ির ছাদে রেখে চলে গেল। পুলিশে খবর দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সিনিয়াররা প্রবল আপত্তি করল এবং কাউকে না জানাতে বলল।
লোকগুলোকে আর কখনো দেখি নি। এবং পরের দিন দূরবীনে চোখ লাগিয়ে নীল প্লাস্টিকের মোড়কটাকেও আর দেখতে পাই নি।"
………………….
এছাড়াও প্রতিবারের মতো সার্ভে ক্যাম্পে কয়েকজন মিলে রান্না করে একসাথে খাওয়াদাওয়া হতো। অনেকে বাইরে খেতে যেত। বাপী মুরগীর কাছ থেকে একটু সস্তায় মুরগী নিয়ে এসে রান্না করা হতো। বাকিসময় আলু আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে ভাত। একবার মনে আছে রাজীবরা চচ্চড়ি করে খাইয়েছিলো, আর হাতেকলমে দেখিয়েছিল বেগুন সিদ্ধ করার সময় খুন্তি ঠেকালে কেমন দরকোঁচা মেড়ে যায়। বিভাসদারা মনে হয় পুরো সার্ভে ক্যাম্পেই আমাদের সাথে ছিলো, ওদের কোনো প্রজেক্ট চলছিলো বলে। দারুন মজা হতো। একদিন নাকি হাম্পু মানে সুনন্দন লাহিড়ী নেশা করিয়ে দিয়েছিলো সৌগত মানে গুল্লুর। পরে শুনেছিলাম উৎসাহের বশে গুল্লু নিজেই কয়েকদানা রজনীগন্ধা খেয়েছিলো। আর তাতেই নাকি পুরো সেকেন্ড হাফটাই আউট হয়ে লর্ডসের মাঠের ধারে শুয়েছিলো। একবার কে যেন রামের সাথে টম্যাটো সস আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে একটা ককটেল করেছিলো। সেটা যারা পরখ করেছিলো তাদের বাথরুমে গিয়ে বেসিনে কলের তলায় মাথা পেতে জল ঢালতে হয়েছিলো। আর একজন অনেকদিন আগেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া গ্লুকোনডি দিয়ে বিয়ার খেয়েছিলো। ভোরের আগেই গায়ে বড় বড় ফোস্কা বেড়িয়ে যাওয়ায় তাকে শেষ পর্যন্ত্য পিজি হসপিটালে কয়েকদিন ভর্তি থাকতে হয়েছিলো।
আগেই বলেছি সার্ভেতে অনেক অধ্যাপক ভাগাভাগি করে আমাদের বিভিন্ন দলের দায়িত্বে থাকতেন। এর মধ্যে একজনের বাড়িতে জমা দেবার আগের দিন একটু দেখিয়ে আনবো বলাতে উনি বলেছিলেন, "দেখো, দেখিয়ে দিতে তো আমার আপত্তি নেই। তবে আমার বাড়িতে একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে। তাই আমার গৃহিনীর তোমাদের মতো উঠতি বয়সের ছেলেদের বাড়ি ঢোকাতে আপত্তি আছে।" হোস্টেল দশের এক জনতার (সিভিলের নয়) স্বভাব ছিলো রাতের বেলায় বিভিন্ন স্টাফ কোয়ার্টারে গিয়ে উঁকি মারা। সেই দেখাদেখি বেশ কয়েকজন খোরো পাবলিক এই দলে যোগ দিয়েছিলো। আমাদের কাছে উপরের ঘটনাটি শুনে তারা সেই অধ্যাপকের দোতলার কোয়ার্টারে উঁকি মারতে গিয়ে, একজন শ্যাওলা ধরা কার্নিশ থেকে নিচে পড়ে হাত ভেঙ্গেছিলো।
…………………
অনেক কিছুই হয়তো বাদ রইলো, অনেকের কথাই হয়তো বলা হলো না। যেমন রুগীর কথা, সেটা পরে বলবো। আমার রুমমেট সৌমিক মাঝে মাঝে নির্বিকল্প সমাধিতে চলে যেতো। হঠাৎ দেখা যেতো একা একা টিফিন করে এসে চুপচাপ রুমে ঢুকে উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ত বা নিজের মনে বই নিয়ে বসতো। আমি, সিতাংশু বা সৌমাভ এমনকি ইলেকট্রিকালের ছেলেরাও ওকে এই সময় এড়িয়ে চলতাম আর পিছনে হাসাহাসি করতাম। কিছু জানতে চাইলে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চিপে ধরে ওষ্ঠবর্ণবর্জিত একটা সংক্ষিপ্ত জবাব দিতো। আবার অনেক সময় দারুন রোমান্টিক হয়ে যেত, বিশেষতঃ টিভিরুমে রাভিনা ট্যান্ডনের কোনো সিনেমা বা গান থাকলে। এছাড়াও বাদ থাকলো সিভিল বা অনান্য ডিপার্টমেন্টের কিছু টুকরো ঘটনা, রেবেকা, ডিপার্টমেন্টাল ওয়েলকাম ইত্যাদি সেগুলো যথাসময়ে।
…………………
থার্ড ইয়ারের শেষে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং হয়। একটা লিস্ট টাঙ্গানো হয় যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ও আসনসংখ্যা দেওয়া থাকে। মেধাতালিকা থেকে নিজেদের যোগ্যতা আর সুবিধে অনুসারে সবাই তার মধ্যে একটা করে বেছে নেয়। এর মধ্যে অল্পকিছু থাকতো যেখানে ট্রেনিং-এর সাথে একটা বৃত্তিও দেওয়া হতো, বাকি সবগুলোই হতো অবৈতনিক। অনেকেরই ট্রেনিং কলকাতার আশেপাশে থাকতো বলে তারা হোস্টেল থেকেই যাওয়া আসা করতো। আমি ট্রেনিং করি দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে। অনেককিছু জিনিস দেখেছিলাম আর জেনেছিলাম। আমার সাথে ছিলো সুব্রত পান্ডা, প্রণব পন্ডিত আর দ্যুতিমান হাজরা। দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বাসের মাথায় প্ল্যান্টে যেতে মাত্র চার আনা ভাড়া দিতাম স্টুডেন্ট কার্ড আর ডিএসপির হেলমেট দেখিয়ে। তাও মাঝে মাঝে দুজন নিচে আর দুজন ছাদে চড়তাম। যাতে কন্ডাকটর নীচে ভাড়া চাইতে এলে বলা যায় উপরের বন্ধুরা দেবে আর উপরে এলে বলা হতো নিচে। প্ল্যান্টে মাত্র দেড়টাকা দিয়ে পেটভর্তি করে লাঞ্চ করতাম আর মাঝে মাঝে আমার এক দাদুর দৌলতে অফিসার্স ক্যান্টিনে চারটাকার অতি উত্তম খাবার। প্রায় একমাসের ট্রেনিং ছিলো, অনেক ছোটো খাটো ঘটনাও ছিলো। আর যারা হোস্টেলে থাকতো তারাও বেশ অনেক রকম মস্তি করেছিলো। এই ট্রেনিং শেষ করে এসে আমরা বাকি থার্ড ইয়ারের ছাত্ররা হোস্টেলের পাট পুরোপুরি গুটিয়ে চলে গিয়েছিলাম একেকটা হলে। আমি গিয়েছিলাম সেন হলের ম্যাক উইংসে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.