- ১৯. ছাত্র সংসদের কিছু কথা
অনেক ভেবে সংসদ শব্দটা ব্যবহার করলাম যাতে, ছাত্র পরিষদ বা ছাত্র ইউনিয়ন-এর সাথে গুলিয়ে না যায়। আর সত্যি বলতে আমি নিজে কোনোদিন সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি। এমনকি রেবেকাতেও আমার ভুমিকা ছিলো অনেকটা দর্শকের, খাটাখাটনি গুটিকয় ছেলেপিলে করতো। আমরা যখন এসেছি থেকে অনেকেই আমাদের সবার হয়ে খেটেছে, হয় ইউনিয়ন হিসেবে বা রেবেকা কমিটি হিসেবে। অনেকে হয়তো কোনো পদে না থাকলেও প্রচুর অবদান রাখতো সবকিছুর মধ্যে। কয়েকজনের নাম মনে পড়ছে, তবে অনেকের নাম মনেও পড়ছে না। এতে তাদের অবদান একদমই ছোটো হতে পারে না। কারণ সেটা আমারই অপরাধ। যেহেতু আমি খুব একটা এসবের মধ্যে ঢুকতাম না, তাই সব কর্মীর সাথে পরিচয় করার সুযোগ পাই নি।
আর একটা কারণ, যেটা মনে হয় প্রায় সবাইকেই বাড়ি থেকে বলে দিত, তা হলো কলেজে গিয়ে যেন রাজনীতির ল্যাজ না গজায়। বাবা মায়ের সব কথা না শুনলেও এটা কেন জানিনা শুনেছিলাম। তবে এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে আমাদের থেকে দুবছরের সিনিয়ার বগাদার উক্তি, "ভোট দিস তো? তাহলে বল যে ভোট দেয় সে অরাজনৈতিক হয় কি করে?" সত্যি এটা তো ভেবে দেখিনি। তারপর শুনতে হয়েছিল, "রাজনীতি হলো রাজার নীতি, রাজ্য পরিচালনার নীতি। আর যারা রাজনীতি করে না তাদের কোনো নীতি নেই।"
ইউনিয়ন বা সংসদের কথা বলতে গেলে যাদের নাম মনে পড়ছে তাদের মধ্যে কয়েকজন হলো দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (ড্যাড), রণজয় রায় (পাম্পু), অশেষ পাল, সপ্তর্ষি মজুমদার (মনিদা), শুভময় গাঙ্গুলী, অমিতাভ দাস (মামা), সৌগত মুখার্জী (চিংড়ি), শান্তনু দত্তগুপ্ত (কুত্তা), সুনন্দন লাহিড়ী (হাম্পু), প্রদ্যুত মিত্র, নির্ভীক সেনগুপ্ত, কৃষ্ণেন্দু পাল (কেষ্টা), শীর্ষেন্দু জানা, ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য, প্রদীপ ঘড়া, ধীমান চক্রবর্তী, দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত (মোটা) ইত্যাদি। কয়েকজন থাকতো মূলতঃ পোস্টার তৈরী, কার্টুন আঁকা বা অনান্য উদ্ভাবনী সম্পাদকীয় কাজকর্মের সঙ্গে। যেমন শঙ্খকর ভৌমিক (ল্যামিদা), কল্লোল এরা সব। এছাড়াও অনেকে ছিলো মূল রাজনীতিতে বা ছাত্র সংগঠনের নেপথ্যে।
এই পর্বে একটু গোড়ার কথা বলে নেওয়া যাক। যখন শুধু সিভিলের ডিগ্রী কোর্স পড়ানো হতো, তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের জন্যে একটা ক্লাব ছিলো। ১৮৮২ সাল নাগাদ শুরু এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিভিলের ছাত্র রায় বাহাদুর চুনিলাল সরকার। ক্লাবের কাজ ছিলো শুধু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা। এছাড়াও ছিলো একটা নিজস্ব পাঠাগার, যেখানে মূলতঃ কিছু সহজপাঠ্য গল্পের বই থাকতো। সামাজিক মূল কাজের মধ্যে ছিলো একটা নৈশবিদ্যালয়, যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্ররা শিল্পী বা কারিগরদের পড়াতো। একটা বিতর্কসভা ছিলো, যেটা পরে উপরোক্ত ক্লাবের সাথে জুড়ে যায়। এই ক্লাবের কাজ চলতো পুরোনো হাসপাতাল ভবনে, যেটা ছিলো নিম ঝিলের শেষপ্রান্তে - এখনকার স্লেটার হল ও ১১নং হোস্টেলের পিছন দিকে। ১৯৩০ সাল নাগাদ এটা সরে আসে স্লেটার হলের ডাইনিং রুমে। এই সময় থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো শুরু হলে, মেকানিকালের ছাত্ররা আরেকটা ক্লাব চালু করে। এরপরেও বি ই কলেজ স্টুডেন্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা হবার আগে আরো কিছু বিক্ষিপ্ত ছাত্র সংগঠন চালু হয়ে যায়।
কলেজ চত্বরে বিদ্যার্থীর কথা বলতে গেলে বি ই কলেজের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও আরও অনেকের কথা বলতে হয়। ১৯৫৪ সালে স্থাপিত বি ই কলেজ মডেল স্কুলের বিদ্যার্থীদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ক্রীড়ানুষ্ঠান গুলো দেখাশোনার দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের। নিজস্ব মাঠ থাকলেও কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কোনো অনুষ্ঠানের জন্য কলেজের অন্য জায়গা বা হল ব্যবহার করতে পারে। এছাড়াও ছিলো বি ই কলেজ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, যেখানে ডিপ্লোমা বা LCE পাঠক্রম পড়ানো হতো। এছাড়াও হতো অ্যাপ্রেন্টিস প্রশিক্ষণ। এখন বিভিন্ন পরিবর্তনের পর এটি এখন আইটিআই, শিবপুর। কার্পেনট্রি, সীট মেটাল, ওয়েল্ডিং, ফোরজারির, অটোমোবাইলের মতো অনেকগুলো শাখা বন্ধ হয়ে গেছে। দু বছরের পাঠক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়: ইলেকট্রিসিয়ান, ফিটার, মেকানিক্যাল ড্রাফটসম্যান, মেসিনিস্ট, মোটর ভেহিকেলস মেকানিক ও টার্নার। এছাড়া তিন বছরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় টুল ও ডাই মেকিং-এর উপড়। এর সঙ্গে এটি বৈদ্যুতিক বিভাগের উৎকর্ষতার কেন্দ্র। এদের নিজস্ব কোনো ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন নেই, কিন্তূ বিদ্যার্থীরা বার্ষিক ক্রীড়া বা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারে। হাওড়ার আমতলাতে রাজ্য সরকারের একটি জনকল্যাণ কেন্দ্র (স্টেট ওয়েলফেয়ার হোম) আছে। ১৯৫১ সালের একটি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে বি ই কলেজ এই হোমের ৭৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক অনাথ বিদ্যার্থীর কারিগরী শিক্ষার দায়িত্ব নেয়। এরাও বার্ষিক ক্রীড়া বা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং কলেজের রাষ্ট্রীয় রণশৈক্ষবাহিনীর (NCC) প্রশিক্ষণ নিতে পারে।
১৯৩২ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ মিঃ ম্যাকডোনাল্ড সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ও অ্যাপ্রেন্টিস ছাত্রদের পরামর্শ দেন বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে এক ছাতার তলায় আসতে। উনি তৎকালীন সমাবেশ কক্ষ বা অ্যাসেম্বলি হলে ছাত্রদের এক সাধারণ সভায় বলেন, শীঘ্রই সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ শুরু হতে চলেছে। তাই এই ভবনকে কেন্দ্র করে কলেজের সমস্ত ছাত্রদের জন্যে একটাই সঙ্ঘ বা ইউনিয়ন গড়ে তোলা যেতে পারে। কলেজের প্রযুক্তিগত জীবনে এটা যুক্তিসঙ্গত যে, সামাজিক জীবনের প্রতি ছাত্রদের একটি ঐক্যবদ্ধ নির্দিষ্ট প্রকাশ থাকবে, যেখানে সব ছাত্রই অংশগ্রহণ করতে পারবে। সমস্ত ছাত্র এই পরামর্শ আনন্দের সাথে মেনে নেয়। অধ্যক্ষ সব ছাত্রদের নিয়ে একটা সঙ্ঘ তৈরী করেন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্টুডেন্টস ইনস্টিটিউট (Bengal Engineering College Students' Institute: BECSI) নামে। অ্যাসেম্বলি হলে মিঃ ম্যাকডোনাল্ডের সভাপতিত্বে কিছু সংশোধনীসহ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সংবিধান অনুমোদিত হয় ১৯৩২ সালের ১১ই এপ্রিল, সন্ধ্যে সাড়ে ছটায়। জন্ম নেয় কলেজের প্রথম ছাত্র সংসদ BECSI, আর অ্যাসেম্বলি হলের নাম হয় ইনস্টিটিউট হল। তখনও ইনস্টিটিউট হলের পাশের ক্যান্টিন ছিলো না। ১৯৬৩ নাগাদ ওটা তৈরী হয় একটা নাচঘর হিসেবে, এখন যেটা কলেজ ক্যান্টিন। সংবিধান মতে সমস্ত ছাত্রই হয় BECSI-র বাধ্যতামূলক সদস্য। ঐচ্ছিক সদস্যপদ চালু হয় ষ্টাফ এবং প্রাক্তন ছাত্রদের জন্যে। যদিও BECSI গঠনে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকে শুধুমাত্র বর্তমান ছাত্রদের।
প্রথমে ইনস্টিটিউটের তিনটি সাব কমিটি ছিল; পাঠাগার সাব কমিটি, সামাজিক সাব কমিটি ও সামাজিক অনুষ্ঠান সাব কমিটি। এছাড়াও হিটন হল, ডাউনিং হল, স্লেটার হল এবং ইউরোপিয়ান ব্যারাকে একটা করে সাব ইনস্টিটিউট ছিল, যাদের কাজ ছিল নিজস্ব হলের দৈনিক সংবাদপত্র ও পত্রিকা রাখা এবং হলের মধ্যে আমোদপ্রমোদ ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। যদিও ইনস্টিটিউট ছাত্রদের জন্যে কাজ করতো, তবুও অবিভক্ত বেঙ্গল সরকার এই সংবিধান অনুমোদন করেনি। ১৯৪১ সালে তৎকালীন ছাত্র ইনস্টিটিউট নতুন সংবিধান রচনা করে, সেটাও সরকার থেকে খারিজ করে দেওয়া হয়। তবে এই বছর থেকেই ইনস্টিটিউট থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেন্ট জনস এম্বুলেন্স তত্বাবধনে কলেজের মেডিকেল অফিসার সপ্তাহে দুদিন সান্ধ্য প্রশিক্ষণ দিতেন এবং প্রশিক্ষণের শেষে সংস্থার তরফ থেকে পরীক্ষায় কৃতকার্য্যদের প্রশংসাপত্র দেওয়া হতো।
১৯৪৬ সাল নাগাদ ভারতবর্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয় এবং ছাত্ররা কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত একটা ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করে। যে ইউনিয়ন আপদে বিপদে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে পারে। ছাত্ররা প্রস্তুতি শুরু করে যাতে বেকসী (BECSI) অনান্য কলেজের মতো একটা শক্তিশালী ইউনিয়নের কাজ করতে পারে। ১৯৪৭ সালে বেকসীর সাধারণ সম্পাদক তার বিবৃতিতে বলেন, "আমরা আনন্দের সাথে ঘোষণা করছি যে দীর্ঘদিন ধরে অনুভূত কলেজ ইউনিয়ন প্রয়োজন বাস্তবে পরিণত হওয়ার পথে। একটা সাধারণ সভায় বিশেষজ্ঞ কমিটি নির্বাচিত হয়েছে যারা নতুন সংবিধান প্রায় তৈরী করে ফেলেছেন।" দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালে ইউনিভার্সিটি কমিশন কলেজ পরিদর্শন করে। তাঁরা ছাত্রদের ইউনিয়ন তৈরীর আবেদন মন দিয়ে শোনেন এবং এই ব্যাপারে ছাত্রদের সাথে একমত হন। কিন্তূ এবার ছাত্রদের খসড়া করা সংবিধান পশ্চিমবঙ্গ সরকার এতো বেশী সংশোধন করেন, যে সেটা ছাত্রদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা হারায়। সেই বছর কলেজে ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক খেদের সাথে বলেন, "আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিদ্যায়তন দেশ গঠনে ব্রতী, তাদের বিংশশতাব্দীর মধ্যভাগেও নিজেদের জন্যে একটা অনুমোদিত ছাত্র সংসদ নেই"।
১৯৫০-৫১ সালে ছাত্রদের নিয়ে গড়া আরেকটি কমিটি নূতন সংবিধান রচনা করলে সেটিও অনুমোদন পায় না। ১৯৫৩ সালে তৎকালীন অধক্ষ্য ডঃ সেনগুপ্ত ছাত্রদের ভরসা দেন যে ছাত্রদের জন্যে শীঘ্রই একটি ইউনিয়ন গঠন করা হবে। সেইমতো সেই বছর ইনস্টিটিউটের (BECSI) নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়। ঠিক হয় অনুমোদিত হলে, নতুন সংবিধান অনুসারেই পরবর্তী নির্বাচন হবে। কলেজ কর্তৃপক্ষের তত্বাবধনে ক্লাস প্রতি দুজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় প্রস্তাবিত ইউনিয়নের সংবিধান রচনা করার জন্যে। অধক্ষ্যের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে বিস্তর আলাপ আলোচনা করে নতুন সংবিধানের খসড়া করা হয়। এবারে ছাত্রদের মনে আশা জাগে যে দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে সংবিধান অনুমোদন পাবে এবং স্বীকৃত ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হবে। কিন্তূ এবারেও সংবিধানের খসড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ বাতিল করে দেন।
এবার ছাত্রদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে এবং ১৯৫৫ সালে BECSI-র সক্রিয় আন্দোলন শুরু হয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সংবিধানের অনুমোদন আদায় করার জন্যে। শেষে অধক্ষ্য ও ছাত্রপ্রতিনিধিদের মধ্যে এক বৈঠকে আগের খসড়া সংবিধান স্বল্প পরিবর্তনসহ দুপক্ষের কাছেই গৃহীত হয়। সরকারী সিলমোহর পরে ২২ শে মার্চ, ১৯৫৬ সালে যখন অধক্ষ্য মিঃ আর জি পি এস ফেয়ারবার্ন সাহেব ছাত্র সংসদের সংবিধান অনুমোদন করেন। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জন্ম নেই বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (Bengal Engineering College Students' Union: BECSU), ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে। পাঠককে অনুরোধ করবো তারিখগুলো লক্ষ্য করতে। প্রায় দশবার বাতিল হবার পর, স্বীকৃত ছাত্র সংসদ গঠন হতে কেটে যায় দীর্ঘ এতগুলো বছর। BECSU জন্ম নেয় যখন তখন কলেজের বয়সও একশ বছর ছুঁয়েছে। পরে আমরা দেখব কলেজের ১০০ বছরে শুরু হয়ে BECSU-র স্থায়িত্ব মাত্র পরের ৫০ বছর।
শুরুর সময় নতুন ছাত্র সংসদের উদ্দেশ্যগুলি ছিলো নিম্নোলিখিত:
# ক. কলেজের ছাত্রদের একমাত্র প্রতিনিধি সভা হিসেবে কাজ করা,
# খ. ছাত্রদের স্বার্থে ও কল্যাণে কাজ করা,
# গ. সর্বপ্রকারে প্রচেষ্টা করা যাতে ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য, জ্ঞাতিভাব এবং সততাপরায়ণতা বজায় থাকে,
# ঘ. ছাত্রদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার মান স্বাস্থ্যকর উপায়ে উন্নত করা, যাতে তারা মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে এবং শারীরিকভাবে ভবিষ্যত ভারতের যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারে,
# ঙ. ছাত্রদের প্রকৌশল গবেষণা ও অনুসন্ধান, দৃষ্টিভঙ্গী এর যৌক্তিকতা এবং দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার ব্যাপারে ছাত্র মধ্যে মুক্ত আলোচনায় উৎসাহিত করা,
# চ. ছাত্রদের সাথে শিক্ষক ও অনান্য কর্মীদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো,
# ছ. বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো,
# জ. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক কাজকর্মে সাহায্য করা।
কলেজের তালিকায় নাম থাকা সমস্ত ছাত্রই আপনা থেকেই এই সংসদের সদস্য হবার অধিকার লাভ করে। স্নাতকোত্তর ও গবেষক বিদ্যার্থীদের জন্যে ঐচ্ছিক সদস্যপদ চালু হয়। এইসব ঐচ্ছিক সদস্যদের বলা হতো অ্যাসোসিয়েট মেম্বার। শুরুর সময় ইউনিয়নের পাঁচটি বিভাগ ছিলো। সেগুলো হলো সামাজিক বিভাগ, সাহিত্য বিভাগ, আভ্যন্তরীন বিভাগ, বিতর্ক বিভাগ ও পাঠাগার বিভাগ। আরও ঠিক হয় প্রতি বছর অধ্যক্ষের নিযুক্ত একজন অবৈতনিক হিসাবপরীক্ষক ইউনিয়নের আয়ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা করবেন। এবার আসা যাক বেকসুর সদস্যসংখ্যায়। তৃতীয়বর্ষের মধ্যে একজন প্রার্থী হতো সভাপতি পদের জন্যে। আর তাছাড়া সব বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ভোট দিয়ে নির্বাচন করতো পাঁচজন শ্রেণী প্রতিনিধিকে (CR)। অর্থাৎ ১ সভাপতি + (৪ X ৫ প্রতিনিধি) = ২১ জনকে নিয়ে ইউনিয়ন গড়া হতো। শ্রেণী প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে থেকে বেছে নিতো একজন সাধারণ সম্পাদক আর একজন কোষাধ্যক্ষকে।
আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে ছাত্র সংগঠন, বিরোধী ছাত্র সংগঠন বা আরো পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন। যতদুর সম্ভব, প্রথম অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নাম ছিলো সাবেক, মানে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (Students' Association of Bengal Engineering College - SABEC)। সাবেক ছাত্র সংগঠন, তাই নামও সাবেক! আরও কিছু অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে, প্রথমটির যেগুলির অস্তিত্ব ছিলো শুধু এই কলেজেই সীমাবদ্ধ। যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্টস কনসোলিডেশন (IC) এবং আশির দশকে কিছুদিনের জন্যে শুরু হওয়া জেনারেল স্টুডেন্টস (GS)। আমাদের সময়ও টিমটিম করে হলেও টিকে ছিলো অরাজনৈতিক কিন্তূ বামপন্থী ছাত্র সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রাটিক স্টুডেন্টস ফেডারেশন (PDSF)। এরপর ধীরে ধীরে আসে সি পি আই (এম)-এর স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (SFI); ফরওয়ার্ড ব্লকের অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ব্লক (AISB); কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ (CP); সি পি আই (এম-এল)-এর প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রাটিক স্টুডেন্টস ওর্গানাইজেশন (PDSO); রাষ্ট্রীয় স্বয়ামসেভ়ক সংঘের অখিল ভারতীয় ভিদার্থী পরিষদ (ABVP) এবং শেষদিকে তৃনমূল কংগ্রেসের তৃনমূল ছাত্র পরিষদ (TCP)। যদিও কখনো CP বা কখনো SFI-ই মূলতঃ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন দখলে রেখেছে। এই নিয়ে সাধারনতঃ বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়া থাকলেও, কখনো বাইরে থেকে রাজনৈতিক প্রভাবে বা কখনো ঘরোয়া কোনো কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কলেজের মধ্যের সম্পর্ক। কিছু ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ, এমনকি দুয়েকবার পুলিশকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
এরপরে চলে আসি ২০০৫ সালের শেষপ্রান্তে। ওই বছর দোসরা ডিসেম্বর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শ্রী জে এম লিঙডোর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনের বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্যে ছাত্র সনেট গড়ে তোলার সম্ভাবনা অনুসন্ধান করে দেখার জন্যে। এই কমিটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেয় ২৬ শে মে, ২০০৬ সালে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৬ সালে এক নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিয়ন্ত্রক পরিষদকে (UGC) লিঙডো কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত করতে বলে। সেইমতো UGC ২০০৬ সালের ২৮শে নভেম্বর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অনুরোধ করে এই সুপারিশ কার্য্যকর করতে।
বেকসুর (BECSU) ১৯৫৬ সাল থেকে পথ চলা শুরু হয়ে থেমে যায় ঠিক ৫০ বছরের মাথায়। বি ই কলেজে নতুন ছাত্র সংসদের নাম হয় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটি শিবপুর স্টুডেন্টস সেনেট্ (BESUSSS) বা সেনেট্। সেনেটের গঠনটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। সেনেটে আছে তিন ধরনের সমিতি। প্রথমটি হলো বিদ্যার্থীদের শিক্ষা সমিতি (Students' Academic Societies), যেখানে প্রতি বিভাগে স্নাতকের প্রতি বছর থেকে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। আর স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চালু থাকলে বিভাগ প্রতি একজন করে স্নাতকোত্তর প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। এখানে বিভাগ মানে হলো দশটি প্রকৌশল বিভাগ ও চারটি বিজ্ঞান বিভাগ। প্রতি বিভাগের একটি করে অর্থাৎ মোট চোদ্দটি বিদ্যার্থীদের শিক্ষা সমিতি। প্রতিটি শিক্ষা সমিতির একটি করে নির্বাহী সমিতি থাকবে যার সদস্য হবে চারজন। একজন পরামর্শদাতা (Mentor), যিনি নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের পছন্দ অনুসারে বিভাগীয় প্রধান দ্বারা নিযুক্ত একজন বিভাগীয় অধ্যাপক। এছাড়া নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকে একজন করে সম্পাদক, সহসম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষ।
সেনেটের দ্বিতীয় সমিতি হলো বিদ্যার্থীদের সৃষ্টিশীল প্রকাশ সমিতি (Students' Societies of Creative Expressions-Clubs)। বর্তমান সাতটি ক্লাব হলো যথাক্রমে আলোকচিত্ৰবিদ্যা (Photography club), সঙ্গীত (Music Club), নাচ এবং নৃত্যবিন্যাস (Dance and Choreography Club), নাটক (Dramatics), বিতর্ক এবং সৃজনশীল লেখার ক্লাব (Debate and Creative writing), ক্যুইজ (Quiz) এবং দেশপ্রেম প্রচার কেন্দ্র (Centre for promoting Patriotism)। প্রতি ক্লাবের নির্বাহী সমিতিতে থাকবেন একজন করে পরামর্শদাতা (Mentor) যিনি নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের পছন্দ অনুসারে উপাচার্য দ্বারা নিযুক্ত একজন অধ্যাপক। এছাড়া সদস্যদের মধ্যে থেকে একজন করে সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ। যদিও ক্লাবের সংখ্যা ও নামগুলোর কিছুগুলি প্রস্তাবিত, যা শীঘ্রই চালু হবে।
সর্বশেষ হলো খেলাধুলার সমিতি (Students' Club of Games and Sports), যার সংখ্যা তিনটি। একটি আউটডোর গেমস ক্লাব, যার মধ্যে আছে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিক্স ও সুইমিং। একটি ইন্দোর গেমস ক্লাব, যার মধ্যে আছে জিমন্যাসিয়াম, ব্যাডমিন্টন, চেস ও টেবিল টেনিস। শেষেরটি হলো মহিলাদের বিভিন্ন খেলাধুলার জন্যে লেডিস গেমস ক্লাব। প্রতি ক্লাবে একজন করে অধ্যাপক পরামর্শদাতা এবং সদস্যদের মধ্যে থেকে একজন করে সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ।
উপরোক্ত সবকটিকে নিয়ে হলো জেনারেল কাউন্সিল, যাদের কাজকর্ম দেখাশোনার জন্যে একটি মূল নির্বাহী সমিতি। জেনারেল কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধিরা গোপন ব্যালটে বা হাত তুলে নির্বাচিত করবে একজন সাধারণ সম্পাদক (চতুর্থ বর্ষের বিদ্যার্থী), একজন সহ সাধারণ সম্পাদক (তৃতীয় বর্ষের বিদ্যার্থী) এবং একজন কোষাধ্যক্ষ (দ্বিতীয় বর্ষের বিদ্যার্থী)। নবনির্বাচিত মূল নির্বাহী সমিতি বা এক্সিকিউটিভ কমিটির সুপারিশে উপাচার্য একজন করে অধ্যাপককে নিয়োগ করেন সভাপতি এবং কার্যনির্বাহী সভাপতি হিসেবে। অর্থাৎ একুশ জনের ইউনিয়নের পরে প্রায় একশ জনের সেনেট। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই সেনেট কলেজের সুনাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করবে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.