ঙ।। দাঁড়কাক গোষ্ঠী ও বানভট্টের ভাটচরিত
এই পর্বটি যাদের মন দিয়ে পড়বেন তাদের আগেই বলে রাখি এই অংশটি আমার রচনা নয়। সাধু থেকে চলিত ভাষায় তর্জমাটা বাদ দিলে এটা ১৯৮৩-র সিভিলের স্নাতক বানভট্টদার সৃষ্টি। স্থান, কাল পরিবর্তিত হলেও সবসময় পাত্র পরিবর্তন হয় না। বা হলেও সার্বজনীন ভাবে তাদের স্বভাবগুলোও একইরকম রয়ে যায়। বি ই কলেজের ক্যাম্পাসটি সুন্দর হলেও, আমাদের কতিপয় সহপাঠিনীরা সেই সৌন্দর্যে বিশেষ বৃদ্ধি ঘটাতে পারত না। তারা মরুভূমিতে ক্যাকটাসের মতো বিরাজ করতো। "তবু যাহা চাই, তাহা ভুল করে চাই" - ভেবে যে যাকে পারলো তুলে ফেলল। যারা পারল তারা লাভার্স লেনের দিকে চলে গেল - "যো জিতা ওহি সিকন্দর"।
যারা পারল না তারা হাফসোল খেয়ে গজল শুনতে আরম্ভ করলো অথবা লিপি, ঝর্ণা, অলকা, মায়া(পুরী)-কে আপন করে নিল। যেমন ঐশ্বর্যকে হারিয়ে সলমন খান স্নেহা উল্লালে উল্লসিত। কেউ কেউ পড়াশোনায় মনোনিবেশের উদ্দেশ্যে উইং-এর শেষের ঘরে পুরো বছরের জন্যে হারিয়ে গেল। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তারা বেগম আখতারের গজল শুনতো আর গুনতো - স্বর্গের অপ্সরাদের ঠিক কজনের মানুষের মতো বত্রিশটি করে দাঁত আছে।
বাকিরা "ফাঁকা - নাকি, ফাঁকা - নাকি" বলতে বলতে (চন্দ্রবিন্দুর ভঙ্গিতে) কলেজ ছেড়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন বা কোলে মার্কেটের দিকে এগিয়ে যেত। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। হাউসফুল সিনেমাহলের সামনে টিকিটহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার অনুভুতি হলো। মনকে আমার রুমের লোহার খাটটার মতো শক্ত করলাম আর ভাবলাম - "দর্দ মে ভি কুছ বাত হ্যায়"। ভাববেন না আমিই কেবল দার্শনিক হবার চেষ্টা করছি। সেকালে আমার কিছু সহপাঠীরা (ভাটুনাম খ্যাত) "বিশ্বভাট" নামে একটি সংস্থা স্থাপন করেছিল। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভাটের প্রচার। ভাট মানে গ্যাঁজানো বা কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই আড্ডা মারা। কিন্তূ কিছুদিনের মধ্যেই ভাটুদের মধ্যে ভাটদর্শন নিয়ে মতান্তর দেখা দিল। যারা ভাবিত শুধুমাত্র ঘুমিয়ে থাকলেই পৃথিবী হবে সুন্দর তারা "ঘুমসেনা" নামে আলাদা হয়ে গেল। একদল চাইল গঠনধর্মী বিদঘুটে কার্যকলাপ, নাটক, বক্তৃতার মাধ্যমে ভাটের প্রচার ও প্রসার - তারা গোষ্ঠীর নাম রাখিল - "পাইকিউ"।
আর একদল ভাটতত্ত্বে সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে "তৎকালীন বাছা বাছা রামায়ন - মহাভারত" যোগাড় করিয়া একটি গোপন লাইব্রেরি খুলে ফেলল। গোপন গোষ্ঠীর নাম হল "দাঁড়কাক সমিতি"। সভাপতি হলেন ছদ্মনামে "মার্টিন ক্রো"। পরে সমিতির কার্যকলাপ জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তারা গোষ্ঠীর নাম বদল করে "কুকুর সমিতি" করে দিল। ককুর সমিতির সদস্যরা রাস্তায় পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে "ঘেউ - ঘেউ" করে অভিবাদন ও কুশল বিনিময় করতো এবং সারমেয় তত্ত্ব আলোচনা করতো। এইসব ভাটুরা দার্শনিক হইতে চুলচেরা দুরত্বে থমকাইয়া গিয়াছিল। তাই ইহাদের দেখিয়া দার্শনিক হেগেল বলিয়াছেন - "কিছু কিছু ভাটু আর একটু চেষ্টা করিলেই দার্শনিক হইতে পারেন, কিন্তূ কোনো দার্শনিকই শতচেষ্টায় ভাটে উর্ত্তীণ হইতে পারিবেন না।"
যারা লেডিজ হোস্টেলে থাবা বসাতে ব্যর্থ হয়েছিলো তারা সবাই মিলে যে গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলো তাদের গোষ্ঠীপ্রধান ছিলো 'মেসোপটেমিয়া'। এই অদ্ভুত নামের কারণ একটু পরেই বলা হয়েছে।
এই গোষ্ঠীটি ভাটে বিশ্বাস করতো না, কেবল হতাশার তাসা বাজাত। এদের স্লোগান ছিলো 'পাগল পাগল ভাই ভাই, সব পাগলের পাগলী চাই'। আর জীবনদর্শন ঠিক হলো 'চুল্লু (ভর পানী) মে ডুব মর'। গোষ্ঠীর প্রতীক ঠিক হলো 'জ্যান্ত কাক', সুতরাং তারা কাক ধরবে ঠিক করলো। কিন্তূ কাক ধরা ভীষন কঠিন, তবু হার মানলে চলবে না। এতএব একটি জবরদস্ত প্ল্যান করলো, একদিন ক্যান্টিনের সামনে চুল্লু-মেশানো পাঁউরুটি খাইয়ে একটা কাককে নেশাগ্রস্থ করে ধরে ফেললো। কাকটি একটু দাদাগোছের বলে নাম রাখা হলো 'জেফ ক্রো', সভাপতি 'মার্টিন ক্রো'র নামের সাথে মিল রেখে। সেই সময় জনৈকা গান্ধী পশুপ্রেমিকা হয়ে ওঠেননি, নাহলে বাঁশ হয়ে যেত। আর মনোজ মিত্র থাকলে নিশ্চয়ই একটা নাটক লিখে ফেলতেন - 'কাকের সন্ধানে কটি চরিত্র'।
এরপর দেখা দিল একটি সমস্যা। সকলে যখন ক্লাসে চলে যেতো, কাকটি মনমরা হয়ে থাকতো। কাকের বেদনা ও সামাজিক চেতনার বশবর্ত্তী হয়ে তারা ঠিক করলো কাকটিকে নিয়ে ক্লাসে যাবে। খাঁচাবন্দী কাক ক্লাসে চললো, ক্লাসে কানাকানি কাক এসেছে। পিছনের বেঞ্চে কাকের কা কা আর ব্ল্যাকবোর্ডে 'কানি'জ মেথড' মিলেমিশে একবারে একাকার (পড়ুন কাকাকার) হয়ে গেলো। এদের কাণ্ডকারখানা দেখে মহর্ষি চার্বাক বলেছিলেন - - - আসলে চার্বাক কিছুই বলতে পারেননি। চার্বাক হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন আর ভেবেছিলেন একেই মনে হয় বলে 'কাকস্য পরিবেদনা'।
এদিকে গোষ্ঠীপ্রধান মেসোপটেমিয়া পাগলী খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেলেন। কাক ধরা দিলেও পাগলী অধরা রয়ে গেল। ঠিক করলেন জ্যোতিষী অমৃতলালের পরামর্শ নেবেন। অমৃতলাল বললেন:
"প্রেম ঠিক আসবে কবে?
আরে সবুর! একটু দেরী হবে।
দরকার কি অসময়ে,
হবে সব ঠিক সময়ে -"
বন্ধুটি আবার হতাশ হয়ে পড়ল। আমরা বললাম - 'ঠান্ডা-ঠান্ডা, কুল-কুল'। আর কুল, কেস তখন একবারে টোপাকুল, 'হৃদয়ের একুল-ওকুল দুকুল ভেসে যায়'। ইতিমধ্যে বন্ধুটি ব্যাতাইতলা না নস্করপাড়ায় একজনকে মেসো পাতিয়ে (পড়ুন পটিয়ে) ফেলল, আসল লক্ষ্য মেসোকন্যা, 'কঁহিপে নিগাহে, কঁহিপে নিশানা'।
মেসোর বাড়ীতে যাওয়া আসা শুরু হলো। ডুবে ডুবে জল খেলে কি হবে, জলের উপর ভুড়ভুড়ি রুখবে কে? কলেজে রটে গেলো। বন্ধুটির নাম বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মেনে হয়ে গেল মেসোপটেমিয়া, ব্যাসবাক্য 'মেসোকে পটিয়ে মেয়ে তোলে যে মিয়া'। তবু হার মানলে চলবে কি করে? একদিন মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে মেয়েটিকে বলে ফেললো - 'আমি তোমার'। মেসোকন্যা বন্ধুটির বুকে পেন্সিল হিল গেঁথে গটগট করে 'ডপলার এফেক্ট' হয়ে গেল। তারপর? তার আর পর নাই, নাই কোনো ঠিকানা - 'সে নির্বিকার, তুমি ছারখার'।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.