Monday, July 1, 2013

- ১৭. দশচক্রে প্রথম তিন - নিমাই, দেবু আর বৌদি

 

- ১৭. দশচক্রে প্রথম তিন - নিমাই, দেবু আর বৌদি  

হোস্টেল দশে এসে আমরা একটা অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি হলাম। আগেই বলেছি হোস্টেল সাত থেকে হোস্টেল ষোলোর নকশাগুলো প্রায় একইরকম।

 

######################################

#.০১.#.০২.#.০৩.#.০৪.#.০৫.#.০৬.#.০৭.#.০৮.#.০৯.#.১০.#.১১.#

######################################

...............................#.১২.#===# T #

...............................####====####

 

থেকে ১১ হলো চারশয্যার রুম, মানে মোট শয্যা = X ১১ = ৪৪। ১২ নং রুম হলো পাঁচশয্যার। তার মানে প্রতিতলায় সর্বাধিক ৪৯ জন থাকতে পারে, মানে চারতলা মিলিয়ে মোট শয্যা = ৪৯ X = ১৯৬। এছাড়াও পাঁচতলায় আরো একটি পাঁচশয্যার রুম। অর্থাৎ এক হোস্টেলে সর্বাধিক ২০১ জন ছাত্র থাকতে পারে। তবে সাধারনতঃ সব'তলায় 'নম্বর রুমে একটা করে ক্যান্টিন চালু থাকতো। এগুলো চালাতো মেস ষ্টাফেরাই, সকালের আর বিকেলের টিফিনের জন্যে। পাওয়া যেত ডিম টোস্ট, ঘুগনি, পুরি সবজি,  সিগারেট, চা ইত্যাদি। এছাড়াও একটা ১২ নং রুম, সাধারনতঃ দোতলারটা রিডিং রুম হিসেবে ব্যবহার হতো, থাকতো কিছু ম্যাগাজিন, দৈনিক সংবাদপত্র। আর একটা পাঁচতলার রুম ব্যবহার হতো টিভি রুম হিসেবে। অর্থাৎ আদপে (৪০ X ) + ( X ) = ১৭৫ জনের উপযোগী; এর মধ্যেও সিনিয়াররা দুই বা তিনজন একটা রূমে থাকতো। তবে আবার একতলায় একটা গেমসরুম ছাড়াও তিন চারটে চারশয্যার রুম। এসব ধরে বলা যেতে পারে হোস্টেলগুলো কমপক্ষে ১০০-১২০ জন ছাত্র থাকা উচিত, যাতে মেস ফি নিয়ন্ত্রণে থাকে।

 

আমাদের সময় প্রতিমাসে মেস ফি থাকতো ৪০০ থেকে ৫০০- মধ্যে। যদিও কয়েকটা হোস্টেলে একটু কমবেশী হতো, আবাসিকদের চাহিদার উপড় নির্ভর করে। সারা বছর যা কিছু উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি থাকতো তা শেষ দুয়েকটা মাসের হিসেবে জুড়ে দেওয়া হতো তাই মেস ম্যানেজারের কাজটা খুব সহজ ছিলো না। প্রতি সপ্তাহে খরচের হিসেব করা, সপ্তাহান্তে কজন আছে আর কজন বাড়ি গেছে মেস স্টাফেদের কাছ থেকে তার হিসেব নিয়ে সেইমত রেশন ঠিক করা; মেনু ঠিক করা; মাছ, মাংস, ডিম, নিরামিষের সংখ্যা এমনভাবে বিন্যস্ত করা যাতে মেস ফি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং আবাসিকরাও সন্তুষ্ট থাকে। মেনু খারাপ হলে বা ডিম আর নিরামিষের সংখ্যা একটু বেশী হলেই আবাসিকরা ঝামেলা করতো। আবার মাসের শেষে ঘাটতি বেশী হলেও আরেক বাওআলি। অনেক সময় আমার মতো মেস ম্যানেজাররা উপায় না থাকলে শুক্রুবার রাত থেকে তিনটে মিল নিরামিষ বা ডিম করে দিয়ে বাড়ি চলে যেতো। আর এটাও ঠিক করা থাকতো যেন রবিবার দুপুরে খাসির মাংস হয়, যাতে রবিবার সন্ধ্যের সময় যখন বাড়ি থেকে আসতাম তখন গালি না খেতে হয়। আবাসিকের সংখ্যা যাইহোক না কেন, মেস চালু রাখলেই প্রতিবেলায় যোগ হতো ১৭-১৮ জন মেসষ্টাফের হিসেব, তাই আবাসিকের সংখ্যা খুব কম হয়ে গেলে সেইবেলা মেস বন্ধও রাখা হতো।

 

এবার ফিরে আসি হোস্টেল দশের সমস্যায়। ১৯৯৫-এর শিক্ষাবর্ষে কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেয়, হোস্টেল ১৪, ১৫ ১৬- থাকবে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা। হোস্টেল , - থাকবে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। সবকটি হলে সমস্ত চতুর্থবর্ষের ছাত্রের জায়গা হবার পর, বাকি ঘরগুলোতে তৃতীয় বর্ষের যতজনকে সম্ভব জায়গা করে দেওয়া হয়। বাকি তৃতীয়বর্ষের জন্যে নির্ধারিত হয় হোস্টেল ১০ ১১। অনেক আগে থেকেই হোস্টেল ১২ বা প্রতীচী অধ্যাপকদের বাসস্থান। আর পুরোনো ছাত্রীনিবাস বা হোস্টেল ১৩ তখনো ফাঁকা, যার কয়েকটি ঘরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অফিস চলে। ডাউনিং- বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস; স্লেটারে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের অফিস; হিটনে হাসপাতাল, এনসিসি ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক।

 

সব অ্যালটমেন্ট হয়ে যাবার পর দেখা গেল হোস্টেল দশে মাত্র চল্লিশজন আবাসিক। এর মধ্যে দুজন একদম গরিবঘর থেকে বলে, তাদের মেস ফির অনেকটাই অনুমত্যানুসারে মকুব করা। তার উপড় আঠারোজন মেস স্টাফ। সর্বনাশ মেস চলবে কি করে? চালাতে গেলে তো মেস ফি কমসে কম ৮০০ থেকে ৯০০ হবেই প্রতিমাসে। কঠিন কাজ সামলানোর জন্য আবাসিকদের একটা জরুরি মিটিং হলো। আমি আবার হলাম এক মাসের মেস ম্যানেজার আর মেস কমিটির সদস্য। সব আবাসিক রাজি হলো মেস ম্যানেজারদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করার। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কলেজের মেসবিভাগ হোস্টেল সুপারের কাছে দরবার করা হলো। অবশেষে স্নাতকোত্তর (P.G.) পাঠক্রমের পড়াশোনা করতে আসা কয়েকজনকে রাখা হলো হোস্টেল দশে। প্রথম শেষবারের মতো  স্নাতকোত্তর আর স্নাতক-এর ছাত্ররা এক হোস্টেলে। আমাদের মেস ফির কিছুটা সুরাহা হলো আর সেই সুযোগে PG- অনেকজনের সঙ্গে আমাদের কয়েকজনের একটা দারুন সুখস্মৃতি রয়ে গেল। এর মধ্যে বিভাসদা এখন আমাদের কলেজেই পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক।

 

যেহেতু ছেলে খুব কম, সব রুমেই প্রায় দুজন করে। এর মধ্যে কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। আমি আর সৌমিক ছিলাম ৩০৩ নম্বর রুমে। ৩০১- আর সুখময়ের সাথে থাকতো নিমাই চন্দ্র বড়াই। আমরা বলতাম "নিমাই চন্দ্র বাড়াই", তোর নামের প্রথম আর শেষ অক্ষরটা বাদ দিলে কি দাড়াবে বলতো? বেশ মজার ছেলে ছিলো, রাগ করতো না। তবে রাগ করলেও অসুবিধে ছিলো না, সাড়ে চারফুট উচ্চতার আর চল্লিশ কেজি ওজনের ছেলেকে কেই বা ভয় পাবে। যদিও নিমাই খুব দরিদ্র বাড়ির সন্তান ছিলো। বি কলেজে মেকানিকাল নিয়ে পড়তে এসেছিলো যখন, তখন বলা যায় লেখাপড়ায় খুব একটা খারাপ ছিলো না। কিন্তূ ছিলো প্রবল অর্থকষ্ট। আমাদের সেই টানাটানির হস্টেলেও আমরা মেস কমিটির সদস্যরা মিলে চেষ্টা করেছিলাম, যাতে ওর মেস ফি প্রায় পুরোটাই মকুব হয়ে যায়। আমাদের বছর পড়তে এলেও, আমাদের পরের বছর পাশ করে। হাতে টাকা থাকতো না বলে শুধু সপ্তাহ নয়, অনেক মাসের শেষেও বাড়ি যেত না। অনেক সময় খুব দরকারী বই খাতা কিনতেও মুশকিলে পড়ত। হোস্টেল দশেই জানা গেলো নিমাই প্রেমে পড়েছে, প্রিয়ার নাম অসীমা। অসীমা চেষ্টা করেছে নার্সিং ট্রেনিং করে নিজের পায়ে দাড়ানোর, তারপর এক সাথে ঘর বাঁধার। হয়তো এখানে উল্লেখের কোনো কারণ নেই বা  সেটা উচিতও হবে না, কিন্তূ প্রচন্ড অভাবের মধ্যেও দুই খুবই দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ের জীবনসংগ্রাম আর প্রেমকাহিনীকে আমরা মনে মনে কুর্নিশ জানিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে হঠাৎ যোগাযোগ হলো, এখন ক্যামাক স্ট্রিটে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে কর্মরত। ছেলেমেয়ে নিয়ে দুজনে বেশ জমিয়ে সংসার করছে।

 

……………

 

আমার রুমমেট সৌমিক ছাড়াও ইলেকট্রিকালের অনেকেই ছিলো হোস্টেল দশে। ৩০২- থাকতো বিধান আর কল্লোল আর ৪০১- দেবব্রত বিশ্বাস (দেবু) আর অরিন্দম বসু (রুগী) এছাড়াও বিমল বৈদ্য, অনির্বান, সুরজিৎ মিদ্যাসহ বেশ কয়েকজন। এদের অনেকের সঙ্গেই বেশ জমিয়ে আড্ডা মারলেও দেবুর সাথে অনেকসময় একসাথে কেটেছে। সেমেস্টারের শেষে বা লম্বা ছুটির সময় বাড়ি যাবার আগের রাতে হোস্টেলের ছাদে আড্ডা মারতে মারতে রাত কাবার করে দিয়েছি বেশ কয়েকবার। দশের ছাদে পাশ থেকে উঠে এসেছিলো একটা আমগাছ। গরমকালে পাঁচতলার ছাদে উঠে কাঁচা আম পেড়ে নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে খেতে আড্ডা মারতাম। গঙ্গার দিকে তাকালে দেখা যেত হ্যালোজেনের আলোয় ক্রেনের মাথা আর গার্ডেনরিচ শীপ বিল্ডার্সের ডেক।  ওখানেই শোনা দেবুর জীবনে হোস্টেল দশে ঘটা আগের বছরর  সেই ভৌতিক অভিজ্ঞতা, যেটা অনুমতিক্রমে একদম ওর লেখা থেকেই তুলে দিলাম:

 

"আমরা যারা ১৯৯৩ সালে বি কলেজের কারিগরী শিক্ষার প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলাম, ডিমড ইউনিভার্সিটির প্রথম ব্যাচ হওয়ার সুবাদে অনেক সুবিধার সঙ্গে বেশকিছু ঝামেলাও ভোগ করেছিলাম। তখন লিন্গুইস্টিক (TCMN) বলে একটি সাবজেক্ট ছিল। ৫০ নম্বরের পরীক্ষা হত। আমাদের আগের ব্যাচ পর্যন্ত এটি অপশনাল সাবজেক্ট ছিল তাই, ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের মত পাস ফেল প্রথার বাইরে ছিল। শুনেছিলাম, সেইসময় লিন্গুইস্টিক টিচারকে, দেখিয়ে দেখিযে সুখটান দিত আমাদের অনেক সিনিয়রা। সেই সঙ্গে তিন চার অক্ষরের বাছাইকরা শব্দও ছুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল এবং বছর শেষে হাসতে হাসতে ওই সাবজেক্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েও পাশ করা যেত। আমাদের বেলাতে তেমনটি রইল না এবং পাশ করা বাধ্যতা মূলক হয়ে গেল। যাই হোক লিন্গুইস্টিক এর স্যার, তার এত দিনের জমানো রাগের খুব ভালোভাবে শোধ নিল আমাদের ব্যচের উপর দিয়ে। যতদুর মনেপড়ে তিনি সেবার প্রায় ৫০ শতাংশকে সাপ্লিমেন্টারী দিয়েছিলেন। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের (?) মধ্যে একজন ছিলাম, এমন কি প্রথম সাপ্লিমেন্টারীতেও টপকাতে পারিনি এবং ২য বার সাপ্লিমেন্টারী দিয়ে কোনো মতে পাশ করেছিলাম।

 

সম্ভবত দিনটা ১৯৯৫ এর জানুয়ারী, আমার লিন্গুইস্টিক সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষা ছিল। তখন শীতের ছুটিতে হোস্টেলের সবাই বাড়ি চলে গেছে। বাড়ি দুরে হওয়ার জন্য, বাড়ি থেকে বি কলেজে এসে সকাল বেলা পরীক্ষা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কলকাতাতেও থাকার তেমন কোনো আস্তানা ছিল না আমার, অগত্যা আমি হোস্টেল দশ এর রুম নম্বর ৪০৩ এসে উঠলাম। আসার সময় কুলমনিদাকে (হোস্টেল দশ এর কেয়ার টেকার) দেখলাম এক তলায় ওর ঘরে বসে। আমায় জিজ্ঞাসা করলো 'বাবু এখন কেন এসেছেন' আমি বললাম 'কাল আমার পরীক্ষা আছে, আজকের রাতটা থেকে, কাল সকালে পরীক্ষা দিয়ে চলে যাব' কুলমনিদা বলল রাতে ওরা কেয়ার টেকাররা সম্ভবত কোনো একটা জায়গায় সবাই একসঙ্গে থাকে, তাই রাতে হোস্টেল দশ থাকবে না শীতের পড়ন্ত বিকেলে হোস্টেল দশে আবাসিক আমি একা, আর নিচে কুলোমনিদা, গোটা মুচি পাড়ায়ও বোধ হয় আর কেউ ছিলনা সেদিন।

 

হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যে বেলা পুরনো ক্লাস নোট নিয়ে বসলাম। খুব সিরিয়াস, এবার যে করেই হোক লিন্গুইস্টিক পাশ করতে হবে, না হলে আবার ফার্স্টইয়ার? না না, পাশ করার তীব্র তাড়নায় অথবা আবার ফেল করার দুর্ভাবনায় আমার তখন খুব বিচ্ছিরী অবস্থা। পরীক্ষার প্রস্তুতির শুরু হিসাবে তাই পুরনো ক্লাস নোটে চোখ বোলাতে লাগলাম। বৃথা চেষ্টা, কিছুই মগজে ঢুকছিলনা। উঠে বেরিয়ে গেলাম খেতে। বি কলেজ বন্ধ থাকলে, সেকেন্ড গেট এর খাবারের দোকানগুলি সাধারণত খোলা থাকত না, সেদিনও বেরিয়ে দেখি খাওয়ার দোকান প্রায় সব দোকান বন্ধ, আন্দুল রোড এর পাঞ্জাবী ধাবাতে গিয়ে খেতে বসলাম। চারপাশের ছোট ছোট গ্লাস থেকে দেশী পানীয়ের গন্ধে গোটা ধাবা করছে। মনে হলো আমি অড ম্যান আউট। রুটি তড়কা খেয়ে, একটি goldflake ধরিয়ে টানতে টানতে ফিরছিলাম। সেকেন্ড গেট দিয়ে যখন ঢুকলাম দেখি রাস্তাগুলি শুনসান, কেউ কোথাও নেই, খালি ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুলমনিদার ঘর পেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ঘরে একটি কেরোসিন এর ল্যাম্প জ্বলছে। তার মানে লোডশেডিং। অন্ধকার সিড়ি ভেঙ্গে তলায় আমার ঘরে ঢুকলাম।এরই মধ্যে সম্ভবত কারেন্ট এসে গেছিল, ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে আবার লিন্গুইস্টিক এর খাতাটি টেনে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলাম।

 

আমার ঘরের জানলার পাশে একটি আমগাছ ছিল। তার শাখা প্রশাখা, আমার চারতলার জানলার আশপাশ ছাড়িয়ে ছাঁদ পর্যন্ত উঠে গেছিল। দিনের বেলা ছায়া পড়ত আমার জানলায়, এখন অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। পছন্দের বিষয় না হলে পড়াতে মন বসানো খুব কঠিন কাজ, আর সেই কঠিন কাজটিই আমার সামনে। দুতিনটে প্রশ্ন রিডিং দিয়েছি সবে, আবার টয়লেট পেল। ঘরের দরজা খুলে টয়লেটে গেলাম। আসার সময় মনের মধ্যে কেমন একটা করে উঠলো তাকিয়ে দেখি, করিডোর অন্ধকারময়, শুধু আমার দরজার ফাঁক দিয়ে আলো পড়েছে বারান্দায়। পিছনে তাকিয়ে করিডোরের অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বয়ে আসা ঠান্ডা হওয়ার দমক অনুভূব করলাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। কোনো মতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, বাকি যতগুলি আলো ছিল, একে একে সব জ্বেলে দিলাম। যেন ঘরের আলো জ্বেলে মনের সাহস বাড়ানোর চেষ্টা। কিছুতেই পড়ায় মন বসছিল না। একবার বোধ হলো আমার জানলার পাশ দিয়ে কার্নিশ বেয়ে কে যেন এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেল। দেখার চেষ্টা করলাম, বাইরে কিছুই চোখে পড়ল না। তবুও জানলাটি আরও ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে আবার টেবিলে এসে বসলাম। এবার খাতার দিকে চেয়ে রইলাম বটে, কিন্তু মন তখন জানলার কাঁচে। আবারও কেউ ওপাশ থেকে এপাশে চলে এল কার্নিশে বেয়ে, খস খস করে শব্দ করে। এতক্ষণে একটু ভয় ভয় করল। খেয়াল হলো টেবিল ল্যাম্পটি এখনো জ্বালানো হয়নি। তাড়াতাড়ি টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে, লাইট এর ফোকাস জানলার দিকে করে রাখলাম, যাতে কিছু হলেই চোখে পড়ে। আর টেবিলের সামনে নয়, খাটের ঠিক মাঝামাঝি দেয়ালে বালিশ রেখে, হেলান দিয়ে বসলাম। রাত তখন প্রায় ১০ টা, মনে পড়ল কুলমনিদা বলেছিল, ১০ টার দিকে ওরা সবাই খেয়ে কোথাও একটা ঘুমিয়ে পড়ে। হোস্টেল দশে সে নেই, তার মানে আমি এখন একা। এত বড় মুচিপাড়ার কোনো হোস্টেলে আর কেউ কোথাও নেই। কেমন একটা শব্দ আসছিল নিচে থেকে, মনে হল কারা যেন সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে আসছে, আরো একটু পরে, ঠিক চার তলার কাছে এসে শব্দটি মিলিয়ে গেল। এবার বেশ ভয় ভয় করতে লাগলো। মনে পড়ল সিনিয়রদের কাছে শুনেছিলাম শীতের ছুটিতে অনেক সময় ড্রাগ এর কারবারীরা বি কলেজে এর ক্যাম্পাসে ঢুকে রাতে নিরাপদে কারবার করে ফিরে যায়।

 

কয়েকজনের পা টিপে টিপে আসার শব্দ পাচ্ছিলাম। আমার ঘরের আলো দেখে হয়ত সাবধানী হতে চাইছে ওরা। আমার কি করা উচিত? অবস্থা তখন সঙ্গীন। একবার জানালার দিকে আর একবার দরজার দিকে দেখছি। সামনে খাতা খোলা থাকলেও পড়ার মত মনের অবস্থা নেই তখন। কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। আবার টয়লেট পেয়েছে। দরজাটি একটু ফাঁকা করে এদিক ওদিকে চেয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। দ্রুত পায়ে টয়লেটে গিয়ে দাড়িয়েছি, খেয়াল হলো টয়লেটের আলো জ্বলছে না। আগের বার ব্যাপারটা চোখে পড়েনি। বাথরুম করার সময় অনুভূত হলো কেউ যেন আমার পিছনে দাড়িয়ে আছে। আমি তার নিশ্বাসও অনুভব করলামএই বুঝি সে অমার কাধে হাত রাখবে, আর আমি জ্ঞান হারাব। টয়লেট করা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এক দৌড়ে করিডোর পেরিয়ে ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকানি তুলে তবে ধড়ে প্রাণ এলো। সময় এর সাথে সাথে পায়ের আওয়াজ এর স্থান পরিবর্তন হচ্ছিল, রাত তখন প্রায় ১২ টা বাজে, ছাদের উপর দিয়ে কারা হাঁটছে? হোস্টেলের ছাদে রাখা কুচো পাথরের উপর পা ফেলার আওয়াজ পাচ্ছি। ওরা ফিস ফিস করে কিছু বলছে। কিন্তূ কারা ওরা?

 

আমি গ্রামের ছেলে তাই রাতে বে-রাতে নির্জন মেঠো পথে বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এমন অনেকবার হয়েছে, যে পিছনে পিছনে কে যেন আসত। প্রতি পদে তার পায়ের আওয়াজ পেতাম, যা কিনা আসলে শুকনো বাঁশ পাতার উপর থেকে পা উঠিয়ে নেওয়ার পরে হয়। তেমনি ছাঁদের উপরের পায়ের শব্দও হয়ত আসলে আমগাছের ডালপাতা ছাদের কুচো পাথরে ঘষা খেয়ে অমন আওয়াজ। এই ভেবে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করলাম নি:সহায় মন তখন যুক্তি তর্ক করতে করতে ক্লান্ত। কিছুতেই নিজের কান, চোখ, মনের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পরছিলাম না। আত্ববিশ্বাস তখন তলানিতে। মনে পড়ছিল হোস্টেল থেকে একটি ছেলে কোমরের গামছায় আগুন ধরিয়ে ঝাপ মেরেছিল। উল্ফেনডেন এর একটি ঘরে কে যেন গলায় দড়ি দিয়েছিল। তাকে ওই ঘরে মাঝে মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছে কেউ কেউ। মনে পড়ছিল বিদিশা ঝিল এর শোনা কাহিনীও। এতদিনের শোনা সব অশরীরী গল্পরা তখন আমার চোখে জীবন্ত হতে চাইছিল, আর আমি আমার সমস্ত বোধশক্তি দিয়ে তাদের শোনা কাহিনীতেই আবদ্ধ করতে ব্যস্ত। তারই মাঝে আমার চোখ কখনো জানালাতে কখনো দরজার দিকে। কানে যেসব অদ্ভুত শব্দ আসছিল, মন অনবরত তার বিশ্লেষণ করে চলেছে।

 

আমি আর পারছিলাম না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত তখন টো। আমার জীবনীশক্তি যেন ফুরিয়ে এসেছে। মনে হলো এই রাত আমার জীবনের শেষ রাত। রাতের ভোর আর আমার ভাগ্যে নেই। মার মুখটা যেন চোখের সামনে ভাসছিল। মা বলেছিল ভোর টের সময় বেরিয়ে ফার্স্ট ট্রেন ধরে কলেজে এসে পরীক্ষা দিতে। কিন্তূ বনগা লোকাল এর উপর কোনদিনই কোনো ভরসা করা চলেনা। তাছাড়া এটাই আমার লাস্ট সাপ্লিমেন্টারী তাই আমিও ঝুকি নিতে চাইনি।

 

সমস্ত অশরীরীরা মনে হলো আমার ঘরের আশেপাশে ঘুরছে ফিরছে, তাদের উপস্থিতি আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেতে পারছি। তাদের ছায়া মূর্তি আমার জানলার কাঁচের মধ্যে দিয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে এক্ষুনি এই ঘরে প্রবেশ করবে। যেকোন মুহুর্তে ওরা আমকে স্পর্শ করলেই আমি মরে যাব। তবুও আমি যে আমার সমস্ত জীবনী শক্তি দিয়ে এই অসহায় অবস্থায় লড়াই করতে করতে এতক্ষণ বেঁচেছিলাম, সেটা কি করে জানাব সকলকে? কি করে আগামী কালকের বেঁচে থাকা মানুষদের, আমার পরিবারের লোককে জানাব যে আমি এত সহজে হেরে যাইনি? এই ভাবছি তখন। অথচ এক লাইনের একটি চিঠি লিখব ততটুকু শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। আচমকা মনে এলো রাত ১২ টা পার হয়ে গেছে তাই পরদিনের তারিখে ক্যালেন্ডার লালকালি দিয়ে নিজের সই করে, নিচে সময়টি লিখে দিলাম "রাত .৩০" তারপর? কি হয়েছিল সত্যিই জানিনা। জ্ঞান হারিয়েছিলাম কিনা তাও মনে নেই। শুধু পরদিন ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি, আমি বেঁচে আছি তাকিয়ে দেখি ঘড়িতে সকাল টা। আর একমুহুর্ত্ত দেরি করিনি। মুখ ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে সোজা পরীক্ষার হলে। সেদিন হোস্টেলে স্নানও করিনি।

 

এর পর থেকে আর কোনও দিন হোস্টেল এর চারতলায় কোনো বাল্ব ফিউজ হয়ে পড়ে থাকত না। আমি ঠিক পাল্টে দিতাম। কুলমনিদা কখনো কখনো অতিষ্ট হয়ে যেত আমার জন্য। কিন্তু চারতলার করিডোরের বা টয়লেটের আলো ঠিক জ্বালিয়ে রাখতাম। জন্য কেউ কেউ আমাকে চারতালার কেয়ার টেকার ভাবত। এতদিন পরেও সেই ভয়ের রাত আজও আমি ভুলতে পারিনি, মনে পড়লে গা শিউরে উঠে।"

 

………………

 

অনির্বান ছিলো বর্ধমানে ছেলে, ইলেকট্রিকাল পড়তে এসেছিলো। মায়ের হাত ধরে উচ্চমাধ্যমিক দিতে যাওয়া মেধাবী কিন্তূ নিরীহ ছেলেটি কোনোদিনই কলেজের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেনি। বা বলা যেতে পারে এই রকম ন্যাকা এবং ভীতু ছেলে আমি খুব একটা দেখিনি। আমরা কারনে অকারনে ওর পিছনে লাগতাম, কলেজের ডাকনাম ছিলো বৌদি। প্রথমে দশের একতলায় থাকতো একটা রুমে। আমাদের কাজ না থাকলে বা সময় না কাটলে মনে হতো, চল বৌদিকে একটু বাওআল দিয়ে আসি একদিন ওর রুমে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অর পিছনে লাগায় রেগে উঠে বললো, "দেখো তোমরা কিন্তূ খুব বাজে কাজ করছো। আমি এবার খিস্তি দেব" একটু সখী গোছের হাবভাব আর আমাদেরও 'তুই' না বলে 'তুমি' বলতো।

 

আমরা মজা পেলাম, দারুন ব্যাপার বৌদি খিস্তি দেবে। আমরা বললাম আগে বল খিস্তি কাকে বলে, খিস্তির সংজ্ঞা কি? বলতে না পারায় আমরাই ব্যাখ্যা করলাম, "ক্রোধের বশে কারোর মুখ নিসৃত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ অন্য কারোর উদ্দেশ্যে বলা হলেও, সেই ব্যক্তি ছাড়াও তার উর্ধতন কয়েক পুরুষ সম্বন্ধে অশ্লীল ইঙ্গিত করা হয় এবং যা বলার পর বক্তা মনে মনে এক পরম তৃপ্তি লাভ করে যাতে তার নিজের ক্রোধ অনেকটা প্রশমিত হয়, তাকেই খিস্তি বলে" এরকম ব্যাখ্যা  শুনে বৌদি চমকে গেলো। আমরা বললাম দে এবার একটা খিস্তি, আমাদেরও মনে থাকবে তোর কাছে খিস্তি শুনেছিলাম। বৌদি ঘরটায় একটু পায়চারী করে, দুহাত মুঠো করে, একমুখ হাওয়া ভরে, নাক ফুলিয়ে যে খিস্তিগুলো দিয়েছিলো তা আজও মনে আছে। বলেছিলো, "তোমরা এক একটা আরশোলা, তোমরা ছুঁচো, ব্যাঙ্গমা" পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এইরকম খিস্তি শুনে আমাদের রাগ হয়েছিলো না হাসি পেয়েছিলো।

 

বৌদির সব কান্ডকারখানা লিখতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। দোলের সময় মেসে সিদ্ধির সরবত হতো। থার্ড ইয়ারে দশে সরবত বানানো হচ্ছে আর সবাইকে ডেকে ডেকে দেওয়া হচ্ছে। বৌদি আমার কাছে জানতে চায়, "শোনো পার্থ প্রতিম, এতে কি নেশা হয়" আমি বলেছিলাম, "এতে বাচ্ছা ছেলের নেশা হবারও কথা নয়। তবে তুই তো শিশু, তাই এক গ্লাস খা" সেই এক গ্লাস সিদ্ধি খেয়ে বৌদি উল্ফেডেনে এক সিনিয়ারের রুমে ঢুকে বমি করে আউট হয়ে গিয়েছিলো। তারপর নাকি এক গ্লাস সিদ্ধির নেশা কেটেছিলো পাক্কা দুদিন পর। এই দুদিন শুধু মড়ার মতো ঘুমাতো, সেই ঘুম ঠিক খাবার সময় ভেঙ্গে যেত। উঠে একচোট হাসতো, তারপর সেই সিনিয়ারের সাথে গিয়ে খেয়ে এসে, "দাদা আমার মাথাটা কেমন করছে" বলে ঘুমিয়ে পড়ত। সেই সিনিয়ার দুদিন অন্যের ঘরে ঘুমিয়ে বৌদিকে কোনোরকমে বিদায় করে ঝাড়ুদার ডেকে ঘর পরিষ্কার করিয়েছিলো। সে'কদিন আমার নামে খুব বদনাম রটেছিলো, কারন আমি নাকি বৌদিকে নেশা করিয়ে দিয়েছিলাম। কথাটা বাড়ি গিয়েও বলেছিলো, আর বর্ধমানে কাকু, মানে বৌদির বাবা একদিন আমার বাবাকে পেয়ে এই নিয়ে নালিশ করেছিলো। শুনে খুব রাগ হয়েছিলো। পরে তার একটা শোধও তুলেছিলাম।

 

হোস্টেল দশে যেহেতু আবাসিক খুব কম, তাই কিছু ঘর ফাঁকাই পরে থাকতো। বৌদির কান্ডকারখানা দেখে ওর অতি শান্ত রুমমেটও বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। বৌদি মাঝে মাঝে রুমে তালা মেরে কোথাও চলে যায়, রুমমেট বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা তখন সেকেন্ড গেট থেকে খাবার জল বয়ে আনতাম। বৌদির রুমমেট জল আনতো, আর বৌদি "আমার মা ভারী জিনিস তুলতে বারণ করেছে" অজুহাত দিয়ে সেই জল খেত। অবশেষে রুমমেটের বাওআলে বৌদি রুম বদল করে আমাদের ফ্লোরে মানে তিনতলায় এসে হাজির হলো। মনে হয় বিভাসদার সাথে ৩০৫ নং রুমে। শুধু নিজের ট্র্যাঙ্ক আর বিছানা নিয়ে উপরে আসতে হবে, তাতেও দেখা গেলো বৌদির বাবা এসে হাজির। যেন ছেলে প্রথম কলেজে পড়তে এসেছে। আমরাও তাল খুঁজছিলাম। বিভাসদাকে চুপিচুপি ডেকে নিয়ে এলাম আমাদের রুমে। দশের দরজাগুলো ছিলো কাঠের দুপাল্লা প্যানেল দরজা আর উপরের প্যানেলে কাঁচ লাগানো। করিডরের আলো নিভিয়ে দিয়ে ৩০৫-এর ভেজানো দরজায় জোরে লাথি মেরে দৌড়ে ঢুকে পরলাম নিজেদের রুমে। এরকম চললো কিছুক্ষণ। একটু পরে কিছু জানেনা এমনভাব দেখিয়ে বিভাসদা ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ, উপরের কাঁচের প্যানেল দিয়ে দেখা গেলো বৌদি আর ওর বাবা ভয় পেয়ে পা গুটিয়ে খাটের উপড় বসে আছে দরজার দিকে তাকিয়ে।

 

আরো অনেকে জড়ো হয়েছে মজা দেখতে। আমি আর সৌমিক জোগাড় করলাম কিছু কালিফটকার ছররা। একটা ধুপ দিয়ে জ্বালিয়ে দরজার নিচে দিয়ে ছুড়ে দেওয়া হলো। দুমদাম শব্দে ঘরের মধ্যে চতুর্দিকে ফাটছে ফটকাগুলো আর অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁচের প্যানেল দিয়ে দেখলাম, বাবা ছেলে টিনের খাটের উপড় উঠে দুহাত তুলে তান্ডব নৃত্য জুড়েছে। হেসে পেট ফেটে যাবার জোগাড়। তারপর সব চুপচাপ, অনেক হয়েছে।

 

তবু রাতে দেখা গেলো নটার মধ্যেই মেসে খাবার খেয়ে দুজনে ৩০৫- এসে বিছানা পেতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। ভালোমানুষ বিভাসদা খুব অস্বস্তিতে পড়েছে। নতুন অতিথি তার বাবা যেন গ্রাহ্যই করতে চায় না ঘরে আগে থেকেই একজন আবাসিক আছে। আমাদের সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেলো। আমি আর কল্লোল মাথায় গামছা বেঁধে নেমে পড়লাম কার্নিশে। একগাদা ধুপ জ্বেলে সেগুলো ঘোরাতে শুরু করলাম ৩০৫-এর জানলার নিচেই। আর পাশের খালি থাকা ৩০৬ নং রুমে দরজা বন্ধ করে কজন প্রবল আবেগে বাজাতে শুরু করলো খানকয় টিনের ভাঙ্গা টেবিল। তার সাথে বাইরে মেন সুইচ বন্ধ করে, শুরু হলো অন্যদের নাকিসুরে আওয়াজ, "বৌদি তোঁর ঘাঁড় মঁটকাঁবো", "বৌদি  তোঁর সাঁথে কেঁ রেঁ" ইত্যাদি। ভিতরে পিতাপুত্র এই ভৌতিক পরিবেশে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে। একটু পরে আমরা নিচে খেতে চলে গেলাম। খেয়ে উপড়ে আসছি, দেখি দুটো সুটকেস নিয়ে বৌদি ওর বাবার সাথে দুদ্দাড় করে দৌড়চ্ছে সেকেন্ড গেটের দিকে। শেষ সিটিসি ধরবে বলে। এরপর আমরা যখন কলেজে সেরকম এক দুপুরে, স্পেশাল পারমিশান নিয়ে বৌদি হোস্টেল ছেড়ে ম্যাকডোনাল্ড হলের একটা ফাঁকা থাকা ঘরে গিয়ে ওঠে।

 

বৌদির আরো অনেক কাহিনী আছে। একবার বৌদি আর বৌদির বাবা কলেজ থেকে ফার্স্ট গেটের দিকে যাচ্ছে, পিছন থেকে ছেলের দল ডাক দিলো "বৌদি" বৌদি কোনো সাড়া দিলো না, কিন্তূ ওর বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিলো। সেই থেকে রটে গেলো বৌদির বাবার নাকি ওনাঁর কলেজজীবনেও নাম ছিলো "বৌদি" অনেক মেধাবী ছাত্র বি কলেজে এসে সাপলি পেয়েছে বা ফেল করেছে। বৌদিও তার ব্যতিক্রম নয়। শেষ সেমেস্টারে কোনো চাকরি পায়নি, আর কয়েকটা বিষয়ে সাপলি পেয়েছিলো। সেগুলোয় পাশ করে বেরোতে আরো ছমাস কেটে গিয়েছিলো। তখন আমি পাশ করে রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স বলে একটা কোম্পানিতে কাজ করি। রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার্সে আমার সহকর্মী সিনিয়ার ছিলেন অমিতদা। আমাদের কলেজ থেকেই মেকানিকাল পাশ করেন ১৯৮৯ সালে। পরে উনি বি কলেজে ফলিত যন্ত্রবিজ্ঞান (Applied Mechanics) বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। কাছেই থাকতাম বলে মাঝে মাঝেই কলেজে যেতাম।

 

সেটা প্রায় ১৯৯৮ সাল। একদিন অমিতদার কাছে দেখা করতে গেছি সেকেন্ড লবির লিফটের পাশে যে ল্যাবরেটরিটা আছে সেখানে। দেখি বৌদি বসে ছিলো, আমাকে আসতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে কেটে পড়লো। আমাকে দেখে অমিতদা এর কারণ জানতে চাইল। সংক্ষেপে কিছুটা বলে বললাম, যাই হোক না কেন, অমিতদা যদি একটা ছোটোখাটো জায়গায় চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে পারে। আমার আশঙ্কা বা ভরসা ছিলো যে, বৌদি নিজের মুরোদে হয়তো কিছু জুটিয়ে উঠতে পারবে না। কিছুদিন পরে অমিতদার সাথে দেখা হতেই বললো, "হ্যাঁরে পার্থ, এটা কি স্যাম্পল" আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে। যা জানলাম তা হলো অমিতদা একটা জায়গায় রেফারেন্স দিয়ে পাঠিয়েওছিলো। কিন্তূ মাস শেষ হবার আগেই তারা অমিতদাকে জানিয়েছে, "মশাই, আপনাকে আমরা একটা পুরষ্কার দেবো এরকম একটা স্যাম্পল পাঠানোর জন্যে। এরকম ন্যাকা ছেলে আমরা জীবনে দেখিনি। দয়া করে ওকে আসতে বারণ করুন।"

 

এরপরেও বৌদি কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেছিলো অমিতদার কাছে। অমিতদাও চাইছিলো ওকে বিদেয় করতে। কয়েকদিন পরে বৌদিকে শেষবার দেখি, আমি ডাক দিলাম খোঁজ নেবার জন্যে। আমাকে দেখে আক্ষরিক অর্থেই দৌড়ে পালিয়ে গেলো, বলতে বলতে "প্লীজ তোমরা আমায় ছেড়ে দাও" আমার খুব রাগ হলো, এতদিন পরেও এরকম কান্ড, তাও আমি যখন ওর উপকার করতে চাইছি! তবে অমিতদা নাকি আমার নাম করে ওকে কিছু বলেছিলো। কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিলো, বোম্বেতে বন্ধুদের পিছনে লাগা সহ্য করতে না পারে একটা ছেলে আত্মহত্যা করেছে। সেদিন আমরা স্বীকার করে নিলাম, আমরাও বৌদির পিছনে প্রায় চার বছর ধরেই লেগেছি। কিন্তূ ভাগ্যিস.........

 

কলেজ জীবনে কেউতো এতো পরিণত হয় না। তবে এটাও ঠিক বৌদিরও মানিয়ে নেবার একটা প্রবল অনীহা ছিলো। শেষ বছর তো যদিও খাতায় কলমে ম্যাকডোনাল্ড হলের আবাসিক ছিলো, কোনোদিন হলেও থাকতো না। রোজ যাওয়া আসা করতো হয় বর্ধমান অথবা কলকাতায় কোনো আত্মীয়র বাড়ি থেকে। শেষ সেমেস্টারেও দেখা গেছে পরীক্ষা মানে, বৌদির বাবা বা মা সঙ্গে আসতো, পরীক্ষার পর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইতো, বাছা পরীক্ষা কেমন হলো। যেনো ক্লাস ফাইভ সিক্সের ছেলে। এখন নাকি প্রকৌশলবিদ্যা ছেড়ে দিয়ে WBCS পরীক্ষা দিয়ে আরামবাগের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক (BDO) এক সহপাঠী নাকি ওকে দেখেছিলো, হাওড়া স্টেশনে। বৌদির ভালো নাম চট করে মনে পড়ছিলো না, তাই একটু পরে যখন ডাক দেয় অনির্বান বলে তার আগেই বৌদি প্রায় ভুত দেখার মতো চমকে উঠে ভীড়ে মিলিয়ে যায়।

 

সম্প্রতি অমিতদাকে জানতে চাই সেদিন ঠিক কি বলেছিলো আমার নাম করে। শুনলাম অমিতদা হাতজোড় করেও ওর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে মুক্তি পায় নি তখন ক্রমাগত একটা 'একটা কাজ দেখে দাও' শুনে সেদিন বলেছিলো "একটা কাজ করবি? ভালোই টাকা পয়সা পাবি" কি কাজ জানতে চাওয়ায় বলেছিলো, "তোকে একটা পিস্তল দেবো মন্দিরতলার একটা দোকানে পৌছে দিতে হবে। আর ওরা তার বদলে একটা ড্রাগসের প্যাকেট দেবে সেটা এনে দিতে হবে" বৌদি চমকে উঠে বলেছিলো, "কিন্তূ  এতো খুব রিক্স। আমি এই কাজ করবো? আর পুলিশ ধরলে?" অমিতদা নির্বিকারভাবে বলেছিলো, "দেখ আমাদের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড দল আছে। পার্থও এর সাথে যুক্ত। আর পুলিশ তোকে ধরবে না। কারণ তোকে ধরলেও বা তুই আমাদের নাম করলেও প্রমান করা যাবে না। তাই সেরকম পুলিশ হলে টাকা পয়সা দিয়ে কেটে পরবি। আর কড়া পুলিশ হলে হয়তো এনকাউন্টার করে সেকেন্ড ব্রিজের ফ্লাইওভারের নিচে লাশ ফেলে দেবে। এসব একটু আধটু রিক্স তো থাকবেই, তবে ভালো টাকা পাবি।" সেই শুনে বৌদি ঐভাবে পালিয়েছিলো আর কোনো দিন ওইমুখো হয়নি। আমি শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিলাম, তারপর বললাম "ভাগ্যিস বৌদি সত্যি বিশ্বাস করে পুলিশকে গিয়ে আমার আর অমিতদার নাম নালিশ করেনি"

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.