-১২. ভুখা হরতাল
প্রথম বছরের অনেক টুকরো টুকরো ঘটনা বাদ গেলো, যেগুলোর কথা পরের কোনো এক অধ্যায়ে থাকবে। এতদিন ধরে সবকটা হোস্টেলে প্রথমবর্ষ, দ্বিতীয়বর্ষ এবং কিছু তৃতীয়বর্ষের ছাত্র থাকতো। আর সবকটা হলে চতুর্থবর্ষ এবং বাকি তৃতীয়বর্ষের ছাত্র। ছাত্রীদের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। সবাই তখন পান্ডিয়াতে। প্রথম বছরের শেষে কলেজ কর্তৃপক্ষ একটা নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। ডিরেক্টর ছিলেন দৌর্দণ্ড্যপ্রতাপ ডঃ বিমল সেন। বি ই কলেজেরই পুরোনো ছাত্র, আমার দেখা সব থেকে জাঁদরেল ডিরেক্টর, যাঁকে আমরা সবাই একটু ভয়ে ভক্তি করতাম। প্রয়াত ডঃ বিমল সেন ছিলেন বি ই কলেজ ডিমড ইউনিভার্সিটির প্রথম ডাইরেক্টর।
আমাদের প্রথমবর্ষের সময় হোস্টেল ১৬-তে Ragging-এর একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে। এক মুরগিকে সিনিয়ররা Rag করার সময় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে। সেই ফার্স্ট ইয়ারকে চোখে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে কার্নিশের উপর দিয়ে হাঁটানো হয়। সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং হসপিটালে ভর্তি করতে হয়। পরিনামে তার বাড়ির লোক তাকে বাড়ি নিয়ে যায় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের নামে পুলিশে নালিশ করে। এসব ঘটনা কোথা থেকে তখন খবরের কাগজে প্রকাশ হয়ে যায়। সেই নিয়ে হইচই হবার পর বিমল সেন তদন্ত কমিটি তৈরি করেন বিভিন্ন অধ্যাপক এবং কিছু শিক্ষা দপ্তরের লোকজন নিয়ে। সেই কমিটি প্রস্তাব দেয় যে ১৯৯৪ সাল থেকে নতুন ছেলেরা ১৪, ১৫ আর ১৬ নং হোস্টেলে থাকবে। আর আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে মুচিপাড়ার হোস্টেলগুলোতে। সেবার সাহেবপাড়ার তৃতীয় বর্ষের সবাইকে হলে যাবার অনুমোদন বা নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে নাকি Ragging হবে না আর নতুনরা বেশী মন দিয়ে পড়াশুনো করতে পারবে। ভাবটা এমন যেন আমাদের যা বারোটা বাজার বেজে গেছে, নতুন ছেলেরা যেন দারুন তৈরি হয়।
যাইহোক আমরা যথারীতি এই প্রস্তাব মানলাম না, আওয়াজ তুললাম "কর্তৃপক্ষ জবাব দাও"। কিন্তূ কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দিলো না। মুখ্যভূমিকায় আমরা মানে সাহেবপাড়ার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। আমাদের মনটা হু হু করছে। তার দুটো কারণ ছিল, একটা হলো নিজেদের হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হবে। তার থেকেও যেটা বেশী দুঃখের সেটা হলো আমরাই শেষ ব্যাচ যারা Ragged হলাম আর প্রথম ব্যাচ যারা জমিয়ে Ragging করতে পারব না। মনের মধ্যে কতো স্বপ্ন ছিলো কিভাবে নতুন মুরগীদের সাথে আলাপ করবো। শেষ দুঃখটা সমস্ত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের। কেমন যেন বোকা বনে গেলাম ভাব। আমাদের যেন পুরোপুরি বলাৎকার হয়ে গেলো। যাঃ শালা।
যা মনে পরে আমাদের প্রায় ১২৮ জন সদ্য দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রকে আদেশ দেওয়া হয় অবিলম্বে ১৪, ১৫, ১৬ খালি করে মুচিপাড়ার হোস্টেলে চলে যেতে। কিন্তূ আমাদের কেউ সেই আদেশ মানিনি। দুয়েকজন কিন্তূ কিন্তূ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্ট ছিলো ততদিনে নিজেদের হয়ে ওঠা হোস্টেলেই থেকে যাবার। আন্দোলন শুরু হলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ আর ডিরেক্টর মানে ডিরুর নামে স্লোগানে কেঁপে উঠলো কলেজ চত্তর। ডিরুর নিপাত যাবার কামনা করে অনেক পোস্টার পড়লো ফার্স্ট লবি, ইনস্টিটিউট হল আর বকুলতলা জুড়ে। কিন্তূ বিমল সেন কোনোরকম আলাপ আলোচনায় বসতে আগ্রহী ছিলেন না বা বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে চাইছিলেন। সাহেবপাড়ার তৃতীয়বর্ষের ছাত্রদেরও কয়েকজন চলেও গিয়েছিলো নতুন হলে, কিন্তূ অনেকেই একটা আশায় বুক বেঁধে হোস্টেলেই রয়ে গিয়েছিলো আমাদের সাথে।
দ্বিতীয়বর্ষ মানে আমাদের সবার অবিভাগীয় বিষয়গুলো শেষ হয়ে নিজস্ব ডিপার্টমেন্টের বিষয়গুলো শুরু হতো। বেগতিক দেখে বিমল সেন সমস্ত বিভাগীয় প্রধানকে নির্দেশ সব সাহেবপাড়ার দ্বিতীয়বর্ষের ছেলেদের ডেকে বোঝাতে বা বোঝানোর নাম করে একটু ধমকাতে বা চমকাতে। সিভিলের প্রধান তখন ডঃ সুমন দাশগুপ্ত (এস ডি জি)। তিনি ছিলেন সৌম্যদর্শন অমায়িক ভদ্রলোক। আমাদের নিজের ঘরে ডেকে বোঝালেন যে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না মানলে বড় কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে আর আমরা তাড়াতাড়ি অন্য হোস্টেলে চলে গেলে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু করা যাবে। মানে খুব বাস্তবসন্মত অভিমত, কিন্তূ ছাত্রদের আবেগে সেটা খুব একটা দাগ কাটতে পারল না। ইলেকট্রিকালের প্রধান জ্যাকি মানে ডঃ জে কে সেন, সেই বিভাগের ছেলেদের ডেকে হুমকি দিলেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে সবাই নতুন হোস্টেলে চলে না গেলে ডিপার্টমেন্ট থেকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। সব ডিপার্টমেন্টেই এক অবস্থা। এই চাপের মুখে পরে স্বার্থসন্ধানী বা জীবনে উন্নতিলাভে আগ্রহী কিছু ছাত্র বা আমরা যাদের গাঁতু মাল বলতাম তাদের কয়েকজন সেই রাত্রে নতুন হোস্টেলে চলে গেল, যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম।
এরফলে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে ধমক চমক আরো বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো বিভাগীয় প্রধান তো ছেলেদের ডেকে উদুম তোর করেন এবং ভয় দেখান যে আমরা যারা হোস্টেল ছাড়িনি তারা কোনদিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোতে পারবো না বা কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দিশেহারা ছাত্রদের অনুরোধে এবং স্টুডেন্ট সেন্টিমেন্টের স্বার্থে ছাত্র ইউনিয়ন এগিয়ে আসে আমাদের সমর্থনে। তখন ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলো চতুর্থবর্ষ মেকানিকালের ড্যাড মানে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। বেকসু (BECSU) থেকে তিনটে হোস্টেলেই প্রচারাভিযান করা হয় এবং বলা হয় এটা শুধু আমাদের ১২৮ জনের নয় এটা কলেজের সব ছাত্রছাত্রীর অহং-এর প্রশ্ন, এটা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আন্দোলন। কোনো ভয় নেই সবাই আমাদের সাথে আছে।
আমাদের বুকে বল এলো। এই পরিস্থিতিতে হলে বা নতুন হোস্টেলে চলে যাওয়া মুষ্টিমেয় জনগণ আবার নিজের নিজের পুরোনো হোস্টেলে ফিরে এলো - আত্মমর্যাদা অক্ষত রাখতে আর জনগনের কাছে আওয়াজ খেয়ে। তখন ডিরেক্টরের একটা বিজ্ঞপ্তি এলো যাতে বলা হলো, যারা স্থানপরিবর্তন করেনি তাদের সাস্পেন্ড করা হবে। সঙ্গে সঙ্গে বেকসু এর আপত্তি করে চিঠি দিল যে ইউনিয়ন এর প্রতিবাদ করছে। এইভাবে অচলাবস্থা চললো কয়েকদিন। ক্লাস চলছে, যে যার মতো হোস্টেল থেকে ক্লাস করছে। সারা সপ্তাহের পর শুক্রবারে অনেকেই নিজের বাড়ি চলে গেল সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে।
আমাদের লাস্ট পিরিয়ড শেষ হতো বেলা চারটেয়। হঠাৎ সেই শুক্রবার সাড়ে ছ'টা নাগাদ বিমল সেনের অফিস থেকে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি হলো যাতে বলা হলো যারা নতুন হোস্টেলে যায়নি তাদের কলেজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড করা হলো। একসাথে ১২৮ জন সাস্পেণ্ড, মাথায় বাজ পড়ল। মোবাইল, ইন্টারনেট না থাকলেও নিজেদের উদ্বেগে প্রায় সবাই কারো না কারো কাছ থেকে জেনে গেলো এই চরম দুসংবাদ। বাড়িমুখো ছেলের দল পড়িমড়ি করে ফিরে এলো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ততক্ষণে বেকসুর ঘরে মিটিং শুরু হয়ে গেছে। বাম আমলে গুটিকয় কলেজের মধ্যে বি ই কলেজেরও স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ছিলো কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন "ছাত্র পরিষদের" (সিপি) হাতে। বেকসুতে সে বছর ২১টি আসনের সবগুলোতেই ছাত্র পরিষদের প্রতিনিধি। যার মধ্যে ১৮ টি শ্রেণী প্রতিনিধি বা ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ আর ৩টে সাধারণ পদ - সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং কোষাধক্ষ। এছাড়া মূল বিরোধী ছিল বামপন্থী বা মূলতঃ সিপিএমের ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এসএফআই)। আর ছিলো টিমটিম করে বিজেপির অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এভিবিপি), সিপিএমএলের অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন (এআইএসএ) ইত্যাদি।
যদিও আমার ব্যক্তিগত ধারনা তখন যারা ছাত্র পরিষদ করতো তারা যতটা না কংগ্রেসপন্থী ছিলো তার থেকে বেশী ছিলো বামবিদ্বেষী। মানে সচরাচর যা হয় যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের একটা বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী বা ভাবাবেগ কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আবেগ থেকেও অনেকে ছাত্র পরিষদ করতো। সেরকম অনেকে "ছাত্র পরিষদ" করা কারো ওপর ব্যক্তিগত রাগের বশেও এস এফ আই করতো। তবে অনেকেই আবার মন দিয়ে কোনো দলের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে ছাত্ররাজনীতি করতো।
আমার মতো অনেকেই ছিলাম তথাকথিত অরাজনৈতিক, মানে সার্বজনীন সমালোচক। Ragging পিরিয়ডে সিনিয়ারের চাপে এক দল, রুমমেটের আব্দারে অন্য দল আবার ক্লাসে বন্ধুদের পাল্লায় পরে তৃতীয় কোনো দলে ভিড়ে যেতাম। আমি যেমন ১৫ নং হোস্টেলের সিনিয়র মিদ্দ্যার দাবিতে এভিবিপির হয়ে কিছু পোস্টার লিখে দিতাম - Ragging থেকে নিস্তার পাবার জন্যে। কিন্তূ পরে কখনো সিভিলের নীলাঞ্জনের হয়ে সিপির প্রচারে যেতাম আবার রুমমেট সৌমিকের হয়ে যেতাম এসএফআই-এর প্রচারে। আমদের কাছে সিপি ছিল "ছিপি"; এসএফআই ছিলো "এসে-ফ্রাই" আর এআইএসএ ছিলো "আইস্যা"।
যাইহোক ফিরে আসা যাক পরের ঘটনায়। রাত ন'টা নাগাদ স্থির হয় হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করা হবে ফার্স্ট লবিতে। সেইমতো দশ'টা থেকে ড্যাডের নেতৃত্বে শুরু হলো হাঙ্গার স্ট্রাইক মানে ভুখা আন্দোলন। ফার্স্ট লবিতে সার বেঁধে রিলে পদ্ধতিতে চললো অনশন-ধর্মঘট। কেউ কেউ আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্যে অনশন করলো। শনি রবিবার জনগণ কম থাকলেও রবিবার রাত থেকে ফার্স্ট লবিতে ভিড় বাড়তে থাকে। সবাই এসে জড়ো হয় বকুলতলার আশেপাশে, ক্যান্টিনে আর ফার্স্ট লবিতে। প্রথমদিকে ব্যাপারটা পুরোপুরি অরাজনৈতিক ছিলো। দলাদলি ভুলে সবাই একসাথেই ছিলো এক দাবিতে যে এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করতেই হবে। যতদুর মনে পরে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনশনে বসে ১৭ জন আর তারসাথে প্রায় ৪০ জন শুরু করে রিলে পদ্ধতিতে। কিছুজনকে রাখা হয় অনশনের বাইরে, প্রধানত প্রশাসনিক বা অন্যান্য কাজের জন্য। আমি ছিলাম অক্ষম বা বিকলাঙ্গদের দলে। সদ্য জন্ডিস থেকে উঠেছি বলে হাঙ্গার স্ট্রাইকে যোগ দেবার অধিকার ছিলো না।
পরে দেখা যায় রিলে সিস্টেমটা খোরাক হয়ে গেছে। কেউ প্রাতরাশ সেরে এসে অনশন করছে মধ্যাহ্নভোজ পর্যন্ত্য; আর একজন মধ্যাহ্নভোজ সেরে এসে বসছে বিকেলের জলখাবার পর্যন্ত্য; এইভাবে কেউ বিকেলের টিফিন খেয়ে রাতের খাবার আগে পর্যন্ত্য বা কেউ ডিনার করে এসে পরদিন ভোরবেলা পর্যন্ত্য। তাই তিনদিনের মাথায় রিলে সিস্টেমে অনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনশনে বসা ১৭ জনের মধ্যে আস্তে আস্তে কয়েকজন প্রত্যাহার করে নেয় শরীর খারাপ হয়ে যাবার কারণে। এছাড়াও বাড়ি থেকে চাপ আসায় অনেকে অনশন প্রত্যাহার করে।
ক্লাস চালু ছিল, কিন্তূ অনেকেই ক্লাসে যেতাম না। ফার্স্ট লবিতে যোগ দিতাম অনশনরত বন্ধু বা সিনিয়ার দাদাদের সাথে। আড্ডা মারতাম, রাত বাড়লে একটু তাস খেলাও হতো। আর কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে সন্ধ্যের পর ফার্স্ট লবিতে সতরঞ্জির উপড় শুয়ে বসে নির্দ্বিধায় সুখটান দিতাম। সিগারেট আমাদের কাছে তখন বেশ দামি জিনিস। মানে শুধু স্বাস্থ্যের জন্য নয় পকেটের জন্যেও ক্ষতিকর। তাই আমরা বিড়ি টানতাম। একটা বিড়ি চার-পাঁচজন মিলে। আর একটা সিগারেট জুটলে তো কথাই নেই। আট দশজন ভাগ করে টান দিতাম। এমন হয়েছে কেউ হঠাত ফেলে দিয়েছে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটা সিগারেট, আগুন জ্বলতে জ্বলতে চলে এসেছে প্রায় ফিল্টারের কাছে, সেটাই তুলে নিয়ে দু-তিনজন একটান করে ফুঁকে নিলো।
তখন মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাগজে বি ই কলেজের খবর আর ছবি বের হচ্ছে। একদিন হঠাৎ আমার এক পিসতুতো দাদা এসে হাজির। তাড়াতাড়ি বিড়িটা লুকিয়ে পাশের জনের হাতে চালান করে উঠে এলাম। শুনলাম সেইদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে একটা কলেজের ছবি বেড়িয়েছে, তাতে দেখা গেছে আমিও নাকি 'অনশনে' বসে আছি। তখন খবর নেওয়ার উপায় বেশী না থাকায় বর্দ্ধমান থেকে দাদাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে ঘাড় ধরে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে। এরকম ঘটনা অনেকের সাথেই ঘটেছে। যাই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দাদাকে ফেরত পাঠানো হলো।
এই সময় হোস্টেল ১৪, ১৫ আর ১৬-র মেস সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক মনে নেই সেটা আমরা করেছিলাম না কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হয়েছিলো। তারপর অনেক হোস্টেল, হল এমনকি পান্ডিয়াতেও একবেলা করে মেস বন্ধ রাখা হতো এই আন্দোলনের সমর্থনে। এর মধ্যে হোস্টেল ১৪, ১৫ আর ১৬-তে চালু হলো সমান্তরাল মেস সিস্টেম। একটা স্থানীয় ক্যাটারার বড় বড় গামলা করে খাবার নিয়ে আসতো আর মেস বন্ধ বলে দোতলার কমনরুমে পরিবেশন করতো। আমরা নিজেরাও হাত লাগাতাম পরিবেশন আর পরিষ্কারের কাজে।
এছাড়া এই সময় আরো বেশী করে আমাদের জীবনে দাগ কাটে শ্যামদার হোটেল। ফার্স্ট গেট থেকে ব্যাতাইতলার দিকে একটু এগিয়ে গেলেই একটা গোডাউন পড়তো আর একটা নয়নজুলি বা বড় নালা। তারপাশেই শ্যামদার হোটেল। তখন ছ'টাকায় নিরামিশ ভাত। নুন, লেবু, ভাত, ডাল, তরকারির সাথে ফাউ থাকতো পোস্ত দিয়ে আলুভাজা বা শুকনো লঙ্কা আর পিঁয়াজভাজা দিয়ে মাখা আলুভাতে - শ্যামদার ভাষায় 'স্মাসদ পটেটো'। সাতটাকায় ডিমভাত, আটটাকায় মাছভাত আর দশটাকায় দুপিস ছোটো ছোটো মুরগির টুকরো, একটা আলু আর অঢেল ঝোল। আমাদের অনশন আর মেস বন্ধ। শ্যামদার হোটেল রমরমিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে শ্যামদা বেশী লাভ হলে, আমাদের বোনাস দিত। বাঁধা খদ্দেরদের পাতে পড়ত ছোটো ছোটো একপিস করে বেগুনভাজা বা দু-তিনটে মোরলা মাছভাজা। আহা, তখন কি অমৃত মনে হতো।
চারটে টেবিল, এক একটায় চারজনের বসার কথা, কিন্তূ আমরা গাদাগাদি করে বসতাম ছ-সাতজন। পায়ের পাশ দিয়ে ইঁদুর আর টেবিল দিয়ে আরশোলারা পাশ কাটিয়ে পালাতো। মাঝে মাঝে পাশের মিষ্টির দোকান থেকে দেড়টাকা দিয়ে পঞ্চাশ গ্রাম দই কিনে নিয়ে এসে স্পেশাল লাঞ্চ বা ডিনার হতো। শ্যামদার সাথে থাকতো তার দুই ছেলে আর একটা হাবাগোবা পরিষ্কারের ছেলে। ২০১১ সালে একদিন কোলেজ যাবার পথেও দেখেছিলাম সেই আদি ও অকৃত্যিম শ্যামদাকে। পড়নে সেই অর্দ্ধেক গুটিয়ে পড়া মেটে কমলা রঙের লুঙ্গি আর হাতওলা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা শ্যামদার সেই এক পোষাক আর এক ভুমিকা। খুব শীত পড়লে স্যান্ডো গেঞ্জির উপড় একটা হাফ হাতা সোয়েটার। কদিন আগে ২০১৩-র এক এপ্রিল মাসে হঠাৎ হাজির হয়েছিলাম। সেই এক হোটেল, এক কাজ, শ্যামদা বেঁচে আছে শুনলাম কিন্তূ একটা স্ট্রোকের ধাক্কায় নিজের বাড়িতে শয্যাশায়ী। শ্যামদা শুধু বর্তমান - হোটেলের সাইনবোর্ডে।
………………………..
এভাবে দেখতে দেখতে অনশনের তিন চার দিন কেটে গেলো। বিমল সেন সকাল বিকেল আমাদের মধ্যে দিয়েই গটগট করে নিজের অফিসে ঢুকে যেতেন এবং কাজ শেষে বা মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে বেড়িয়ে যেতেন। আমাদের দিকে দৃষ্টিপাতও করতেন না। শুধু আমাদের হাসপাতালের ডাক্তার একবার করে এসে অনশনরত জনগণের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে যেতেন। ক্লাস খাতায় কলমে চালু থাকলেও আমরা খুব একটা যেতাম না। আর যারা অনশন করেছিল বা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলো তারা তো ২৪ ঘন্টাই লবিতে হাজির থাকতো।
তখন এতগুলো বাংলা নিউজ চ্যানেল ছিলো না। তবে খবরের কাগজগুলোতে এই নিয়ে খুব হইচই হয়। ধীরে ধীরে রাজনীতির খেলা শুরু হয়। শোনা গেল এসএফআই বলছে সিপি আন্দোলনটা ঠিক পথে চালাতে পারছে না কিন্তূ সব অধিকারটা নিজেদের হাতে রেখেছে, এতে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। আবার সিপির দিক থেকে শোনা গেলো এসএফআইকে আলিমুদ্দিন থেকে নির্দেশ দিয়েছে বলে ওরা আন্দোলন থেকে সরে যাচ্ছে আর এটাকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। তবে যাইহোক এসব চাপানউতর চললেও কোনো হাতাহাতি বা ওই জাতীয় নোংরামি হয় নি। আন্দোলন চলতে থাকে, আমরাও সবাই নিজেদের পুরোনো হোস্টেলেই থেকে যাই। আর এতোদিন পড়ে এসব রাজনৈতিক দাবী নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেও লাভ নেই।
এদিকে পুরনো ছাত্র, প্রাক্তন ডাইরেক্টর, বিদ্যুতমন্ত্রী এবং তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হবার সুবাদে শ্রীযুক্ত শংকর সেন এই ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়েন। শোনা কথা, উনি নাকি বিমল সেনের বিরুদ্ধগোষ্ঠীর ছিলেন এবং তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্ত জ্যোতি বসুকে প্রভাবিত করেন ছাত্রদের হয়ে, যাতে হোস্টেল বদলের নির্দেশ কার্যকরী না হয়। তখন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে একটা মিটিং হয়, যাতে সম্ভবত আমাদের কিছু সিনিয়র দাদা - ড্যাড, নির্ভীক সেনগুপ্ত, শুভময়, সঞ্জীব মণ্ডল আর দিব্যেন্দু এরা গিয়েছিলো। এটাও শোনা কথা ছাত্রদের সাথে মিটিং-এর পরেই অন্য একটা মিটিং-এ শ্রী জ্যোতি বসু নাকি বিমল সেনকে চাপ দিয়েছিলেন এই ব্যাপারটা নিয়ে জেদাজেদি না করতে আর যেমন হোস্টেল সিস্টেম ছিলো সেটাই রেখে দিতে। কিন্তূ বিমল সেন শেষ পর্যন্ত্য নাকি জ্যোতি বসুকে বোঝাতে সক্ষম হন যে ছাত্রদের চাপে নতিস্বীকার না করে, আন্দোলনের ফাটল ধরানোর একটা শেষ চেষ্টা করা উচিত।
সেইমত অনশনের সপ্তমদিনে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মিটিং আর সাংবাদিক সম্মেলনের পর ডিরেক্টরের অফিস থেকে একটা বিজ্ঞপ্তিজারী হয় যাতে বলা হয় অবিলম্বে নতুন হোস্টেলে চলে না গেলে ১২৮ জন ছাত্রকেই বহিষ্কার করা হবে। স্বভাবতই এই বিজ্ঞপ্তি ছাত্রদের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে আসে। এছাড়াও কিছু বিরুদ্ধ মানসিকতার জনগন প্রচার করে এই আন্দোলন করে কোনো লাভ নেই। দ্রুত ফাটল ধরে আন্দোলনের আবেগে এবং আমাদের মনোবলে। আমরা সেই ১২৮-জনের প্রায় সবাই খুব ভয় পেয়ে যাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
বেকসুর জরুরী বৈঠক শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত্য অনশন চালিয়ে গিয়েছিল ১৯৯৫ ব্যাচের মেকানিকালের ড্যাড (দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য), সিভিলের নির্ভীক সেনগুপ্ত ও রাদাম (রাজীব দাস মহাপাত্র); ১৯৯৬ ব্যাচের ETC-র পাম্পু (রণজয় রায়) এবং আমাদের ব্যাচের ইলেক্ট্রিকালের মামা (অমিতাভ দাস)। এদের নাম দেওয়া হয়েছিল ১৫৬ নট আউট, কারণ ১৫৭ ঘন্টায় এই অনশন প্রত্যাহার হয়ে যায়, বি ই কলেজের ইতিহাসে যতদুর সম্ভব সব থেকে দীর্ঘক্ষণ চলা অনশন ধর্মঘট। আর যা মনে আছে সত্যি করেই অনেক চেষ্টা বা আবেগ থাকলেও এই ধর্মঘট বিফলে যায় বলে যারা অনশন করেছিলো তাদের কেউ ফলের রস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করেনি। কি বিচিত্র পরিহাস।
সেই সন্ধ্যের কথা এখনো অনেকের মনে থাকবে। গোটা কলেজ জড়ো হয়েছে ক্যান্টিন, আই হল আর বকুলতলায়। মিটিং শেষ করে ড্যাড, নির্ভীকদা, পাম্পু এবং বাকিরা এসে হাজির হলো কলেজ কান্টিনে। একে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে। সাতদিন অনশন করেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেরুদন্ডগুলো এক সন্ধ্যেতেই যেন ভেঙ্গে গেছে। ঘোষনা হলো, এখানে আমরা সবাই মা বাবার স্বপ্ন সফল করতে, অনেক কষ্ট করে পড়তে এসেছি। তাই অনশন ধর্মঘট অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হলো যাতে কোনো ছাত্রের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। কেউ প্রতিবাদ করেনি, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখে শূন্য থেকে কয়েকফোঁটা জল নেমে আসে। কয়েকমুহুর্ত মনে হয়েছিলো চারিদিকে শুধু রাশি রাশি শূন্য।
এরপর ভাগ্যের পরিহাসে আমরা সেই ১২৮ জন প্রায় সবাই চারবছরের জন্যে রয়ে গেলাম 'নতুন' ছেলেদের দলে। ফার্স্ট ইয়ারে হোস্টেলের রাশ সিনিয়ারদের হাতে আর আমরা মুরগি থেকে ফার্স্ট ইয়ার। তারপর থেকে আমরা অন্য হোস্টেলে গেলেও সেখানে আগে থেকেই থাকতো সেই হোস্টেলের সিনিয়ার বা আমাদের ব্যাচের সেইসব হোস্টেলের পুরোনো ছেলেরা। তাই আমরা বরাবর রয়ে গেলাম দ্বিতীয় শ্রেনীর বাসিন্দা। সবাই ভালো রুম, ভালো খাট বা ভালো লকার দখল করে নেবার পর পড়ে থাকা জিনিসপত্র জুটতো আমাদের কপালে।
বেকসু ঠিক করে দিয়েছিল তিনদিনের মধ্যে আমরা নতুন হোস্টেলে চলে যাব। আমরা কথামতো একবিকেলে, ভাঙ্গা লকার থেকে মালপত্র টিনের তোরঙ্গে ভরে আর জংধরা লোহার খাটের উপর থেকে বেডিংটা গুটিয়ে, বগলে ড্রয়িং বোর্ড আর কাধে টি নিয়ে একটা ভ্যানের পিছনে কয়েকজন মিলে যাত্রা করি মুচিপাড়ার দিকে। আমি চলে আসি সমিত রায়চৌধুরী আর সন্দীপ মণ্ডলের সাথে প্রথম বাসা হোস্টেল পনেরো থেকে হোস্টেল নয়-এর দিকে। তারপর নয় থেকে দশ ঘুরে চতুর্থ বছরে সেন হলে এলেও কোনদিন হোস্টেল ১৫ তে ঢুকিনি। ঢুকতে ইচ্ছে করেনি। খুব সম্প্রতি একবার কলেজে গিয়ে ১৪, ১৫ আর ১৬-র দিকে গিয়েছিলাম। দেখলাম ১৫ নং ছাড়া সব হল ও হোস্টেলেই নাম বা নম্বরের ফলক লাগানো। কিন্তূ শুধু হোস্টেল ১৫-ই নামগোত্রহীন। ১৪ আর ১৬-র মাঝে দাড়িয়ে আছে বলে বুঝে নিতে হয় এটাই ১৫। সব হোস্টেলে ঢুকলেও, ২০১৩-র এক এপ্রিলে গিয়েও হোস্টেল ১৫-তে ঢুকতে গিয়েও ফিরে এলাম। মনে পড়ে গেলো একদিন আমাকে এখান থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ঘাড় উঁচু করে ছেড়ে যেতে পারিনি। হোস্টেল ১৫ কে ছেড়ে যেতে হয়েছিলো নতুন মুরগীদের জন্যে সুরক্ষিত করার জন্যে। ঢুকেছিলাম সিনিয়ারদের মুরগি হয়ে মাথা নিচু করে, বেরিয়েছিলাম কর্তৃপক্ষ নির্দেশে মাথা নিচু করে। যেদিন এসেছিলাম মনে অনেক অজানা ভয় ছিলো, যেদিন বেরিয়ে গেলাম সেদিন মনটাই ছিলো না।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.