Wednesday, April 17, 2013

১১. চোতাকাহিনী


-১১. চোতাকাহিনী 

"ত দিন পরীক্ষা, তত দিন টোকাটুকি। যত দিন শিক্ষা প্রথা, তত দিন থাকবে চোতা। নিন্দুকরা চেঁচালে হবে না, টুকলি যুগ যুগ জিয়ো। একটি গ্রিক গল্প: পরীক্ষার খাতায় একটি ছাত্র লিখল— 'যুদ্ধে হারিয়া শাজাহান ভাঙিয়া পড়িতেন না।' পিছনে বসা ছাত্রটি সেটাই দেখে দেখে লিখল— 'যুদ্ধে হারিয়া শাজাহান জাঙিয়া পরিতেন না।' মর্মার্থ: টুকতেও শিক্ষা লাগে। প্রখ্যাত দার্শনিক বেনথ্যাম বলেছেন, যে দেশে মুখস্থ বিদ্যার ওপর শিক্ষার মান স্থির হয়, সেখানে টুকলিই সেরা অস্ত্র, সেরা প্রতিবাদ। শেলি বলেছেন: "পড়িলে টুকিতে হবে, সব মুখস্থ কার কবে, অতি স্থির কোন বীর হায় রে পরীক্ষার হলে"

বন্ধুগণ, এ বার আসি মূল বিষয়ে, টোকা কী ও কেন? টুকলি হইল এমন এক উপায় যা আপনাকে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহরে যেমন মেট্রো রেল। সবাই যখন ঘেমে-নেয়ে জ্যামজটে অস্থির হয়ে আপিসে যায় তখন মাটির তলা দিয়ে এক দল লোক গুড়গুড় করতে করতে অনেক আগেই দফতরে পৌঁছে চাউমিন সাঁটায়। কেউ কেউ আবার আরও দ্রুত যাবে বলে এসকেলেটরে উঠেও দৌড়য়। কিন্তূ ওগুলো বৈধ, সরকারি অনুদান-সমৃদ্ধ, আর টুকলি হল অবৈধ। এই কাণ্ডটি করলে পরীক্ষক ধরে, পুলিশ ধরে, নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরা ধরে এবং বাবা-মা ইত্যাদি জানলে ইমেজে ফাংগাস ধরে। কিন্তু না ধরতে পারলে, টুকলির মতো বন্ধু আর জগতে নেই। টুকলি হল ১২ বছরের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসে কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের একটা মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করে নিশ্বাস নেওয়ার মতো।"

উপরের অংশটা দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের একটা রবিবাসরীয় থেকে চোতা মারা। মানে দাড়ি, কমা, ফুলস্টপ সুদ্ধু হুবহু টুকে দেওয়া। যেটাকে পরীক্ষার হলে করলে বলি চোতা করা আর সাহিত্য বা সংস্কৃতির জগতে হলে বলা হতো, অমুকের অনুপ্রেরনায় বা তমুকের কোট করে। এই অংশটা বি ই কলেজের বিভিন্ন চোতা করার উপায় এবং নতুন কিছু উদ্ভাবনের উপড়। যেগুলোর আবিষ্কারকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কোনোরকম পেটেন্ট বা উৎপাদন শুল্ক ছাড়াই উদারমনে এইসব গুরূবিদ্যায় অকাতরে অপরকে দীক্ষিত করেছে।

আমরা অনেকেই ছিলাম সেই সব সর্বনাশের মূল মুখস্থ বিদ্যের উপড় নির্ভরশীল। গুটিকয় প্রতিভাবান ছিল যারা নাকি বিষয়টা বুঝে মন থেকে লিখতো। বাকিরা বা বলতে গেলে অল্পবিস্তর অনেকেই চোতার উপড় নির্ভরশীল। টোকার অনেক পদ্ধতি বা শ্রেণীবিভাগ আছে। ক্লাসের প্রথমদিকে থাকতো এমন অনেকে নিজে থেকে কষ্ট করে চোতা করত না বা কোনো টুকলি সাথে নিয়ে যেত না। কিন্তূ জানতো আশেপাশে কাদের কাছে চোতা আছে। আটকে গেলে বা সুযোগ পেলে ঘাড় ঘুরিয়ে টুক করে জেনে নিত কোনো জটিল সূত্র বা দু-একটা ছোটো উত্তর। এরা প্রথম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী, ক্লাসে ভালো ফল করতো, অধ্যাপকদের স্নেহধন্য, গর্ব করে বলত কখনো চোতা করেনি; কিন্তূ দরকারে বাজে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে ওই একটু সাহায্য না পেলে তাদের ফল হয়তো এতো ভালো হতো না। কিন্তূ তারা হলো মহাভারতের কৃষ্ণ, নিজে যুদ্ধ করলো না। তবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বোর্ডে বা বেঞ্চে বা দেওয়ালে লেখা থাকতো যেগুলো দরকারে যে কেউ তাকিয়ে দেখে নিতে পারতো।

এরপর ছিলো দ্বিতীয় শ্রেণী, যারা বিপদে চোতা করতো দু-একটা খুব শক্ত সুত্র। অথবা কিছু কাগজ নিয়ে যেতো যেগুলো বাথরুমে গিয়ে দেখে এসে, চটপট লিখে ফেলতো। অথবা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় আড়চোখে দেখে নিতো পাশের বা সামনের জনের খাতা বা কোনো সার্বজনীন উন্মুক্ত চোতা। তবে এরা অনেক বিষয় চোতা না করেই নামিয়ে দিতো, নিজস্ব ফান্ডা দিয়ে। একজনের এখানে বলবো যে আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র ছিলো পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের এক স্কুলে। পরে সে ডাক্তারি পরে এখন আপোলোতে কর্মরত। তার একটা প্রতিভা ছিলো প্রায় কুড়ি ফুট দূর থেকে কারো হাতের কনুই নড়া দেখে হুবুহু নকল করে ফেলতে পারতো। তবে যার দেখে লিখতো তার জামা ফুলহাতা থাকলে ফান্ডাটা কাজে লাগতো না। জনতার দাবীতে অনেকবার সে সেটা জনসমক্ষে করে দেখিয়েছিল। এরকম দুর্দান্ত প্রতিভা অনেকের না থাকলেও দূর থেকে হাতের নড়া দেখে অনেকে কোনো স্কেচ নকল করতে পারতো।

আর ছিল তৃতীয় শ্রেণী। যারা দরকার পড়ুক বা না পড়ুক, সব বিষয়ের চোতা তৈরি করে রাখতো। এদের মধ্যে কয়েকজন আবার হাতের লেখা খারাপ বলে নিজে চোতা না করে অন্য কাউকে দিয়ে চোতা করিয়ে নিতো। যে করে দিত সে বড়ো অক্ষরে লিখে দিলে সেটা আবার বি জি রোডের জেরক্স মেশিনের দোকান থেকে মাইক্রো জেরক্স করে আনতো। চোতা ছাড়া প্রায় কোনো বিষয় বা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত না। এরা ছিল একবারে মহাভারতের অর্জুন, যারা ছলেবলে পুরো ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধটা নিজেই করতো।

পাশ করার পর কেউ স্বীকার করেনা যে কলেজ জীবনে চোতা করেছিল। সবার কাছেই শুনি তার বন্ধুরা চোতা করতো। যেমন শুনি কলেজ জীবনে সবাই নাকি খুব ভদ্রসভ্য ল্যাজবিশিষ্ট ছিলো। ছেলে হলে বলে মেয়েদের অবজ্ঞা করতো বা জীবনে বউ ছাড়া অন্য মেয়ের প্রতি ফ্রাস্টু খায় নি বা প্রেম করে নি। মেয়ে হলে শোনা যায় সে জগৎসুন্দরী ছিলো বলে অনেক ছেলে তার পিছনে ঘুড়ঘুড় করতো, কিন্তূ সে নাকি কাউকে পাত্তা দিতো না। সেরকম বন্ধুদের বিভিন্ন চোতা করার গল্প থাকলেও, কেউ নিজের নকল করার গল্প বলতে লজ্জা পায়। তবে সত্যি বলতে আমার মনে হয় কিছু ধরনের চোতা করার পদ্ধতি রীতিমত প্রশংসার দাবী রাখে। নকল করা এক ধরনের হস্তশিল্প, যাতে তাৎক্ষনিক উপার্জন না হলেও, দীর্ঘমেয়াদী উপার্জনের রাস্তা তৈরি হয়। আর মুখস্থবিদ্যা বা সল্পমেয়াদী ভাবে মাথায় টুকে নিয়ে গেলে দোষ নেই, যত দোষ কাগজে লিখে নিয়ে গেলেই?

আমার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পিতামাতা ও পূর্বপুরুষেরা আমার নাম দিয়েছিলেন 'পার্থ প্রতিম', তাই আমি 'পার্থ সারথী' বা কৃষ্ণের মতো প্রথম শ্রেনীর হতে পারিনি। তা বলে আমি 'পার্থ' বা তৃতীয় শ্রেনীর অর্জুনদের মতো পুরোপুরি চোতা নির্ভরশীলও ছিলাম না। হয়তো 'পার্থ প্রতিম' নামের মর্যাদা রেখে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মতো মাঝামাঝি ছিলাম। দুয়েকটা বিষয়ে একটা দুটো শক্ত সুত্র বা তথ্য টুকে নিয়ে যেতাম। তার অধিকাংশই যদি ভুলে যাই তাহলে বাথরুমে গিয়ে দেখে আসবো ভেবে। আর অবিভাগীয় বিষয়ে খুব কম হলেও অল্প কয়েকটা একদম সঙ্গে নিয়ে। তবে সেটার মাধ্যম ছিল সাধারণ কলম। আমাদের সময় চালু ছিল ইউজ এন্ড থ্রো ষ্টারলাইন পেন, যার প্রস্থচ্ছেদটা ছিলো ষড়ভুজের মতো আর যে রঙের কালি ভরা সেই রঙের কিনারাযুক্ত বাইরের রং ছিলো সাদা। সেই পেনের এক এক পার্শ্বে ড্রয়িং-এর মাইক্রোটিপ পেন্সিল ব্যবহার করে এক সময় প্রায় দুই থেকে তিন লাইন লিখে ফেলতে পারতাম। মানে একটা কলমই যথেষ্ঠ টুকটাক টোকাটুকির জন্যে। একবার মনে আছে বেসিক ইলেকট্রিকালের কিছু নকশা এক দিকে ধরিয়ে ফেলেছিলাম। পরীক্ষাহলে সামনে পড়ে থাকলেও কারো বোঝার ক্ষমতা ছিলো না পেনের গায়ে কিছু লেখা আছে। এক পার্শ্বের লেখা শেষ হলে বামহাতে পেনটা অল্প ঘুরিয়ে নিয়ে পরের লাইনগুলো সহজেই দেখে নেওয়া যেতো।

এছাড়াও খুব জনপ্রিয় ছিল বা আজও আছে সাদা ডায়াগোনাল স্কেল। রথী মহারথীরা একদিক ব্লেড দিয়ে চেঁছে উঠিয়ে দিতো, আর সম্পূর্ণ সাদা অংশে ধরিয়ে ফেলতো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। অনেকে তো এতগুলো ডায়াগোনাল নিয়ে যেতো যে তার একটা সুচিপত্র হাতে বা কোথাও লিখে রাখতে হতো। প্রশ্ন মিলে গেলে সুচিপত্র দেখে হাত ঢুকে যেত, জামার পকেট বা পান্টের ডান বা বাম পকেটে। কেউ কেউ ছিল যে নিজে মনে রাখতে পারতোনা বলে পাশের রোল নম্বরের ঘরে এসে পরীক্ষার আগে দেখিয়ে যেতো কোন ডায়াগোনালে কি লেখা আছে। পরীক্ষার সময় জেনে নিতো অমুক প্রশ্নের উত্তরটা কোন ডায়াগোনাল দেখে লিখবে। এছাড়াও ছিল সাধারন কাগজে লেখা চোতা যেটা সাজানো থাকতো বামহাতের দুই আঙ্গুলের মধ্যে হারমোনিয়ামের বেলোর মতো করে, অদ্ভুত দক্ষতায় পরতে পরতে এক অংশ খুলতো আর তার আগের অংশ বন্ধ হতো। কেউ পুরো নোটটাই জেরক্স না করে লিখে রাখতো বিশেষভাবে তৈরি খুব ছোটো খাতার মধ্যে, যা আশ্রয় পেতো জ্যামিতি বাক্সের মধ্যে বা দুই ঊরুর মাঝে। অনেকের পরিক্ষার আগে হাত কেটে যেতো। ব্যান্ডেজের সাথে সেখানে পেঁচিয়ে থাকতো সার্ভে বা স্ট্রাকচারাল এনালাইসিসের কোনো প্যাঁচালো প্রসঙ্গ।

শুধু যে ছেলেরাই চোতা করতো তা নয়। অনেক মেয়ে পরীক্ষা দিতে আসতো শাড়ি পরে, আর শাড়ি আঁচল বা রুমালে লেখা থাকতো কোনো জটিল অঙ্ক বা কোনো খটমট নকশা বা কুটিল কোনো সুত্র। কয়েকজনতো এতো মরিয়া ছিল যে হঠাৎ পরীক্ষক কোনো হারমোনিয়াম চোতা দেখে ফেলে কেড়ে নেবার জন্যে এগিয়ে আসছে দেখে এমন জায়গায় সেটা টুক করে চালান করে দিতো যে পরীক্ষক ধরতে গেলে নিজেই শ্লীলতাহানীর দায়ে পড়বেন। এই সুযোগটা ছেলেরাও নিতো যদি কোনো ম্যাডাম দায়িত্বে থাকতেন। কেউ কেউ দেখেছি ধরা পরে গেছে বুঝতে পেরে বেমালুম চোতা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। এছাড়া ঘড়ির ব্যান্ডের তলায়, জামার গোটানো হাতের মধ্যে উঁকি মারতো দু-একটা নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর। আমাদের সময় জিন্স এতো প্রচলিত ছিল না। কিন্তূ কিছু বান্ধবী ডায়াগোনালে চোতা করলে পরীক্ষার হলে জিন্স পড়ে আসতো।

অনেকে প্রথম পরীক্ষাটা একটু খেটেখুটে দিতো, কিন্তূ তারপরের দিন থেকে দেখা যেতো সব পরীক্ষায় তাড়াতাড়ি খাতা জমা পরে যাচ্ছে আর বেশ ভালো নম্বরও পাচ্ছে। আসলে রোজ সে প্রচুর লুজ পেপার নিতো, যার মধ্যে অধিকাংশই সদ্যদিনে জমা পড়তো না। আলাদা আলাদা লুজ সিটে রাতে লিখে নিতো পরেরদিন প্রায় নিশ্চিত সেরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর। তারপর সুযোগ বুঝে মিলে যাওয়া প্রশ্নগুলোর পাতা মূল উত্তরপত্রের সঙ্গে জুড়ে জমা দিয়ে দেওয়া। কেউ কেউ বন্ধুর সঙ্গে সাঁট করে গিয়ে, এ কয়েকটা উত্তর লিখত, ও কয়েকটা। তার পর দু'জনেই খাতা 'এ বাবা' বলে মেঝেয় ফেলে দিয়ে, তোলার সময় বদল করে নিত। অবশ্য খাতা জমা দেওয়ার আগে ফের এক বার বদল করতে না পারলে কেলো! এর কিছু পাতা ওর কাছে যাওয়ার অবধারিত বিপদ হিসেবে মাঝে মাঝে রিলে হয়ে কোনো উত্তরপত্রের অংশ পৌঁছে যেত হলের অন্যপ্রান্তে। পরীক্ষার শেষে, খাতা জমা দেওয়ার সময় যার উত্তরপত্রের অংশ সে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে, 'ওরে, আমার কাগজ কই' কেউ কেউ আবার বাথরুম থেকে ঘুরে এসে সামনে দিয়ে যাবার সময় এক পর্বের উত্তরপত্র নিজের মনে করে তুলে নিয়ে চলে যেতো, টোকা হয়ে গেলে নিচে ফেলে বা আর একবার বাথরুমে যাবার পথে দিয়ে যেতো। এছাড়া মান্ধাত্তা আমলের উপায় - জুতোয়, মোজায়, কলারের ভাঁজে, পেনসিল-বাক্সে কাগজ লুকনো, ক্লিপবোর্ডে উত্তর লিখে নিয়ে যাওয়া, এমনকী অ্যাডমিট কার্ডের পিছনে থিয়োরেম।

তৃতীয় বছর থেকে আমি খুব কম সময়ই ক্লাসে থাকতাম আর বাকি সময়টা কম্পিউটার ল্যাবে কাটাতাম। কিছু সময় স্যারেদের কোনো কাজেও যুক্ত থাকতাম নিজের আগ্রহে। স্বভাবতই ক্লাস নোটের জন্যে ভরসা করতে হত অন্যদের উপড়। আবার কম্পিউটার এবং অনান্য সেশনালের জন্যে অনেকে ভরসা করতো আমার উপড়। তাই কয়েকজন পরীক্ষার আগে সব নোটের জেরক্স নিয়ে ঘাঁটি গাড়তো আমার ঘরে। বিশ্বজুড়ে 'যৌথ খামাড়' স্বপ্ন থেকে গেলেও, বাস্তবে আমার নেতৃত্বে শুরু হতো যৌথ গাঁতানোর আখড়া। এসব করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, নিজে পড়ে মুখস্থ করার থেকেও অন্যকে বোঝাতে গেলে সহজে মনে থাকে। আর নিজে খাতায় লিখে পড়া তৈরি করাটা বিরক্তিকর লাগলেও অন্যের হয়ে চোতা করা দিলে একটা পরোপকারও হতো আবার নিজেরও পড়া তৈরি করাটা সুবিধে হতো। দুয়েকটা সুত্র অনেকেই হাতের তালুতে বা নখে লিখে নিয়ে চলে যেতাম। লেখা হয়ে গেলে বা না মিললে সহজেই সেগুলো মুছে ফেলা যেতো। আর একজন ছিল সব চোতা নিয়ে যেতো শুধু 'ব্যাকআপ' হিসেবে। হাতের লেখা বেশ ভালো ছিলো আর লিখতো বেশ দ্রুত। এমনিতে সব মন থেকে লিখতো যতগুলো পারে। যেগুলো মনে থাকলো না সেগুলো বাথরুমে গিয়ে মুখস্ত করে এসেই চটপট লিখে ফেলতো। আর নাম্বারও পেত বেশ ভালোই, প্রথম দশজনের মধ্যেই থাকতো। আর সবশেষে সেই সব ভুলোমনের যারা ভুলে যাবে বলে চোতা করে নিয়ে যেত, কিন্তূ পরীক্ষাহলে সেটাও ভুলে যেতো যে আদপে প্রশ্নটা চোতা  করেছে কিনা বা করলেও কোথায় রেখেছে!

শেষ করি চোতা নিয়ে কিছু মজার ঘটনা দিয়ে। আমাদের সময় বর্দ্ধমান থেকে মেকানিকালের এক প্রতিভাবান ছাত্র ছিল, সে মাধ্যমিকে অংকে একশয় একশ এবং উচ্চমাধ্যমিকে অংকে দুশয় দুশ পেয়েছিল। কিন্তূ বি ই কলেজের চারটি সেমেস্টারের একটিতেও অংকে এক সুযোগে পাশ করতে পারেনি। সে ছিলো চোতায় স্বনির্ভর, কয়েকটা সাদা পাতাকে আটভাগ করে ছোটো ছোটো খাতা তৈরি করতো। তারপর পুরো সিলেবাসটাই ভালো ফল করে এমন কারো নোটবুক থেকে ছোটো ছোটো অক্ষরে লিখে ফেলতো। এটা তার সাড়া বছরের নিয়মিত অভ্যাস থাকায়, পরীক্ষার আগের রাতেও পড়ার বা চোতা করার চাপ নিতে হতো না। শুধু সকালে উঠে রুটিন দেখে সঠিক খাতাটা পকেটে পুরে শিস দিতে দিতে চলে যেতো।

সিভিলের এক সহপাঠী সুপ্রিয়র কাছে শোনা তার খুব কাছাকাছি বসা এক ছাত্রের কিছু মজাদার কাহিনী ছিল। সেও ছিলো পুরো চোতা নির্ভর এবং একটু তোতলা। একবার পরীক্ষার হলে একটু বিভ্রান্ত হয়ে একটা ডায়াগোনাল দেখিয়ে সুপ্রিয়কে জানতে চায় "এই তুপ্রিয় বলনা, ১ নম্বরটা কোতা থেকে তোতাবো"। অনিচ্ছাসত্বেও এবং পরীক্ষককে এড়িয়ে সুপ্রিয় ডায়াগোনালের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বলে আরে এতো পরিবেশ বা এনভায়রনমেন্টের চোতা, কিন্তূ আজতো পরিবহন মানে ট্রান্সপোর্টেশানের পরীক্ষা। সেই বর্ণময় চরিত্রের তাৎক্ষণিক উক্তি, "দ্যাৎ তালা, আদ লাতে দর্ণায় থিনেমা দেখতে দাবো বলে, দুতো বিতয়ের তোতাই তৈরি করে লেখেতিলাম। কিন্তূ আতার তময় বুল কোলে অন্যতা নিয়ে তোলে এততি"। প্রথম ঘন্টা পড়ার পর সে হোস্টেলে গিয়ে সেট বদল করে এনে বাকি পরীক্ষা দিয়েছিলো। আর একবার একটা দুনম্বরের প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় সুপ্রিয়কে জানতে চেয়েছিল "এই তুপ্রিয় বলনা এতা কোতা তেকে তোতাবো"। সুপ্রিয় সবদিক দেখে চট করে বাড়িয়ে ধরা ডায়াগোনালের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "এই তো প্রথম লাইন থেকেই লিখে দে"। বেশ কিছু পরে গোটা ডায়াগোনাল থেকে প্রায় দুতিন পাতা লিখে আবার খোঁচা "এই তুপ্রিয় বলনা কততা তোতাবো"। সুপ্রিয় অবাক হয়ে বলেছিল তোকে তো প্রথম অনুচ্ছেদটাই লিখতে বললাম আর ওটা তো দুনম্বরের প্রশ্ন!উত্তর ছিল, "দুত্ তালা তলবি তো। অতো বুললে কি আমাকে তোতাতে হয়"। সবথেকে সেরা ছিল চতুর্থ বছরের এক ঘটনা। হাতের লেখা খারাপ বলে আর ল্যাদ খেয়ে ইনি মাঝেমাঝেই অন্যদের দিয়ে চোতা বানিয়ে নিতেন। জল সম্পদ বা ওয়াটার রিসোর্সের পরীক্ষায় একটা প্রায় দুশভাগ নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর তাঁর ডায়াগোনালে টোকা ছিল। কিন্তূ তিনি সেটার উত্তর না করেই চলে এসেছিলেন। কারণ চোতায় ছোটো এল চিহ্ন দিয়ে অঙ্কটা করা থাকলেও প্রশ্নপত্রে সেই অঙ্কটা বড় এল চিহ্ন দিয়ে ছিল। পরে উল্ফেডেনে এসে দেখা যায় তিনি চিৎকার করছেন যে চোতা করে দিয়েছিল তাকে। "দুত্ তালা, তলবি তো। পলিক্ষায় তো ওতা বদো এল (L) তিলো, আল তোতায় তো তোতো এল (l)আমি কি কলে দানবো যে দুতোই এক"। এই ব্যাক্তি মন্ডল কমিশনের প্রস্তাবের সুফল হিসেবে টপাটপ বেশ কয়েকটা পদোন্নতি পেয়ে এখন পূর্ত বিভাগের উচ্চপদে আসীন।

পরীক্ষার হলে চোতানো ছাড়াও নকল জনপ্রিয় ছিল ল্যাব বা সেশনালগুলোতে। হোস্টেলের সব ফ্লোরে কিছু কাঁচ আর টেবিল ল্যাম্প থাকতো 'লাইট স্ট্রেসিং' করার জন্যে। এছাড়াও ড্রয়িং বা অনান্য ল্যাবের নকশাগুলো দুয়েকজন করতো আর বাকিরা কাঁটা মেরে তুলে নিতো শেষবেলায়। অনেকে তাই করে ফেললেও বাকিদের বলতো না, কারণ যারা নকল করতো তাদের খাতাগুলো অনেক ভদ্র অবস্থায় জমা পড়তো। আর যারা আগে করতো তাদের খাতা মাঝে মাঝে কাঁটার দাগে এত ছিড়ে যেতো বা লাইট স্ট্রেসিং-এর ফলে কালো হয়ে যেতো যে তাকে আবার অনেক সময় নতুন করে করতে হত।

আবার কিছু প্রফেসর ছিলেন যারা চোতা ধরার বেশ অভিনব উপায় বার করেছিলেন। প্রোঃ পি কে রায়, মানে পিকসা দেওয়ালে বা বোর্ডের সুত্রগুলোতে মাইনাস চিহ্নকে যোগচিহ্ন করে দিতেন বা একটা গুরুত্বপূর্ণ নম্বরকে মুঝে দিতেন। অনেক প্রফেসর দেওয়ালে বা বোর্ডে পেন্সিলে লিখে রাখা কোনো সূত্রের মধ্যে তিনকে একটু মুঝে দুই করে দিতেন। যারা সেটা দেখে লিখতো তারা সহজেই ধরা পরে যেত। কোনো কোনো প্রফেসর যার ড্রয়িং সব থেকে পরিষ্কার তাকে সব থেকে কম নম্বর দিতেন।

এছাড়া ছিলো আমাদের জরিপের সময় কারচুপি করা। সার্ভে কাম্পে বেশ হইচই হতো, যেটা পরে এক জায়গায় গুছিয়ে বলা যাবে। আমরা যেখান থেকে জরিপ শুরু করতাম সেখানে একটা চিহ্ন দেওয়া থাকতো। সেখানে ফিরে এসে ড্রয়িং করে ভুল শুধরে পুরো জায়গাটা আঁকতে হতো। সাধারনতঃ ফার্স্ট লবি থেকে শুরু করে কেউ চলে যেতাম রিচার্ডসনের দিকে, কোনো দল আবার ওভালের পাশ দিয়ে বিদিশা ঝিলের দিকে, কেউ কেউ হোস্টেল ১৫, ১৬-র পিছনদিকে। আমরা শুরু করে কিছুদুর এগিয়ে যাবার পর কোনো প্রফেসর এসে শুরুর চিহ্নটা পাঁচ ফুট সরিয়ে দিতেন। ভুল তথ্য নিয়েছি ভেবে, যারা সেটাকে মিলিয়ে দিতাম তারা ফাঁকি মারার জন্যে ধরা পড়তাম। যে দল মন দিয়ে জরিপ করতো তারাই বুঝতে পারতো পাঁচ ফুট হিসেব মিলছে না। পরে নারায়ন সান্যালের সত্যকাম পড়তে গিয়ে বুঝেছি এটা সার্ভের অনেক পুরোনো ফাঁদ। প্রোঃ পি কে রায় ডক্টরেট করেছিলেন সার্ভে নিয়ে। একবার দেখলাম আমরা তিনদিনে যা জরিপ করে এঁকেছি উনি ক্যালকুলেটরে টুকটুক করে দুমিনিটে কিসব হিসেব করে বলে দিলেন কোথায় ভুল হয়েছে। আমরা জানতে চেয়েছিলাম কি করে করলেন, উনি বলেছিলেন "বলে দিলে তো কাল থেকে তোরা আমার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বি, আর আমি ধরতেও পারবো না তোরা কোথায় ফাঁকি মেরেছিস"।

আর একজনের কথা না বললেই নয়। আমার ঠিক পরের রোল নম্বর প্রদ্যুত রায়। পরীক্ষায় কিছু দরকার পড়লে অনুরোধ না করে জোর গলায় দাবী করতো। "এই দেখি তোর খাতাটা, পাশে রাখতো, প্রথম পর্বের উত্তরগুলো মিলিয়ে নিই"। শেষ সেমেস্টারে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো আমার সাথে মিলিয়ে নিয়েছিলো যাতে পরীক্ষায় সুবিধে হয়। আমিও অবশ্য বেশ কয়েকবার ওর কাছে কিছু সাহায্য পেয়েছি। তবে খুব একটা চোতা করতো না, কারণ হলো ল্যাদ আর আশেপাশে এতজন থাকতে ওকে কেনো কাগজের ওপর নির্ভর করতে হবে এই দাবীতে। শেষ লিখিত পরীক্ষা ছিল টাউন প্ল্যানিং-এর ওপর। গার্ড খুব একটা কড়া না থাকায়, বেশ কয়েকবার দুয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানার পর যখন আমি খাতা জমা দিতে উঠে যাচ্ছি, জামার পিছন ধরে বসিয়ে দিয়ে আমার খাতাটা বেমালুম নিয়ে বাকিগুলো মিলিয়ে নিলো। আমি বাধ্য হয়ে পরীক্ষকের চোখের সামনে খাতা নেই নিধিরাম সর্দার হয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিলাম।

সেশনালে প্রদ্যুতকে দেখেছিলাম বেশ কয়েকটা সেমেস্টারে কারো থেকে নকল করেনি, আবার নিজেও ড্রয়িং করেনি। কিন্তূ ঠিকদিনে জমা দিয়ে দিতো। উৎসুক হয়ে চতুর্থ বছরে ওর ঘরে জমা দেওয়ার আগেরদিন গিয়ে যা আবিস্কার করি তাতে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ওর দিদিও আমাদের কলেজের সিভিলের ছাত্রী ছিলো, আমাদের থেকে তিন বছর আগে। সেই প্রতিমাদির সময়ে করা ড্রয়িংসিট গুলোতে ব্লেড মেরে শুধু নামটা বদলে জমা দিয়ে দিতো। অবশ্য তাতে দেখা যেতো ডিজাইনটা আমার দেখে নকল করা বলে, তার সঙ্গে কলামের সংখ্যা বা ব্যবধান ড্রয়িং-এর সাথে মিলতো না। অনেক সময় এমনও হয়েছে, খাতায় ডিজাইনটা আইসোলেটেড ফাউন্ডেশন, কিন্তূ ড্রয়িং-এ পাইল ফাউন্ডেশন। মানে মোদ্দা কথা ডিজাইন এক জিনিসের আর ড্রয়িং অন্য এক জিনিসের। আমরা সাবধান করলেও প্রদ্যুত নিশ্চিন্ত ছিল এই ভেবে যে, কেউ এতগুলো ছেলেমেয়ের ড্রয়িং এক এক করে খুলে দেখবে না এবং একটা গড়পরতা নাম্বার দিয়ে দেবে। সত্যি বলতে কি কোনো সেমেস্টারেই এতোবড় গলতা করেও ধরা পড়েনি। নকল করতে গেলে সবাই নিজের নাম, রোল নাম্বার বাদে বাকি বিষয়টা টুকে দিতো। প্রদ্যুত বাকি বিষয়টাতে শুধু নিজের নাম আর রোল নাম্বারটা টুকে দিতো।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.