Wednesday, April 17, 2013

১০. প্রথম বর্ষের শেষার্ধ

-১০. প্রথম বর্ষের শেষার্ধ

বি ই কলেজে পড়ার সময় আমাদের সিনেমা দেখতে যাওয়ার জনপ্রিয় জায়গা ছিল সেকেন্ড গেটের কাছে ৪১ নং লক্ষী নারায়নতলা রোডে 'লিপি' সিনেমা হল। প্রথম বছরেই হাতেখড়ি অনেক সিনেমার ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দিয়ে যেমন - ডর, বাজিগর, ফির তেরি কাহানি ইয়াদ আয়ী। তারপর থেকে বিভিন্ন আনন্দে, দুঃখে, ফ্রাস্টুতে, ফুর্তিতে আর পুড়কিতে অনেক সিনেমাই দেখতে গেছি। বি ই কলেজের বিনোদনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল লিপি। তখন ডিভিডি প্লেয়ার, ইন্টারনেট, ইউটিউব এসব আসেনি। আর একটা ছিল ব্যাতাইতলা হয়ে হাওড়ার দিকে প্রায় ১৫ মিনিটের হাঁটা পথে জি টি রোডের উপড় – 'ঝর্ণা' যা এ চিহ্ন যুক্ত দুষ্টু সিনেমার জন্যেই প্রসিদ্ধ। এছাড়া মাসের শেষে বা কোনো পরীক্ষার শেষে পকেটে পয়সা থাকলে ধর্মতলা চত্বরে নিউ এম্পায়ার, এলিট বা রক্সি।

আরও একটা জায়গা ছিল নন্দন। যেটা আমাদের কাছে পরিচিত ছিল আঁতেলদের জন্যে। তবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা নন্দন নিয়ে একটু অন্য রকম। একবার আমাদের বছরের নটসূর্য বা নসুর সাথে নন্দনে একটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম 'দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন'। নসু আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বেশ কিছুক্ষণ আমাকে বাংলা তর্জমা করে মানেটা বুঝিয়ে উৎসহিত করার জন্যে। কিন্তূ অত ধীরলয়ের, তাও আবার 'ইনজিরি' সিনেমা দেখে বোঝার থেকেও আমার বেশী ভালো লেগেছিল মাত্র পাঁচ টাকায় গদি আঁটা পুশ ব্যাক আসনে বসে এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ জমিয়ে একটা ঘুম দিতে। শুনতে অবাক লাগলেও নন্দনে এটাই আমার ঘুমিয়ে দেখা বা না-দেখা একমাত্র সিনেমা। অবশ্য আসার পথে নসুর কাছ থেকে সিনেমার গল্পটা জেনে নিয়েছিলাম, অন্য বন্ধুদের বলে একটু নিজেকে বোদ্ধা হিসেবে প্রমান করার জন্যে। ফেরার সময় সেদিন বাস ধরবো বলে নন্দনের দিকের ফুটপাথে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ খটখট শব্দে পায়ে মই লাগানো মানে হাই হিল জুতো পরা কিছু বালিকা হেঁটে পেরিয়ে গেল। একটু দুরে যেতেই দেখলাম একজন বেকায়দায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কাঁধে ঝোলা আর একগাল দাঁড়িওলা এক আঁতেল বা বুদ্ধিজীবী সুর করে বলে উঠলো, "নারী, তুমি নারী বলেই কি আনাড়ি"

ফার্স্ট সেমেস্টারের পড়েই এলো জীবনের প্রথম রেবেকা (REBECA) - বার্ষিক সাংস্কৃতিক এবং পুনর্মিলন উৎসব - যা সদ্য ২০১৩ সালে ৭৫ বছর পূর্তি হওয়া ভারতবর্ষের সবথেকে পুরনো কলেজ ফেস্ট। আমাদের সময় এতো বেশী বিজ্ঞাপণের চটক ছিল না। চারদিনের বিভিন্ন মন মাতাল করা মুহূর্ত, লর্ডসের মাঠে বিশাল পান্ডেলের নিচে দেখা অমিতাভের ম্যাঁ আজাদ হুঁ, ইনস্টিটিউট হলে প্রাক্তনদের স্মৃতিচারণ - রবিবাসরীয় আড্ডা, ওভালের মাঠে পুরনো আর নতুনদের মধ্যে ফুটবল, অঞ্জন দত্তের গান, বলিউড নাইট, গানের সাথে যে যার মত কোমড় দোলানো সব মিলিয়ে বেশ জম্পেশ আনন্দ। অঞ্জন দত্তের গানের সময় হঠাৎ একটু সুর কেটে গিয়েছিল। একটা গানের লাইন ছিল 'একটা মেয়ে দশটা ছেলে দিচ্ছে শিস'। হাজির ছাত্ররা সেই সুত্রে একসঙ্গে শিস দিয়ে ওঠায়, হঠাৎ অঞ্জন দত্ত খার খেয়ে স্টেজ থেকে চলে গিয়েছিলেন। তারপর উদ্যক্ত্যাদের অনুরোধে ফিরে এসে কিছু গান করলেও, তাল কেটে গিয়েছিল। আমরাও তারপর আর তাঁর গানের সাথে উল্লাস দেখাইনি এবং অনেকেই নিজেদের হোস্টেলের দিকে চলে গিয়েছিলাম বা মাঠে বসে অঞ্জন দত্তের বাপ ঠাকুরদার উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য রেখেছিলাম।

তখন বছরে দুটো নির্বাচন হতো। একটা রেবেকার জন্যে, আর একটা ছাত্র সংগঠনের (BECSU)আমাদের প্রথম বছরে একে একে সব দলের সিনিয়াররা এসে নিজের দলের হয়ে প্রচার করে যেত। প্রথমবর্ষের ছেলেদের সেই সব প্রচারসভায় যোগদান ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। মুখ্য প্রতিদ্বন্ধিতা ছিলো কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ আর সি পি এমের ছাত্র সংগঠন এস এফ আই-এর মধ্যে। এছাড়াও ছিল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, আইস্যা, পায়সা নামে আরো কিছু দল। কলেজ জীবনে যদিও কখনো সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়িনি, তবু কিছু বন্ধুদের হয়ে অল্পসল্প  প্রচার বা কাজকর্ম করে দিয়েছিলাম। একটা সভায় মনে আছে কোনো এক সিনিয়ার বলেছিল 'যারা ১৮ বছর পার করেও রাজনীতি করেনা বলে, তাদের কোনো নীতি নেই'। কথাটা খুব মনে ধরেছিল। আমাদের কলেজ জীবনের প্রথম নির্বাচনে ছাত্র পরিষদ প্রায় সবকটা আসন পায় আর সাধারণ সম্পাদক হয় তৃতীয় বর্ষ মেকানিকালের ড্যাড। যথারীতি রেবেকার তিনটে আসনই ছিল ছাত্র পরিষদের দখলে। তবে বিভিন্ন দল থাকলেও রাজনৈতিক কাজিয়া খুব একটা ছিল না। শুধু ভোটের দিনগুলোতে একটু চাপা উত্তেজনা থাকতো, কিছু বহিরাগতের দেখাও মিলতো। কিন্তূ তার বেশী কিছু নয়।

অন্যান্য বিষয়ের সাথে সেকেন্ড সেমেস্টারে ছিল কম্পিউটারের উপড় প্রাথমিক পরিচয়। ক্লাস নিতেন সিভিলেরই এক অধ্যাপক, মানে ক্লাসে এসে নোট দেখে বোর্ডে টুকতেন। আর আমরা মন দিয়ে বোর্ড দেখে খাতায় টুকতাম। অনেকে আবার পরীক্ষার সময় সেগুলো চোতায় টুকতো আর চোতা দেখে পরীক্ষার খাতায়। মানে টোকা দিয়ে শুরু, টোকা দিয়ে শেষ। তবে কলেজের বিভিন্ন ধরনের টোকা বা চোতা পরের অধ্যায়ে। যাইহোক এই ক্লাসের মধ্যে মাঝে মাঝেই একটা ঘটনা ঘটতো। অধ্যাপক মহাশয় তার ছাত্রজীবনের খাতা দেখে লিখতেন যা বহু ব্যাবহারে জীর্ণ। তাই কিছু কমান্ড বা শব্দ তিনি নিজেই বুঝতে পারতেন না। যা দেখা যেতো না বুঝে তাই টুকে দিতেন আর আমাদের সহপাঠী - স্কুলেই কম্পিউটার শিখে আসা এক সহপাঠী অনান্থ রামাকৃশ্নান মাঝে মাঝে বোর্ডে গিয়ে ডাস্টার দিয়ে ভুল জায়গাগুলো মুঝে সংশোধন করে দিয়ে আসতো। অধ্যাপক মহাশয়ের তাতে আপত্তি ছিল না, বরং স্বস্তি পেতেন।

আর একবার আমি, মুন্সী, ভঞ্জ, অনান্থ এবং আরও কয়েকজন হাতেকলমে কম্পিউটার করার জন্যে একটা ফ্লপি সাথে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হাজির হলাম তিনতলার সিভিলের কম্পিউটার রুমে। তখন ছাত্রদের জন্যে যে সব কম্পিউটার ছিলো সেগুলোর কোনো কঠিন চাকতি (হার্ড ডিস্ক) ছিলো না, ফ্লপি দিয়ে চালু করতে হতো। একটা ছিল কালো রঙের সওয়া পাঁচ ইঞ্চির বড় ফ্লপি আর কিছু ছিলো সাড়ে তিন ইঞ্চির নীল বা কালো রঙের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফ্লপি। কম্পিউটার রুমে ঢুকতে গিয়ে বাঁধা পেলাম আরেক অধ্যাপকের কাছে। বজ্রগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন কোন ইয়ার। ফার্স্ট ইয়ার শুনে তাচ্ছিল্যের সাথে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে সেকেন্ড ইয়ারে আবার আমরা গুটিকয় যখন চেষ্টা করেছিলাম তখন আবার তাঁর সাথেই দেখা। আবার জানতে চাইলেন কোন ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার শুনে এবার প্রশ্ন ফ্লপিগুলো দেখি। ভয়ে ভয়ে একটা সাড়ে তিন ইঞ্চির নীল ফ্লপি এগিয়ে দিতে, তার ধাতব শাটার বা ঝিলমিলটা টেনে চোখের সামনে ধরে বলেছিলেন 'দেখ দেখ কতো ভাইরাস কিলবিল করছে। যা নতুন ফ্লপি নিয়ে তবে আসবি'। আজও বুঝতে পারিনি সেই অধ্যাপক মহাশয় খালি চোখে ভাইরাস কিভাবে দেখেছিলেন। যাই হোক শুনেছিলাম পৃথিবী আর জীবন দুটোই বৃত্তাকারে ঘোরে। প্রায় ১০ বছর পরে আমার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদেরই  ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপকদের একটা কম্পিউটার সফ্টওয়্যারের ট্রেনিং দেবার। তিনদিনের ক্যাম্পে সেই অধ্যাপক মহাশয়ও আমার কাছে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তবে আমি খালি চোখে ভাইরাস দেখানোর চেষ্টা করিনি।

দেখতে দেখতে চলে এলো সেকেন্ড সেমেস্টার বা প্রথম বর্ষের ফাইনাল। বি ই কলেজে জলের এতই সুখ্যাতি ছিল, যে অনেকেই জল কিনে খেত। তবে রান্নাতে তো আর কেনা জল ব্যাবহার হত না, তাই প্রথম বছরেই অনেকে জন্ডিস বাঁধিয়ে বসলাম। আমার মতো কয়েকজনের জন্ডিস হলো একদম পরীক্ষার শেষদিকে। তখনো অঙ্কসহ কিছু পরীক্ষা বাকি। গিয়ে হাজির হলাম সেই বিখ্যাত হাসপাতালে। তবে ১৫ নং হোস্টেলে আমাদের প্রথম বছরে এক ভোজে শুয়োরের মাংস হয়েছিল। সেটা চেটেপুটে খেয়েছি শুনে আমার ধর্মভ্রষ্ট হয়ে গেছে বলে আমার প্রয়াত দিদিমা এত রুষ্ট হয়েছিলেন যে পারলে আমায় তাজ্যনাতি করেন। যাইহোক প্রায় ৫-৬ মাস পরে আমার জন্ডিস হবার খবর পেয়ে উনি বলেছিলেন, 'দেখেছিস বলেছিলাম না শুয়োরের মাংস খাস না'। ফ্লপি ডিস্কের ভাইরাসের মতো এই ভাইরাসের অস্তিত্বও আমার মাথায় ঢোকেনি, যে ছ'মাস পরে নাকি প্রতিশোধ নিয়েছিল।

হাসপাতালে থাকার সময় বর্ধমান যাতায়াতের সঙ্গী সৌমিক, সিতাংশু বা একই ছাত্রাবাসে সঙ্গী সন্দীপ, সমিত, দেবরাজ এবং আরো কয়েকজন নিয়মিত এসে খোজখবর নিয়ে যেতো। কলেজ হাসপাতালে আমি একা ছিলাম না। আমার সাথে ভর্তি ছিল মালদার ছেলে ইলেকট্রিকালের অরিজিত। আরো অনেকে পক্স বা জন্ডিস নিয়ে ভর্তি ছিল। সন্ধ্যেবেলার ডাক্তারি পর্য্যবেক্ষণ শেষ হলেই টয়লেট যাবার অছিলায় অনেকে দেখে আসতো পান্ডিয়ার দিকে, যদি কিছু নজরে পরে। আর রাতের খাবার খেয়ে পরীক্ষার কথা ভুলে জমিয়ে তাস নিয়ে বসতো কেউ কেউ বা কেউ কেউ মন দিয়ে পরের দিনের চোতা তৈরি করতে। আমার হাসপাতালে যাবার খবর পেয়ে অনেক বন্ধুরা এসে বলে গেলো 'যাক তোর কপাল ফিরল, মস্তি করে চোতা করবি আর ফাটিয়ে নম্বর পাবি'। কিন্তূ নেহাত আনাড়ি ছিলাম বলেই অথবা জন্ডিসের জন্যে শরীর খুব দুর্বল থাকায় কোনো রকমে পরীক্ষা দিয়েছিলাম আর অঙ্কে কেবল পাশ মার্কটাই পেয়েছিলাম। তবে অরিজিতের পক্স থাকলেও অঙ্কের শেষ ২০ মিনিট অদ্ভুত দক্ষতায় পরীক্ষকের নজর এড়িয়ে আমরা দুজন এক বিছানায় বসেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম!

ফার্স্ট ইয়ারের শেষ মহাভোজের (Grand Feast) লোভ কাটিয়ে পরীক্ষার পরেই মায়ের সাথে বর্ধমান ফেরত গিয়েছিলাম। খুব ভিড় ছিলো সপ্তাহের শেষ দিন বলে। শরীর এতই কাহিল ছিল, মায়ের অনুরোধে টিকিট পরীক্ষকের সম্মতিতে সেটাই ছিল আমার একমাত্র  ট্রেনের লেডিস কামরায় ভ্রমন।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.