Tuesday, April 2, 2013

১. পথ চলা শুরু


বঙ্গীয় কারিগরী মহাবিদ্যালয়
===============

- . পথ চলা শুরু 

বি ই কলেজ নিয়ে আগের লেখাটার পর আরো কিছু লেখার দাবি আসায় অনেকবার অনেককিছু লিখতে শুরু করেও শেষ করিনি। কারণ আর কিছু নয় অনেক বন্ধু যাদের কিছু ছড়ানোর ঘটনা লিখলাম সে হয়তো এখন একটা বিশাল হনু হয়ে গেছে। আবার অনেকে আছে যাদের সাথে যোগাযোগ নেই, কোথায় আছে, কেমন আছে, আছে কিনা জানিনা। সব থেকে সোজা হয়ত নাম বদল করে লেখা, কিন্তু তাহলে অনেক মজাই হারিয়ে যাবে। তাই এখানে কলেজের চার বছরের কিছু টুকরো ঘটনা, সব দিক বাঁচিয়ে।

১৯৯৩-এর এক জুলাই মাসে বর্ধমান থেকে এসে নামলাম হাওড়াতে। আমার দুই দাদা (এক পিসতুতো আর এক জেঠতুতো) মালপত্রসহ একটা ছাগলছানাকে ছাড়তে এসেছিল সিনিয়ারদের হাতে জবাই হবার জন্যে। মানে শুরুর ভালবাসা (যেটাকে অনেকে Ragging বলে) সহ্য করে তারপর ইঁট, কাঠ, মেশিন নিয়ে নাড়াচাড়া করে যন্ত্রবিদ (ইঞ্জিনিয়ার) হব বলে। হাওড়া থেকে ৫৫ নম্বর বাস ধরে ৫৫ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে এসে হাজির হলাম বি ই কলেজে। কি মিল পরে জেনেছিলাম ক্লাসগুলোও নাকি সেই ৫৫ মিনিটেরই। দাদারা এসে আমার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে (হোস্টেল ১৫-র ৩০৭ নং রুম) আমাকে ছেড়ে যাবার পরেই মনে হলো - "এবার কি হবে। সবই তো অচেনা।" একটু আলাপ জমালাম একে একে আসা রুমমেটদের সাথে। একজন মেদিনীপুর থেকে দেবরাজ ঘোষ, একজন কলকাতার ডোভার লেন থেকে সন্দীপ মন্ডল আর একজন কিছুদিন ছিল, পরে পাশের রুমে চলে যায় রুদ্র সিরকার।

আস্তে আস্তে জানলাম কলেজে এলেই নাকি ফার্স্ট ইয়ার হয় না। আগে মুরগী থাকে, সিনিয়াররা বেশ করে (ভালোবেসে) চিবিয়ে খায় যে যেমন পারে, তারপর Ragging পিরিয়ড শেষ হলে ফার্স্ট ইয়ারের মর্যাদা পাওয়া যায়। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে। আমার মতই নতুন নতুন মুরগি, তাদের অভিভাবক। কারু মা হয়ত যাবার সময় বলতে বলতে যাচ্ছেন "বাবু রাতে একটু হরলিকস খাস। আর সকালে যদি পারিস একটু দুধ।" আর তার পাস দিয়ে কোনো সিনিয়ার-এর পিছু পিছু এক নতুন মুরগি সিড়ি বেয়ে উঠে আসছে, পরণে গামছা আর মাথায় নিজের অন্তর্বাস উল্টো করে পড়া। কিছু নতুন চরিত্রের সাথে সেই সন্ধ্যেতে আলাপ হয়েছিল। একজন গাল টিপে জানতে চাইলো "বাড়ি কোথায়"। আমি একটু আপত্তি জানানোয় হুকুম হলো "আয় চারতলার ঘরে, আমার নাম অমুক। না এলে কিন্তূ তোর .......... (3 Idiots-এর চমতকার) করে দেব"। ভয় পেয়ে গেলাম, গলা থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে কেটে পড়লাম। পরে জেনেছিলাম এই সব নামগুলো ছিল ছদ্মনাম, কোনো ভিতু মুরগি যদি কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে দেয় তাই এই ছলনা। 

এক সিনিয়ার এসে নতুন মুরগি পেলেই জানতে চাইত  বাড়ি কোথায়, বোন আছে কিনা। কেউ যদি বলে যে বোন আছে তাহলে তারপর শুরু হোলো আসল বিড়ম্বনা। বোনের খোঁজ নিতে অনেকেই হাজির হতো, আর তাকে শ্যালক বানানোর ইচ্ছে প্রকাশ করে যেত। এইভাবে সব হোস্টেলেই কমসে কম একজন করে সার্বজনীন "শালা" হয়ে যেত। কোনো সিনিয়ার তিনতলা বা চারতলার জানলার উপর উঠিয়ে বলতো এবার লাফিয়ে পড়। ঘরের মধ্যেই লাফিয়ে পড়া উচিত এটা অনেকের মাথায় আসতো না আর প্রায় পান্টে প্রসাব করার যোগাড় হতো। এছাড়া এসেই শিখতে হতো "মহায়ন" বা "প্রভাতকাল"-এর মত কিছু প্রার্থনাসঙ্গীত। দাবীমত সকাল সন্ধ্যায় সেগুলো সুর করে গাইতে হত দল বেঁধে। আমাদের অনেকের-ই প্রথম সিগারেটে টানটাও দাদাদের আবদারে। সে এক অদ্ভুত সমস্যা। সিগেরেট না খেলে "বাচ্চা ছেলে" আর খেলে "বেয়াদপ ছেলে, দাদাদের সন্মান দিতে শেখেনি"।

তারপর রাতের বেলায় শুরু হতো আসল ভালবাসা। প্রভাতকালে বা মহায়নের মত কিছু সঙ্গীত ছাড়াও আস্তে আস্তে আমরা শিখে যেতাম, কিছু প্রাকটিক্যাল ক্লাস হাওড়া - শিয়ালদহ - বজবজ অথবা তিনতলার কার্নিশ বেয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া। কোনো রুমে এক সাথে অনেক গুলো মুরগিকে নিয়ে শুরু হত আলাপ পরিচয়। একজন ছিল বানান বিশারদ, যেতে যেতে হঠাত জানতে চাইত কুজ্ঝাটিকা বা স্বরস্বতী-র বানান। না পারলে কান ধরে ১০টা উঠবস। তাও মানা যেত একদিন হটাত এক বিশাল হাঁচি পড়ল তার "হ্যাওওওচ্চোওও"। সাথে সাথে সামনে যারা ছিলো তাদের হুকুম হলো বানান করার। কতগুলো ও ছিলো ওই হাঁচিতে না বলতে পারলে আবার সেই কান ধরে ১০টা উঠবস। আর এই ১০ টা উঠবসের গণনা ছিলো বেশ অদ্ভুত। ১, , , , , , , , , ৯.১, ৯.২, ৯.৩, ৯.৪, ৯.৫, ৯.৬, ৯.৭, ৯.৮, ৯.৯, ৯.৯১৯.৯২, ৯.৯৩, ৯.৯৪, ৯.৯৫, ৯.৯৬, ৯.৯৭, ৯.৯৮, ৯.৯৯, ৯.৯৯১ .............. এতএব ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থ্যা। 

এর মাঝে কিছু দরদী সিনিয়ার ছিল। এসে পরম মমতায় গায়ে হাত বুলিয়ে জানতে চাইতো "খুব রাগিং করেছে তাই না"। তারপর একটু সমবেদনা জানিয়ে বলতো, দেখ আমরা চাই না রাগিং হোক, আমরা এসবের পরিবর্তন চাই। আমরা অমুক বিদ্যার্থী পরিষদ বা তমুক স্টুডেন্ট ফোরাম। তাই তোরা এর সদস্য হয়ে যা, আজ রাতে আমার সাথে চল, অমুক হলের এক রুমে কিছু ব্যানার লিখতে হবে। কেউ কেউ হাতের লেখা ভালো এমন কোনো মুরগিকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে গিয়ে নোট কপি করার কাজ দিয়ে বন্ধুদের সাথে তাস খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কোনো দাদা আবার রোজ চান করতে যাবার সময় কারু মাথায় মাখার তেল বা সাবান নিয়ে চলে যেত, মনে থাকলে বা মুড ভালো থাকলে যাবার সময় ফেরত দিয়ে যেত। হোস্টেলের ডাল ছিলো আমাদের কাছে একটা ভয়ঙ্কর জিনিস। খাবার টেবিলে ৩-৪ গ্লাস ডাল খেতে হত একটু বেচাল করলেই। 

সেই সময় যন্ত্রনা দিলেও কিছু কিছু Ragging বেশ মজার ছিল। কোনো প্রশ্নের মানে বুঝতে না পারলে ছড়িয়ে ফেলার পর  কোনো মুরগির কাজ হতো খাটের নিচে থেকে গর্ভবতী কিউলেক্স মশা ধরে আনার। অনেকেই চাইতাম এই কাজটা পেতে তাহলে খাটের নিচে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়া যেত। ছড়িয়ে ফেললে কোনো সিনিয়ারের হুকুম হতো অনুতাপের আগুনে দগ্ধ্য হতে হতে নিজের ঘরে চলে যাবার। এমন অভিনয় করতে হত যেন সত্যি সত্যি আগুনে গা পুড়ে যাচ্ছে। অভিনয় ঠিক থাক না হলে ৫ পয়সা বা ১০ পয়সাকে ফু দিয়ে ফুটবল খেলতে হত। আর যাই হোক রাত জেগে Ragging খাবার থেকে অনেক ভালো। কেউ কেউ চাইত নোট কপি করার কাজ, কেউ কেউ আবার পিছনের কার্নিশ বেয়ে, পাইপ বেয়ে এক ফাকে কেটে পরার তালে থাকত। শেষ দলে আমিও ছিলাম। বি গার্ডেন থেকে শেষ C6 ধরে গিয়ে উঠতাম কুমারটুলিতে এক দাদার বাড়ি, আবার পরদিন সকালে প্রথম C6 ধরে আবার কলেজ। ভালই চলছিল, শেষদিকে ধরা পরে গেলাম এক সিনিয়ারের কাছে যে ওই একই বাসে কলেজ আসছিল। তাই আমার Ragging পিরিয়ডটা এই অজুহাতে একটু দীর্ঘ হয়েছিল। 

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.