- ৩. পাতি পরীক্ষা
এদিকে দেখতে দেখতে Ragging পিরিয়ড শেষ হয়ে আসতো। শেষদিনে হতো "পাতি পরীক্ষা", যার সম্পূর্ণ বর্ণনা দেওয়া এখানে চলে না স্বাভাবিক কারণে। পরীক্ষার সিট পড়তো লটারি করে। কারো সিট তিনতলার ২নং টয়লেটে, কারো একটা ভাঙ্গা লকারের উপর বা কারো সিড়ির উপর। অনেক বহিরাগত পরীক্ষক আসতেন, তাদের নাম যেমন জমকালো, কাজকর্ম তেমনি বিটকেল। আমার রুমমেটের কাছে শুনেছিলাম হটাত ঘোষনা হলো জাপান থেকে আসছেন (আসলে পাশের কোনো হল থেকে) স্যার তাকিওনা মূতেআসী, তিনি দেখলেন এক মুরগি আলোর অভাবে নিজের সিট্ ছেড়ে একটু সরে এসেছে, সেই বেয়াদপির জন্যে খাতায় মাইনাস ১০ নম্বর দিয়ে চলে গেলেন। একজন নাকি ভাঙ্গা লকারের উপর, বসার জন্যে একটা খবরের কাগজ পেতে নিয়েছিল। তাকে টোকার দায়ে মাইনাস ২০। বাকি বহিরাগত পরীক্ষকদের নাম লিখলে আমাকে অশ্লীলতার দায়ে জেলে যেতে হতে পারে। অবশেষে প্রায় সবাই নেগেটিভ নম্বর পেত। পাস না করলে শাস্তি ছিল হোস্টেল ছেড়ে চলে যাবার বা থুতু ফেলে ডুবে মড়ার বা ১০ টা উঠবস।
আর প্রশ্নগুলোও যথারীতি সেন্সর-এর কোপে পড়বে। তবু লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষার কিছু শ্লীল প্রশ্ন:
## সিপাহী বিদ্রোহের দুজন সিপাহীর নাম বল? পারলে বা না পারলে পরের প্রশ্ন, তাদের দুজন পাড়ার লোকের নাম বল? অনেকেই বলতে পারতো না। ২ বা ৪ অক্ষরের সম্ভাসনসহ দাদারাই বলে দিত ওরে তুই আর তোর বাবা। খোঁজ নিয়ে দেখিস ১৮৫৭ সালে তোদের পাড়া থেকে একজন নিশ্চই সিপাহী ছিল। আর না থাকলে তোদের পাড়ায় সব দেশদ্রোহী। সেই পাড়ার লোকের এই কলেজে পড়ার যোগ্যতা নেই। অকাট্য যুক্তি।
## অঙ্কের প্রশ্নে থাকত ʃ x . dx, যদি upper limit = family আর lower limit = father হয়, তাহলে মায়ের শাড়ির রং কি হবে ? সোজা উত্তর, (family-father); মানে যে family তে father নেই, সেখানে মায়ের শাড়ির রং সাদা-ই হবে।
## লজিকের প্রশ্ন থাকত, যদি "গেলাস"-এর ইংরেজি "Glass" হয় তাহলে "Glass" এর বাংলা "কাঁচ" কেন?
## ঐতিহাসিক প্রশ্ন থাকত। সংজ্ঞা লিখতে হত। ভূগোল থেকে Aptitude কিছুই বাদ যেত না। তবে সবগুলো এখানে লেখা যাবে না।
তবে অনেকে তৈরি ছেলে, তারা সব ফাটাফাটি নম্বর পেত। বাকিদের জন্যে দুই বা তিন সপ্তাহের Probation Period (বা Ragging Period)। এই সময় একটা জিনিস শিখলাম, সেটা হলো দুনিয়ায় সব-ই "মায়া"। তাই মনকে তৈরি কর। কোনদিন দাদাদের মন হলো ক্লাস মায়া করে মনের সুখে Ragging করবে। তাই হোস্টেলে শুরু হলো জল বাওআলী। শোনা গেল হোস্টেল ১৫তে জল নেই, তাই ক্লাস বয়কট, মানে বনধ। পরে জানতে পেরেছিলাম এগুলো সব প্লান করে হত। কেউ গিয়ে ট্যাঙ্কের ভালভটা বন্ধ করে দিত, অথবা পাম্পের একটা তার খুলে দিত। জল না উঠলে কেউ চান না করলে, ক্লাস করবে কি করে। তাই বনধ। দুদিন পরে অন্য হোস্টেল। কোনদিন সাহেবপাড়ায়, পরদিন মুচিপাড়ায়। সেইদিনগুলো ছিল বেশি আতঙ্কের। কারণ সব সিনিয়াররা পাশের হল থেকে নিজেদের পুরোনো হোস্টেলে আসতো নতুন মুরগীদের সাথে আলাপ করবে বলে। আরও একটা জল বাওআলী সহ্য করতে হতো মুরগীদের। সেটা সাধারনতঃ ক্লাস করে মধান্যভোজনের বিরতিতে হোস্টেলে ফিরে আসার সময়। উপর থেকে ঝপাত করে গায়ে এসে পরত এক বালতি জল। জামা কাপড়, বই খাতা, ড্রয়িং বোর্ড সব ভিজে একাকার। Ragging শেষ হয়ে গেলেও সেটা সারাবছর চলত, নিজেদের মধ্যেই। অনেক সময় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যেত, কেউ "খার" বা "সেন্টু" খেয়ে গেলে। প্রায় সব কলেজেই কিছু নিজস্ব শব্দ বা ভাষা ব্যবহার হয়। কতকগুলো যেমন সহজেই বোধগম্য, কয়েকটার জন্যে একটু পাদটিকার প্রয়োজন। "খার খাওয়া" মানে রেগে যাওয়া আর "সেন্টু খাওয়া" মানে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাওয়া বা মন থেকে খারাপ লাগা।
দুই বা তিন মাত্রিক গালি কাকে বলে সেটাও জানতে পারলাম। মানে শুধু তিন বা চার অক্ষর মানে একমাত্রিক; তার সাথে অধস্তন বা উর্ধস্তন একপুরুষ যোগ করলে দুইমাত্রিক। তিন বা চারমাত্রিকগুলো বেশ জমজমাট হত। মানে যাকে দেওয়া হবে তার যেন মানে বুঝতেই এত সময় লাগে যে উত্তর দেবার সুযোগ না পায়। সব কিছুর-ই একটা ভালো ব্যাখ্যা আছে। যদি কেউ পাশ করার পর কোনো Construction Site-এ চাকরি পায়, আর কোনো ঝামেলার সময় কোনো শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ারকে বাপ মা তুলে গালি দেয়, তাহলে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে হাত পা চালিয়ে আরো সর্বনেশে দিকে না গিয়ে বা হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে চাকরি ছেড়ে না দিয়ে সেই ইঞ্জিনিয়ারবাবুও যেন একটু কাঁচা খিস্তি দিতে পারে এবং সেটা যেন পদমর্যাদা গুনে বেশ মানানসই হয়।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.