Tuesday, April 2, 2013

৪. বাঁধা গরু ছাড়া পেল

- . বাঁধা গরু ছাড়া পেল 

Ragging পিরিয়ড শেষ হতো একটা দারুন ভোজ দিয়ে, যেটাকে Grand Feast বলা হতো  সাধারন মিল যেটা হত  সেটাকে Mid Day Meal বলা যেতে পারে। মাঝে মাঝে একটু ভালো মেনু হতো যেটাকে বলা হতো I.D. (Improved Diet) মাসে এক কি দুবার। আর বেশ খাসা হতো Grand Feast বছরে এক কি দুবার সাধারনত সেমেস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার পর মেস বন্ধ হবার সময়। এই Grand Feast-টার সময় থেকেই অদ্ভুত পরিবর্তন হত। আমরা হীন মুরগি থেকে ফার্স্ট ইয়ারের মর্যাদা পেতাম, সিনিয়ার দাদারা হঠাত করে বাঘ থেকে বন্ধু হয়ে যেত। যারা এতদিন জান বার করে দিত, তারাই দরকারে জান দিয়ে দিত। এতদিন সিনিয়ার মানেই ছিল - দাদা, স্যার। যারা সেকেন্ড ইয়ার তারা প্রায় সবাই বলে দিত এরপর থেকে নাম ধরে ডাকতে। আর হাঁ, হঠাত জানতে পারতাম হাঁদা আসলে কৃষ্ণেন্দু পাল, ল্যামি আসলে শঙ্খকর ভৌমিক, রমেন আসলে সুমিত। আমাদের সুযোগ হতো এরপর প্রাণ খুলে সিনিয়ারদের সামনেই ধুমপানের এবং আস্তে আস্তে একটু মাকালির প্রসাদ হিসেবে কারণ সুধা পানের অথবা শিবের প্রসাদের কলকে সেবনের।

এরপর আমরাও বাঁধা গরু ছাড়া পেতাম। অন্য হোস্টেলে নিজেদের ডিপার্টমেন্টের বা শহরের ছেলেদের সাথে গিয়ে বন্ধুত্ব পাতানোর, একা ঘুরে বেড়ানোর, লর্ডসের মাঠে শুয়ে আকাশের তারাদের দিকে মুখ করে ধোঁওয়া ছাড়ার। কেউ কেউ হয়তো Boxing Ring বা Pandiya-র দিকেও চক্কর কাটত। তবে এদের মধ্যে অনেকেই কোনো পাড়াতুতো বোনের সাথে দেখা করতে যেতো, যাদের অনেকেরই সম্পর্ক কলেজ ছেড়েও টিকে গেছে। আর অনেকে ছিল স্বাত্তিক বা ওই রসে বঞ্চিত। সেই সব বঞ্চিতের দল মিলে খুব পিছনে লাগতাম এদের, অসময়ে হাজির হয়ে যেতাম এল স্কোয়ার বা লাভার্স লেনে অথবা নেতাজি ভবনের স্টেডিয়ামে অথবা বক্সিং রিং-এর আশেপাশে। এইসব জনগণ হোস্টেলে ফিরে এলে তাদের বোর করাও হতো, যতক্ষণ না স্বীকার করে।  জানতে চাওয়া হত পান্ডিয়াতে আজ মেনু কি?

কারণ একটা গল্প চালু ছিল কোনো একবার নাকি কোনো I.D.-তে পান্ডিয়াতে নাকি ডিমের ডেভিল হয়েছিল। আর যারা ছিল না তাদের জন্যে মেট্রন ব্যবস্থ্যা করে দিয়েছিলেন যাতে ফিরে এসে তারা তরুনদার কেবিনে (বসন্ত কেবিন) তাদের প্রাপ্য ডেভিল কোনো এক বিকেলের টিফিনে খেতে পারে। সাধারনত সব হোস্টেল বা হলে I.D.-তে হতো মুরগি বা খাসির মাংস। কারু সুবাদে গল্প রটে গেল  পান্ডিয়াতে মাসিক মেস ফি এতো কম হবার কারণ, ওরা I.D.-টে হাফ ডিম খায়। ঘটনাটা কবে হয়েছিল কেউ জানে না, কিন্তু যে কোনো সহপাঠিনীকে একটু "হেটা" (মানে পিছনে লাগা) করতে এটা একটা চালু গল্প।

অনেককে আবার শোনানো হতো সেই পুরনো জোকস। একটা হীরের আংটি ঘিরে দাড়িয়ে আছে চারজন নারী। যুবোরানী ডায়না, ডায়না ওয়াকার (অরণ্যদেবের পত্নী), বি ই কলেজের এক সুন্দরী ছাত্রী এবং অপ্সরা উর্বশী। আংটিটি কে পাবে? উত্তর ছিল যুবোরানী ডায়না, কারণ ১৯৯৭-এর আগে যুবোরানী ডায়না বেঁচে ছিলেন, তাই তিনিই একমাত্র জীবিত চরিত্র, বাকি সবাই কাল্পনিক। আসল বক্তব্য ছিল বি ই কলেজে কোনো সুন্দরী মেয়ে পড়ে না। ঘটনাটা সত্যি নিশ্চই নয়। হলে এত ছেলে কলেজের সহপাঠিনী বা জুনিয়রদের উপর "ফ্রাস্টু খেত" (মানে ভালো লাগা) না। আসলে কিছুদিন পিছনে ঘুরেও লাভ না হলে বা কোনো প্রেম কেটে গেলে এসব বলে একটু মনের জ্বালা মেটানো। মানে ওই আঙ্গুর ফল টক। আর তাছাড়া অন্য একটা উপায় তো মানুষ নিয়ে থাকে, তা হলো মনে মনে বা নিকট বন্ধুদের কাছে  যার উপড় খার তার, তার পিতামাতা, উর্ধস্তন চতুর্দশ পুরুষের গুষ্টির ষষ্ঠিপূজা করা।

তবে আবার একটা গল্প চালু ছিল। গল্প নয় সত্যি ঘটনা। আমাদের আসার অনেক আগেই হয়েছিল যার জীবনে তিনি কলেজের তখন (এখনও) এক প্রফেসর। তাই নাম না বলাই ভালো। মুচিপাড়া থেকে কলেজ আসতে গেলে ওভাল আর উল্ফেনডেন হলের মাঝে একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি ছিল যেটা এখন নতুন করে সারাই হয়েছে। ওটাকে অনেকে মাইকেল মধুসুদনের বাড়ি বলেই জানে। আমাদের কাহিনীর নায়ক তখন বি ই কলেজের ছাত্র, মুচিপাড়ার এক হোস্টেলে থাকে আর নায়িকা তখন মডেল স্কুলের ছাত্রী। অনেকদিন ইস্কুল ছুটির সময় নায়ক খালি হাতে, নোটবুক হাতে বা কোনো ফুল হাতে দাড়িয়ে থাকত, সুযোগ খুঁজত কবে সেই দিন আসবে যখন সেই ফুল নায়িকার হাতে দিয়ে বলবে "প্রিয়ে, তুমি আমার ভাঙ্গা দাওয়ায় স্বর্ণচাঁপা রাজেন্দ্রাণী" বা গাইবে "এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে"। নায়িকাটির মনে কি হতো জানা না গেলেও যাবার পথে একটু হাসি উপহার দিত বা বান্ধবীদের নজর এড়িয়ে একটু পিছন ফিরে তাকাতো নায়কের দিকে, যেটাকে কলেজের ভাষায় বলা হত "ঝাড়ি মারা"। একদিন এক বর্ষার দিনে নায়ক দাড়িয়ে আছে; নায়িকার স্কুল ছুটি হয়েছে; সবার এক ড্রেস আর মাথায় ছাতা; নায়ক "ঘেঁটে গেছে" (মানে confused); বুঝতে পারছে না কে সেই নায়িকা আর কে তার কোনো বান্ধবী; বিচলিত হয়ে  শ্যাওলা ধরা সিড়িতে উপড় নিচে করতে গিয়ে পা পিছলে দড়াম; বেশ ভালো চোট পেয়েছিল আর তার সাথে হাত ভেঙ্গে আমাদের সেই বিখ্যাত হসপিটালে ভর্তি হতে হয়। নায়িকা হয়ত সেদিন স্কুলেই আসেনি বা এলেও এসব দেখেও স্লো মোশনে দৌড়ে আসেনি আর পিছনে একশটা ভাওলিন বাজে নি। বন্ধুরাই নায়ককে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে, হাতে প্লাস্টার করিয়ে হসপিটালে ভর্তি করে এসেছিল। আর উপদেশ দিয়েছিল এরপর থেকে আলুর দোষটা ত্যাগ করার। নায়কও ভগ্নমনে তাই মেনে নিয়েছিল। এই কাহিনীর এখানেই শেষ হত বা হওয়া উচিত ছিল। 

কিন্তু কহানী মে টুইস্ট থা। তিন-চার দিন পরে সেই নায়িকা এক সিঁদুররাঙ্গা মেঘের পড়ন্ত বিকেলে টিউশন পড়তে যাওয়ার ফাঁকে একগোছা ফুল নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। তারপর লাভার্স লেনে শরতের কাশফুল, শীতের দুপুরে বি গার্ডেনের গঙ্গার পাড়, ফুল না ফোটা বসন্তে বক্সিং রিং পেরিয়ে সেই নায়িকা আজ সেই নায়কের ঘরণী। 

এসব ছাড়াও অনেক নতুন নতুন জিনিস বা চরিত্র হুরমুর করে এসে হাজির হত আমাদের জীবনে, চিরন্তন দাবি মেনে। যারা সাহেবপাড়ায় থাকতাম, মানে হোস্টেল ১৪, ১৫ আর ১৬, তাদের কাছে বাইরের জগতের সোজা রাস্তা ছিল ফার্স্ট গেট। আর যারা আসত হোস্টেল ৭, , , ১০ আর ১১ তে, তাদের কাছে সেকেন্ড গেট। আর একটা ছিল থার্ড গেট, যেটা দিয়ে যাওয়া যেত গঙ্গার ঘাটে, বি গার্ডেনে বা মেইন বাস ডিপোতে। ১৯৯৩ সালে হাতের কাছে মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট তখন অনেকটা জুলে ভার্নের গল্পের মত। ১৯৮৫ তে ভারত সরকার টেলিগ্রাফ আর পোষ্টালকে আলাদা করে দিলেও শ্যাম পিত্রোদার টেলিকম বিপ্লব তখনও ঘটেনি। তাই দিনের বেলায় হাওড়া থেকে বর্ধমান ফোন করতে প্রায় মিনিটে ত্রিশ টাকা লাগতো, সন্ধ্যে ৭ টার পর সেটা একটু কমতো, ৮টার পর অর্ধেক হতো আর নটা বা দশটার পর এক চাতুর্তাংশ হতো। তাই ওই সময় টেলিফোন বুথের সামনে লাইন লেগে যেত আর ফোন পাওয়া মানে হাতে স্বর্গ পাওয়া।

সব হোস্টেলের প্রত্যেক তলায় একটা করে ক্যান্টিন থাকত। বিভিন্ন মেস কর্মচারীরাই ভাগাভাগি করে সেগুলো চালাত সকাল আর সন্ধ্যে বেলায়। এছাড়াও ছিল ফার্স্ট গেটে তরুনদার বসন্ত কেবিন, ভাবীর পুরী, অর্ন্নপূর্না মিষ্টান্ন ভান্ডার, সেকেন্ড গেটের কাছে জ্যাঠামশাই মিষ্টান্ন ভান্ডার বা কোলে মার্কেটের ছেঁড়া পরোঠা। আর কখনো মেস বন্ধ থাকলে ফার্স্ট গেট থেকে ব্যাতাইতলার দিকে সস্তায় পুষ্টিকর শ্যামদার হোটেল। ব্যাতাইতলা রেলগেট পেরিয়ে গেলে দাসুদার গার্ডেন বার, তার চেহারা আর মেনু ১৯৯৩ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত্য একই রকম জঘন্য কিন্তূ সস্তা বলে বি ই কলেজের জনতার কাছে বেশ জনপ্রিয়। কিছু হুজুগে জনতা চলে যেতে মন্দিরতলা পরোটা আর গোমাংসের কাবাবের স্বাদ নেবার জন্যে অথবা আন্দুল রোডে কলেজঘাট বা গেস্টকিনের গেটের কাছে সর্দারজির ধাবাতে। আর ছিল কলে মার্কেট ঢোকার মুখে ভাবীজির গঞ্জিকার দোকান। আরো কিছু ছিলো এই রকম জায়গা, কিন্তূ সঙ্গত কারণেই না লেখাই ভালো, যেটা লিখলাম সেটা অনেকদিন উঠে গেছে আর সেখানে একটা ফ্লাটবাড়ি হয়েছে। একটা চিপ স্টোর ছিল I. Hall-এর গায়ে সব বই খাতা ইত্যাদির জন্যে, যেটাকে আমরা চিট স্টোর বলতাম। স্টোরের মালিক ছিল দেবেন্দ্রনাথ জানা, সেটাকে নিয়ে মজা করে বলা হত "দেবেন জানা, উনি কি দেবেন জানা আছে"। আর ছিল আমাদের কলেজ ক্যান্টিন বা খুরশিদদার ক্যান্টিন। আমাদের ক্লাস কেটে আড্ডা মারা, টেবিল চাপড়ে বেসুরো গান করা, মাঝে মাঝে সিনিয়ারদের কাছে Rag হওয়া, Sessional-এর শেষ কাজ, রাত জেগে I. Hall সাজানো থেকে আজও কলেজে গিয়ে যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেভাবে খুশি বসার জায়গা। আর সেই বকুলতলা, সেটার গল্প অন্য এক অধ্যায়ে।

আর একটা কথা না বললে প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। Ragging Period শেষ তারপর হত সব ডিপার্টমেন্টের Freshers' Welcome, তাতে অল্প করে সিনিয়াররা জুনিয়ারদের একটু বোর করতো। নতুনদের স্টেজে তুলে তাৎক্ষনিক বক্তৃতা দিতে বলা হত অদ্ভুত কিছু টপিক দিয়ে এসবের কিছু পরে সব হোস্টেলের সব ফ্লোরে একটা করে পিকনিক হত, সেটা হলো ফ্লোর ফিস্ট। সেই ফ্লোরের সব সিনিয়ার যারা বিভিন্ন হলে চলে গেছে তাদেরকেও নেমন্তন্ন করে আনা হত। তাতে বেশ মাস্তি হত, আলাপ পরিচয় হত, খাওয়া দাওয়া হত আর হত নামকরণ। একে একে সব ফার্স্ট ইয়ারকে একটা টেবিলে উঠে পিছন ফিরে দাঁড়াতে হত, সিনিয়াররা সর্বসম্মতিক্রমে তার একটা নাম দিত, যারা স্বীকার করত তাদের বোন আছে তাদের মধ্যে কেউ হত শালা, কেউ নাটুকে ঢঙে কথা বলে তাই নটসূর্য বা নসু, কেউ পাখি, কারো বাড়ি ভোগপুর বলে তার নাম ভোগপুর, কেউ রোগা বলে খেঁচি, কেউ লম্বা হলে লগা, কেউ ল্যামির মত দেখতে বলে আইসটোপ বা আইসো, আবার কোনো কারণ ছাড়াই কুত্তা, লাগু, হাগু, ভগা, চু, কাকু, মৃত, কালী, তিগু, বেচু, বগা, ছাগল, ভেড়া, মামা, কাকা, সেক্সি, বৌদি ইত্যাদি। যার নামকরণ হলো তাকে পিছন ফিরে দাড়িয়ে দুপায়ের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে একটি বিশেষ অঙ্গ চেপে ধরে বলতে হত, "আমি অমুক নাথ তমুক, আজ হইতে আমি আমার পৃতিদত্ত নাম পরিত্যাগ করিয়া ছাগল নামে পরিচিত হইলাম"। ঘোষনা শেষ হলেই সবাই মিলে সমস্বরে হুস হুস করে উঠলেই তাকে টেবিল থেকে লাফিয়ে চলে যেতে হতো। বেশ অভিনব ছিল ব্যাপারটা।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.