Tuesday, April 9, 2013

৯. পূর্বকথা এবং প্রথমার্ধ


- ৯. পূর্বকথা এবং প্রথমার্ধ 

তিহাস থেকে আবার ফিরে আসা যাক স্মৃতিচারণে। আমার বাবা ছিলেন রাজ্য সরকারের নিবন্ধীকরণ বিভাগের কর্মচারী। অবসর নেন ২০০৬ সালে ডি আই জি, রেজিস্ট্রেশন হিসেবে। বাবার চাকরির সুবাদে আমার পড়াশুনো হয়েছে বিভিন্ন শহরে। প্রত্যেক জায়গায় দুই বা তিন বছর করে থাকতাম, নতুন বন্ধু হতো, আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্য শহরে; হয় পদোন্নতির সুবাদে বা নিয়মাফিক বদলির জন্যে। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নদীয়ার বেথুয়াডেহারীতে। মনে আছে তখনও স্কুলে ডাবল প্রমোশন পদ্ধতি চালু ছিল এবং আমার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার সেই  যোগ্যতামান স্পর্শ করার। তারপর বর্ধমানের মঙ্গলকোট, পুরুলিয়ার ঝালদা, দক্ষিন চব্বিশ পরগনার জয়নগর মজিলপুর ঘুরে মাধ্যমিকে বসেছিলাম পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থেকে। তারপর আমরা চলে আসি বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনাতে। 

আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসাটা অনকেটা পাকেচক্রে পরে। ১৯৯৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক দেবার আগে আমার অনেক সহপাঠী আসে বাবার কাছে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফর্মে এটেস্টেড করানোর জন্যে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, আমার সহপাঠীদের কাছ থেকে জেনে বাবা মায়ের ইচ্ছাপূরণের জন্যে একদম শেষ পর্যায়ে আমি ফর্ম তুলে আনি। আমার নিজের ইচ্ছে ছিল পদার্থ্যবিদ্যায় স্নাতক পড়ার, তাই জয়েন্ট এন্ট্রান্সের (যুগ্ম অনুপ্রবেশ) পরীক্ষাও দি' অনেকটা গাছাড়া ভাবে। মনে আছে রসায়নের কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার পর যখন কিছুই মাথায় ঢুকছে না আর পাশের মাঠ থেকে মাইকে ভেসে আসছে 'ও লাল দোপাটে বালি  তেরা নাম তো বাতা'; আমার মতই অবস্থ্যা এমন দু চারজন বন্ধুর সাথে বেঞ্চ বাজিয়ে সঙ্গত দিতে যাওয়ায় পর্যবেক্ষক জোর করে আমাদের খাতা নিয়ে জামা করে নেন ও আমাদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে বের করে দেন। আমারও খুব একটা অসুবিধে ছিল না, কারণ যা লিখেছিলাম তাতে পাশ করার সুযোগ ছিল না। আর শুনেছিলাম জয়েন্ট বড় শক্ত, এইসব মফস্বল শহর থেকে সহজে কেউ সুযোগ পায়না, আর পেলেও তার জন্যে বিশেষ তালিম নিতে হয় কলকাতায় গিয়ে এবং দুতিন বছর লেগে থাকতে হয়। আসলে সত্যি বলতে জয়েন্ট সম্বন্ধে খুব একটা স্পষ্ট ধারনাই ছিল না।

তবু যে কিভাবে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম সেটা নিজের কাছেই রহস্য। পরে জেনেছিলাম জয়েন্টে পদ্ধতিটাই অন্যরকম। আমি কতটা ভালো পরীক্ষা দিলাম, তার থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ বাকিরা কতোটা খারাপ দিল। সব থেকে বিপদ হলো কলেজগুলিতে স্নাতকে সুযোগ পাওয়া প্রার্থীদের নাম বেরোনোর আগেই জয়েন্টের নাম বেরিয়ে গেল। ডাক্তারীতে দ্বিতীয় তালিকায় নাম বেরিয়েছিল, তাই সেটা আমার পদার্থ্যবিদ্যায় স্নাতক পড়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে দিলেও; ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রথম তালিকাতেই কালনা শহর থেকে সেই বৎসর একমাত্র আমার নাম দেখে অন্যরা যত চমকিত হয়েছিল, তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম আমি নিজেই। আরো একটা কারণ ছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে দু-তিনমাস বাড়িতে বিভিন্ন চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা এবং আমার নিজের উৎকণ্ঠাজনিত মানসিকবিকার বা এংজাইটি নেউরোসিসে আক্রান্ত হওয়া। কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়েছিল সেই দুই সহপাঠী যারা আমাকে জয়েন্টে বসানোর জন্যে বাবাকে প্রভাবিত করেছিল।

আমার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ক্রম হয় ১১৪৩। জয়েন্ট সম্বন্ধে ধারণা না থাকাতে এবং পদার্থ্যবিদ্যা পড়ার সুপ্ত ইচ্ছায় আমি প্রথম জয়েন্টের বিবরণপত্র খুলে হিসেব করতে বসেছিলাম সর্বমোট আসন সংখ্যা। সব কলেজ মিলিয়ে যে তালিকা ছিল যোগ করে দেখলাম মোট স্থান প্রায় ৯৫৩, তাই সদর্পে ঘোষনা করে দিলাম আমার দ্বারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হবে না। সত্যি বলতে কি আমার মোটা বুদ্ধিতে সেটাই বুঝেছিলাম। এত শক্ত পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে কেউ আমাকে জায়গা ছেড়ে দেবার কোনো কারণ দেখতে  পাই নি। তবু বাবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবার জন্যে খোজখবর নিয়ে ঠিক করলেন বর্ধমান শহরের এক নামকরা বিজ্ঞানের শিক্ষকের কাছে যাবেন। ঠিক করা দিনে কালনা থেকে এসে সর্বমঙ্গলা পাড়ায় ওনার বাড়ীতে হাজির হয়ে দেখলাম, খুব নামডাক আর প্রচণ্ড ব্যস্ত। বাড়িতে শিক্ষাদানের বহর দেখে সম্ভ্রম হয়। টিউশন পড়ার জন্যে কয়েক শত সাইকেল বাড়ীর নিচে দাঁড় করানো। তার থেকে বেশী সংখ্যায় সাইকেল শুধু ইষ্টিশানেই দেখেছি। শিক্ষক মহাশয়কে বাবা আমার পরিচয় দিয়ে পরামর্শের উদ্দেশ্য বলায় তিনি হাসি মুখে একঘর ছাত্রছাত্রীর সামনে বললেন 'হুম, আমি দেখেই বুঝেছিলাম আপনার ছেলের প্রতিভা আছে। আর দেখেছেন তো কেমন তালিম দিয়েছি এক সুযোগেই লাগিয়ে ফেলেছে'। আমি অবাক, বাবাও হতভম্ব হয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, 'আজ্ঞে, আমরা তো কালনাতে থাকি। আমার ছেলে ওখান থেকেই পড়াশুনো করে সুযোগ পেয়েছে। অমুকের কাছে শুনে আপনার কাছে একটু পরামর্শ নিতে এসেছিলাম'। কয়েকজন দেখলাম হাসি চাপার চেষ্টা করছে, আর বাবার ওই অকপট সত্যভাষণে শিক্ষকমহাশয় খুব বিরক্ত হয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে এবার বললেন, 'এই ক্রম নিয়ে কি আর হবে? দেখুন যদি জলপাইগুড়িতে সিরামিকসে সুযোগ পায়'। বাড়ী ফিরে দেখলাম জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মৃৎশিল্প বা সিরামিকস নেই। তাই আবার ধরে নিলাম দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই। যাক পদার্থ্যবিদ্যা নিয়ে মন দিয়ে পড়া যাবে। 

তবু আমি যে শেষ পর্যন্ত্য বি ই কলেজে হাজির হয়েছিলাম তা হয়ত উপরওয়ালার ইচ্ছে। না হলে হয়তো অনেক কিছুই জীবনে ঘটতো না বা অনেক কিছুর অভাব থেকে যেত। যাই হোক আমাদের সময় সুযোগ পাওয়া ছাত্রদের ঝাড়াই বাছাই করার কাজটা হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেষ পর্যায়ে হঠাৎ করে দুর্গাপুর না যাদবপুর না শিবপুর এই দোলায় দুলতে দুলতে শিবপুরের সিভিলটাই বেছে ফেললাম।

এরপর আস্তে আস্তে কলেজের নিয়মকানুন পাড় করে আর শুরুর সেই সব দিনগুলি পেরিয়ে কেমন করে আস্তে আস্তে বি ই কলেজের ছেলে হয়ে গেলাম সেটা আগেই কিছুটা বলেছি। কলেজকে আমরা গ্রাস করলাম আর কলেজ আমাদের গ্রাস করলো। শুরুর ক্লাসগুলোর থেকেও বেশী মন টানতো খুরশিদদার কলেজ কান্টিন। অনেক সময় পাঁচ মিনিটের জন্যে গিয়ে এক ঘন্টার আগে ফিরে আসতে পারতাম না। প্রথম দিকের খাতা বই ছাড়াও সাথী ছিল একটা করে ড্রয়িং বোর্ড। রেওয়াজ ছিল আগের বছরের ছেলেদের কাছ থেকে কম দামে বই বা অনান্য জিনিস পত্র কিনে নেবার। ড্রয়িং ক্লাসে মজা হত অনেক, বেশ একটা পিকনিক করার মত অনুভুতি। পিছনের জনের অঙ্কনের পাতা থেকে কাঁটা মেরে মাপ টুকে নিজের পাতায় বসানো। আর ঘাড়ে করে অঙ্কনের যন্ত্রপাতি আর বগলে ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে ক্লাসে আসা আর ক্লাস শেষে হোস্টেল ফেরত আসা। ছিলাম ছাত্র, হলাম শিক্ষিত কুলী। এই ক্লাসের অধ্যাপক ছিলেন প্রোঃ মুস্তাফা। থাকতেন কলেজ বিল্ডিং-এর কাছেই, ১৪-১৫ নং ছাত্রাবাসের পিছনে অধ্যাপকদের জন্যে নির্দিষ্ট বাসস্থানে। মনে আছে আমাদের শেষ দিকে উনি অবসর নিয়ে নিয়েছিলেন। নাম হয়তো মনে রাখতেন না, কিন্তূ রোল নম্বর ছিল মুখস্ত। অনেকদিন পরে হঠাৎ দেখা, অভিবাদন করতেই বললেন 'রোল নম্বর ৬৭, কি খবর'?

এছাড়া ছিল কিছু অবিভাগীয় বিষয়। কিছু কিছু বিষয় কেন ছিল, পড়ে কি লাভ হতো বুঝতে পারিনি। সেই সব ক্লাসের শিক্ষকরা ছিলেন আমাদের ভাষায় 'সাদা নেংটি', 'কালো নেংটি', 'লাস্কি', 'বেগুন', 'কালো মিঠুন' ইত্যাদি। অনেকেই ইংরিজিতে শিক্ষাদান করতেন। তাদের বিজাতীয় ভাষার স্বজাতীয় উচ্চারণ অনেক সময় আমাদের মত মফস্বলের ছেলেদের মাথায় ঢুকত না। তবে সবাই যে আমার মতো ছিল, তা নয়। কেউ কেউ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে এসেছিল বা বাইরের কোনো রাজ্য থেকে। তাই ভরসা হতো জেরক্স সেন্টারে গিয়ে যারা বুঝত বা না বুঝে টুকতো, তাদের খাতার নকল করা। আবার অনেকে একটা অদ্ভুত  ভাষায় কথা বলতো, যেটা বাংলা, ইংরিজি আর হিন্দির জগাখিচুড়ি। মনে আছে আমাদের ক্লাসের এক সহপাঠিনীর সিনেমাহলে গিয়ে পায়ের উপড় দিয়ে ছুঁচো চলে যাবার বিবরণ। অন্য এক বান্ধবীকে যা বলতে শুনেছিলাম সেটা এইরকম, "জানিস তো কাল লিপিতে মুভি দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তূ হলটা কি ডার্টি! হঠাৎ অন্ধকারে আমার পায়ের উপড় দিয়ে একটা মোল স্ক্রল করে গেল আর আমি ভয়ে স্ক্রিম করে উঠলাম। থাঙ্কস গড ভাগ্যিস কোনো স্নেক ছিল না। আমার তো ভাই ভয়েই হার্ট এট্যাক হয়ে গিয়েছিল"

প্রথম বছরে রাগিং পিরিয়ড শেষ হবার পড় একটু নিশ্বাস ফেলে চারদিকটা ঘুরে দেখতে দেখতেই চলে এলো মিড সেমেস্টার পরীক্ষা। কোনো রকমে বুঝে উঠার আগেই প্রথম পরীক্ষা শেষ। সিনিয়ার দাদারা ভরসা দিলো এতে পাস বা ফেল করলেও চূড়ান্ত মূল্যায়নে কোনো ফারাক পড়বে না। মোটামুটি সবাই বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে শেষ করলো। তার কিছুদিন পরেই ফার্স্ট সেমেস্টার। আমরাই ছিলাম ডিমড ইউনিভার্সিটির প্রথম ব্যাচ। তাই জানলাম আমাদের সময় মুল্যায়ন পদ্ধতি একটু বদল হবে। এতএব একটু মন দিয়ে পড়ো মানে গাঁতাও। কলেজে সব কিছুর একক থাকত সব ইয়ারেই। যে বেশী ছড়ায় সে হলো ইউনিট বা একক। ধরা যাক দিন্দা বলে কেউ যখন তখন ছড়ায়। কেউ খুব ছড়িয়ে ফেললে আমরা হইহই করে বললাম তুই ৩ দিন্দা ছড়িয়েছিছ। সেরকম কতটা পড়াশুনো করছে সেই অনুসারে কতো ইউনিট গাঁতালো। মেয়েরা সাধারনতঃ বেশী পড়াশুনো করতো আর অনেক সময় রেজাল্টও ভালো করতো। খুব কম মেয়ে ছিল যারা পরীক্ষায় ছড়াতো। এর একটা সাধারণ ব্যাখ্যা ছিল যে মেয়েদের করার কিছু ছিলনা, তাই হাফ ডিম খেত আর গাঁতাতো। স্বাভাবিক কারণেই আমি এই ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলতে পারব না। তবে ছেলেদের হোস্টেলে সারা বছর হইচই বা অন্যান্য পাঠক্রমের বাইরের বিষয় ও কারণ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকা হত।

ফার্স্ট সেমেস্টারে বিষয়গুলো থাকতো সব বিভাগেই সমান। অঙ্ক, পদার্থ্যবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্কন এইসব ছাড়াও থাকতো সেসনাল, মানে ল্যাব। পদার্থ্যবিদ্যা বা রসায়নের ল্যাবে কোনো অজ্ঞাত বা অনুমেয় কারণে কিছু বিশেষ বা সুন্দরী ছাত্রীরাই বেশী নম্বর পেত আর বাকিদের কপালে জুটতো একটা কিছু গড়পড়তা নম্বর। তবে এতে সেইসব ছাত্রীদের কোনো দোষ বা গুন না থাকলেও, সেইসব ল্যাবের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক বা সহকারীদের চরিত্রের একটি দোষই বেশী দায়ী। যেটাকে অনেকে আলুর দোষ বললেও, দোষটা নিরামিষ না আমিষ সেই নিয়ে তর্ক চলতে পারে। আর থাকতো কিছু ওয়ার্কশপ, যেমন ওয়েল্ডিং, কার্পেনট্রি ইত্যাদি। সেই সব ওয়ার্কশপ যে কেন করতে হতো আজও বুঝে উঠতে পারিনি। তবে সত্যি বলতে কি আমরা খুব কমই করেছি, প্রায় পুরোটাই করে দিত সেই সব ওয়ার্কশপের ভারপ্রাপ্ত সহকারীরা। হয়তো আমাদের হাতে পড়ে সরঞ্জামের পঞ্চত্বপ্রাপ্তির ভয়েই।

সবথেকে বেশী উৎপাত ছিলো দুটো অদ্ভুত বিষয় নিয়ে। একটা সামাজিক বিজ্ঞান বা Socio বা সোশ্যাল সাইন্স এবং আর একটা প্রযুক্তিগত যোগাযোগ বা টেকনিকাল কমিউনিকেশন বা TCMN বা সোজা কথায় ইংলিশ। সোশ্যাল সাইন্সে তবু কিছু বুঝে ওঠা যেতো, কিন্তূ TCMN-এর সিলেবাসটা কে বা কারা আবিস্কার করেছিলো সেটা অনেক ইতিহাসে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে সেখানো হত ING ওয়ার্ড, মানে যে সব শব্দ ING দিয়ে শেষ হয়। এরকম আরো ছিল ANT ওয়ার্ড, TION ওয়ার্ড। সেগুলো থেকেই আবার পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো। তাছাড়া সিনিয়াররাও যেহুতু এগুলো শোনেনি তাই মিথ্যা অভয় দিয়েছিলো যে এই সব ফালতু বিষয়ের নম্বর কোনো ভাবেই কাজে আসবে না। তাই এগুলোর ক্লাস নিয়ে কেউ বিচলিত ছিল না। একবার মনে আছে TCMN ক্লাসে আমাদের এক বন্ধু আর একজনকে একটা পাতায় কিছু অদ্ভুত ইংরিজি অক্ষর লিখে পড়তে বলেছিল। তার একটা অংশ হলো .... VJ SO TP ....বাংলায় এইগুলোর উচ্চারণ এত অশ্লীল হয়েছিল যে সেই নিয়ে প্রচুর বাওয়াল হয়েছিল। আর একটা ঘটনা হয়েছিল। TCMN-র অধ্যাপক ছিলেন কোনো এক প্রোঃ লস্কর, যাকে আমরা লাস্কি বলেই সম্বোধন করতাম, অবশ্যই আড়ালে। তার ক্লাসে আমাদের হাজিরা ছিল খুবই কম। অদ্ভুত উচ্চারণে একদিন শেখাতে শুরু করেছেন ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর .....; ছেলেদের মধ্যে কেউ একজন ফোর-এর জায়গায় একটা কিছু উচ্চারণ করেছিল। কথাটা এতই সাংঘাতিক ছিল লাস্কি থাকতে না পেড়ে খুব রেগে জানতে চেয়েছিলেন কে বললো, সামনে এসো। কিন্তূ একটা মনস্তত্ত্ব সেদিন আমরা জানতে পেরেছিলাম। যাই হোক না কেনো, শিক্ষকদের সামনে ছাত্ররা সবসময়ই একতাবদ্ধ। কেউ নাম না বলায় লাস্কি ক্লাসের সব ছেলেকে বার করে দিয়ে শুধু মেয়েদের নিয়ে ক্লাস করেছিলেন। আর আমরা ক্লাসের বাইরে এসে মনের আনন্দে ক্যান্টিনে গিয়ে আড্ডা মেরেছিলাম। শুধু তাই নয় পরপর বেশ কয়েকটা ক্লাসে, লাস্কির ক্লাস শুরু হলেই ছেলেরা একে একে সব কেটে পড়ত। তবে কিছুদিন পর পরীক্ষার চাপে আর ফেল করার ভয়ে আস্তে আস্তে আমাদের তাঁর ক্লাসে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিলো। মিড সেমেস্টারে অনেক খাতা লাস্কির মুখ বা কার্টুন আঁকা অবস্থায় জমা পড়েছিল। সোশ্যাল সাইন্স নিয়েও আমাদের অবস্থা এবং পরীক্ষার খাতায় বাঁদরামো ছিল প্রায় একই রকম।

কিন্তূ সব ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। ফার্স্ট সেমেস্টারের রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল সাড়ে তিনশ' ছেলেমেয়ের প্রায় অর্ধেক (যা মনে পড়ে ১৮৩ জন) TCMN বা Socio তে ফেল করেছিল। সে এক বিচ্ছিরি পরিবেশ। কলেজে একবার ফেল করা মানে সাপলি পাওয়া। পরের সেমেস্টারের সময় নতুন করে সাপলি পাওয়া বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। তাতেও ফেল করলে রিসাপলি। তিনবার একই বিষয়ে ফেল করলে এক বছর নষ্ট। প্রায় সবাই মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে দারুন ফল করা ছেলেমেয়ে। জীবনে কখনো ফেল করেনি। এমনও ছেলেমেয়ে ছিল যারা পরে নিজ নিজ ডিপার্টমেন্ট বা সেই বছরের পুরো ফেকালটিতে ফার্স্ট হয়েছে, কিন্তূ ফার্স্ট সেমেস্টারে ওই একটা খুঁত।

দুটোতেই ছিল ৫০ নম্বরের পরীক্ষা, মানে পাশ করতে হলে পেতে হবে ২০। যারা পাশ করেছিল তাদের প্রায় সবাই ২০, ২১ বা সর্বাধিক ২২ পেয়েছিলাম। কিছু ভাগ্যবানের মতো আমি যদিও কোনোরকমে পাশ করেছিলাম, কিন্তূ তাতেও এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা। হোস্টেলে যাদের সাথে বন্ধুত্ব তাদের অর্ধেক TCMN বা Socio তে সাপলি; সপ্তাহান্তে যাদের সঙ্গে বর্ধমান যাই বা কলেজে ফেরত আসি তাদের অনেকেই এইদুটোর কোনো একটায় সাপলি। তাই যারা গণসাপলির শিকার তারা কোনরকমে পাশ করে যাওয়া বন্ধুদের ভাগ্যের উপড় বিক্ষুব্ধ। জানলাম বন্ধুত্ব এমন একটা জিনিস, নিজে পাশ করলাম কিন্তূ বন্ধু ফেল করল,  তাতে দুঃখ হয়। কিন্তূ নিজে ১৯ পেয়ে ফেল করলাম, আর বন্ধু ২০ পেয়ে পাশ করে গেল, তাতে খুব রাগ হয়।

মানুষের রিপুগুলোর তাড়না যাইহোক না কেন, আস্তে আস্তে সময়ে সব মিলিয়ে বা নেতিয়ে যায়। তাই এইসব দুঃখ বা রাগও আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যায়। আমরা আবার এক সাথে ঘুরতে ঘুরতে কোলে মার্কেটে ছেঁড়া পরোটা আর জ্যাঠামশাই থেকে পঞ্চাশ গ্রাম টকদই সাথে পঞ্চাশ গ্রাম বোঁদে খেয়ে বিনে পয়সায় ঢুকে পড়ি বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তারপর লাস্কির নাম করে গঙ্গার উপড় পাশে পড়ে থাকা ঢেলা ছুঁড়ে শুরু করি 'শালা, বোকা…' ইত্যাদি সম্বোধন এবং প্রয়োগ করি রাগিং পিরিয়ডে শেখা সেই সব তিনমাত্রিক বা বহুমাত্রিক গালাগালিগুলো। খিদিরপুর ডকের চিমনি দিয়ে আকাশের দিকে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে যাওয়া ধোঁয়ার সঙ্গে সেই পড়ন্ত আলোয় আস্তে আস্তে আমাদের নিজেদের মধ্যে রাগারাগি মিটে যায়, সব খার গিয়ে পড়ে সেই লাস্কির উপড়। হয়তো সেই অধ্যাপকের বেশী কিছু দোষ ছিল না বা ধারণা ছিলোনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিদঘুটে ছেলেদের কিভাবে সামলাতে হয় বা কিছু না লিখলেও কিভাবে পাশ করাতে হয়। কিন্তূ আমাদের কাছে লস্কর তখন তস্করের মতোই নিন্দনীয়। এরপরে আর কখনো এতো গণসাপলির ঘটনা কলেজে ঘটেছিলো বলে শুনিনি।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.