- ১৩. প্রাগৈতিহাস ও ছাত্রাবাস
"টাওয়ার ক্লকের টিকটক টিকটক, বয়ে চলে গঙ্গায় জল,
কোম্পানি বাগানের বুড়ো বটগাছ, পাতা ঝরা ছায়ার আঁচল।
সোনালী স্বপ্ন দেখা আমরা কজন, আগামী দিনের কারিগর,
বিশপ কলেজ থেকে বি ই কলেজ, জুড়ে আছে সারা অন্তর।"
শুরু করলাম বি ই কলেজর ছাত্র - স্বনামধন্য আর্কিটেক্ট রঞ্জন প্রসাদের একটা গানের লাইনগুলো দিয়ে। হোস্টেলের ইতিহাসে যাবার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক পুরনো বিশপ কলেজের ইতিহাসটা। বেশ কিছু তথ্য শতবার্ষিকী পত্রিকা থেকে পাওয়া আর বাকিটা বিভিন্ন অধ্যাপকের এবং পুরনো হোস্টেল বা কলেজ কর্মচারীদের কাছ থেকে যোগাড় করা।
১৮১৯ সালে কলকাতার সর্বপ্রথম ব্রিটিশ আর্চবিশপ টি এফ মিডলটন সাহেবের আবেদনে সাড়া দিয়ে ধর্মবাণী প্রচারের জন্য খ্রীষ্টান সোসাইটি কলকাতার উপকন্ঠে একটি মিশন কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে রাজী হয় এবং এই উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার পাউন্ড অর্থসাহায্য করে। এছাড়াও খ্রীষ্টান জ্ঞান প্রসারের সমিতি এবং পূর্ব ও আফ্রিকার চার্চ মিশনারী সোসাইটি প্রত্যেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড করে দান করে। সর্বসাধারণের কাছ আরো কিছু অর্থসংগ্রহের জন্যে রাজকীয় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা শহরের কোলাহল থেকে দুরে হুগলি নদীর পশ্চিমতীরে ৬২ বিঘা জমি দান করে করে শিবপুর এলাকায়, যার তৎকালীন দলিলে নাম ছিল Seebpore, পরে হয় Shibpur। তখন পুরো জায়গাটা ছিলো উঁচু ঘাস, লতানে ঝোপঝাড় এবং নিশ্চল পুষ্করিণীতে ভরা এক উপবন।
গোথিক আর্কিটেকচারে তৈরী চাপেল বা খ্রীষ্টীয় ভজনালয়সহ কলেজ বিল্ডিংগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় ১৫ই ডিসেম্বর, ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে। মিঃ উইল্লিয়াম জোন্সের তত্বাবধনে ১৮২৪ সালে শেষ হয় কলেজ বিল্ডিংগুলোর কাজ। যেগুলোর মধ্যে আজও অনেকগুলো টিকে আছে ওয়ার্কশপ বিল্ডিং হিসেবে। বড়লাটের অনুগ্রহে দুদফায় আরো বেশ কিছুটা জমি যুক্ত হয় কলেজ প্রাঙ্গনের সাথে। বিশপ কলেজ দীর্ঘ সময় গর্বের সাথে উন্নীত ছিলো, কিন্তূ পরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং পরে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয় ১৮৮০ সালে। একটা পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে বিশপ কলেজে ১৮৭২ সালে জনা দশেক ছাত্র এবং একজন শিক্ষক ছিলেন। অনেক ছাত্র ভর্তি হয়েও কলেজ ছেড়ে চলে যায়। এখন বিশপ কলেজ আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডের উপর বেকবাগানের কাছে অবস্থিত এবং ১৯২১ সালের পর থেকে এটা পুরোপুরি আধ্যাত্মিক মহাবিদ্যালয়, যেখান থেকে ধর্মতত্বের উপড় চারবছরের স্নাতক এবং পরবর্তী স্নাতকোত্তর উপাধি দেওয়া হয়।
গত দুই শতাব্দী ধরে এই কলেজে ছাত্র বা শিক্ষক হিসেবে জড়িত ছিলেন বেশ কিছু খ্যাতনামা ব্যক্তি। রেভারেন্ড কৃষ্ণ মোহন ব্যানার্জী ছিলেন এই কলেজের ছাত্র (১৮৩৬-১৮৩৯) এবং পরে শিক্ষক (১৮৫২-১৮৬৭)। কৃষ্ণ মোহন ব্যানার্জী প্রথম ভারতীয় খৃস্টান যিনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত খ্রীষ্টের একটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এবং যীশুখ্রীষ্টকে প্রজাপতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। পান্ডিয়ার সামনের সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছে এনার নশ্বর দেহ। সমাধিক্ষেত্রে যারা শায়িত আছেন তাদের বিস্তারিত তালিকা ছাড়াও একটা ফলক আছে ওভালের কোনাকুনি সমাধিক্ষেত্রের দিকে।
এছাড়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত শিবপুর বিশপ কলেজের ছাত্র ছিলেন। শোনা যায় মাইকেল যখন কলেজে পড়তে এসেছিলেন তখন যে হোস্টেলে থাকতেন, সেখানে পার্টিতে শুধু ইউরোপিয়ান ছাত্রদের লিকার পরিবেশন করা হতো। মাইকেল একপেগের হুকুম দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। তারপর এই বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাম্যবিচারের আবেদন করেন এবং অবশেষে এই ভেদাভেদ বন্ধ করতে সক্ষম হন। অতএব মাইকেলের সুবাদে বিশপ কলেজের সময় থেকে ভারতীয় ছাত্রদের মদ্যপানের অধিকার শিবপুর কলেজ প্রাঙ্গনে স্বীকৃত।
নেহেমিয়াহ গোরে এই কলেজে ১৮৬৭-৬৮ সালে শিক্ষাদান করেছিলেন। গোরের কৈফিয়তমূলক ধর্মতত্ত্ব ছিলো ব্রাহ্মদের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও তিনি হিন্দু দর্শনের কিছু অপ্রচলিত প্রথা খণ্ডন করার চেষ্টা ছিলেন। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হলেন বিশপ হার্বার্ট পাকেনহাম ওয়ালশ, বিশপ এ জে আপ্পাসামী, , এস কে জর্জ, জন জি আরাপুরা, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের ক্যানন সুবীর বিশ্বাস এবং ওয়াই ডি তিওয়ারী।
এরপর ফিরে আসা যাক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ১৮৮০ সালে ইংরেজ সরকার যখন বিশপ কলেজ অধিগ্রহণ করেন গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (GEC) জন্যে তখন কলেজ চত্বরে ছিলো ইস্টার্ন ব্লক, ওয়েস্টার্ন ব্লক, সেন্ট্রাল ব্লক, চ্যাপেল, লাইব্রেরি, ডাইনিং হল, প্রিন্সিপালের আবাস, ডাক্তারের আবাস, এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের আবাস, অষ্টকোণী কুঠী, ছাত্রদের জন্যে তিনটে বাংলো এবং একটা পুরোনো কেমিকাল ল্যাবরেটরি। মিঃ এস এফ ডাউনিং সাহেব অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হয়ে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। তার সাথে বদলি হয়ে আসেন সিভিলের অধ্যাপক মিঃ জে এস স্লেটার, গণিতের অধ্যাপক জে এইচ গিল্লিল্যান্ড, অঙ্কনের অধ্যাপক মিঃ জে টি বার্লেট এবং অঙ্কন ও সার্ভের সহকারী শিক্ষক মিঃ দ্বারকানাথ দত্ত। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রসংখ্যা প্রায় ৭৩ জন। একই সময় ডেহরি-অন-সোনের সরকারী কারখানা থেকে ৮০ জন শিক্ষানবিশকেও বদলি করে নিয়ে আসা হয় শিবপুর কলেজে। এদের অনেকেই থাকতো পুরোনো ব্যারাক বা বাংলোগুলোতেই। ডেহরি-অন-সোনের কারখানা থেকে শিবপুরে বদলি হয়ে আসেন শিক্ষানবিশ বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট এবং শিক্ষক মিঃ সি ফৌরাক্রেস এবং মিঃ সি গিলমোর।
নতুন নিয়মে ঠিক হয় নিম্নলিখিত চারটি সেকশানে ক্লাস হবে:
১। সেকশান A: সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক বিভাগ
২। সেকশান B: মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক বিভাগ
৩। সেকশান C: সিভিল ওভারসিয়ার
৪। সেকশান D: মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষানবিশ
স্নাতক বিভাগগুলো এক বছরের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণসহ পাঁচ বছরের কোর্স আর বাকিগুলো সাড়ে তিন বছরের পাঠক্রম এবং তারপর দেড় বছরের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ, মানে মোট সেই পাঁচ বছরের কোর্স।
এবার একটু দেখে নেওয়া যাক হাওড়া এবং শিবপুর অঞ্চলের তখনকার রূপটা। হাওড়া শহরের ইতিহাস প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। হুগলী নদীর পশ্চিম দিকের অংশটা ছিলো বর্ধমান মহারাজা এবং মুহাম্মদ আমিনপুর নামক এক জমিদারের সম্পত্তি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭১৩ সালে ঔরঙ্গজেবের নাতি দিল্লীর নবাব ফারুখসিয়ারের কাছ থেকে গঙ্গার পূর্বদিকের বা কলকাতার দিকের ৩৫টি জনপদের সঙ্গে; পশ্চিম দিকের পাঁচটি গ্রামের ইজারা নেয়। সেই পাঁচটি গ্রাম ছিলো বর্তমান সালকিয়া, হাওড়া, কাসুন্দিয়া, রামকৃষ্ণপুর এবং বেতড়। এর মধ্যে বেতড় ছিলো বর্ধমান জেলার মধ্যে অবস্থিত একটি প্রধান ব্যবসার কেন্দ্র। ১৭৮৭ সালে গঙ্গার পশ্চিম দিকের এক বিশাল অংশ বর্ধমান জেলার থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয় হুগলী জেলা। ১৮৪৩ সালে হুগলী জেলা থেকে গঙ্গার তীরবর্তী অংশ নিয়ে গঠিত হয় হাওড়া জেলা। বেতড় ছিলো আজকের বি ই কলেজের সবথেকে নিকটবর্তী জনপদ। পরবর্তী কালে বেতড়ের গুরুত্ব কমে কালের গর্ভে বিলীন হয় যায়। তবে আজও তখনকার বনিকদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাতাইচন্ডী কালীবাড়ি বিদ্যমান।
১৮৮০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলটা ছিলো জনবিহীন, শ্বাপদসংকুল, জলাজমি এবং আগাছায় ভর্তি এলাকা। ১৮৮৩ সাল নাগাদ তৈরী হয় শালিমার টার্মিনাস এবং হাওড়া শালিমার রেলপথ। এরপরে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গার পরে বিশপ কলেজের ছেড়ে যাওয়া ক্যাম্পাস। এরপর কোম্পানি বাগান বা ১৭৮৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বানিজ্যের জন্য ক্রমবর্ধমান মশলা ও কাঠের যোগানের জন্য প্রতিষ্ঠিত বোটানিক্যাল গার্ডেন। এছাড়া একটু দুরে কিছু পাটকল আর ময়দা কল। আরও পরে গড়ে উঠে যন্ত্রপাতি তৈরীর কারখানা।
কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে আমরা যেটাকে মুচিপাড়া বলি সেদিকটায় ছিলো গঙ্গার তীরবর্তী বিশপ কলেজ, অধ্যক্ষের প্রাসাদ, খ্রীষ্টীয় ভজনালয়, অধ্যাপকদের বাসস্থান আর ইউরোপিয়ান ছাত্রাবাস। আর বাকি অংশটা মানে সাহেব পাড়ায় ছিল পূর্ত বিভাগের ওয়ার্কশপ এবং অফিস। পুরোটাই গুরু জোন্সের তৈরী গথিক প্রাসাদ। কাঠের ঘোরানো সিড়ি উঠে গেছে দোতলার বেলে পাথরের মেঝের দিকে। ঢালাই লোহার তৈরী মূল ফটক, নকশা করা কাঁচের জানলা। অল্প কিছু ভারতীয় ছাত্র পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে দৈনন্দিন যাতায়াত করতো বা ভজনালয়ের মধ্যে সাময়িক আশ্রয় নিতো। অধ্যক্ষের প্রাসাদ আজও কলেজের উপাচার্যের প্রাসাদ। চ্যাপেল বা খ্রীষ্টীয় ভজনালয়ের কিছুটা ভগ্নপ্রায় এবং তাতে অধ্যাপকদের একটা ক্লাব আছে। চ্যাপেলের সাথে লাগোয়া অংশে ছিলো বিশপ কলেজ এবং ডাইনিং হল। এখন চ্যাপেলসহ কলেজ অংশের নাম মধুসূদন ভবন। ওয়েস্টার্ন ব্লক ও সেন্ট্রাল ব্লক - মানে অধ্যাপকদের বাসস্থানগুলো এখনো একই কাজে ব্যবহৃত হয়। ইস্টার্ন ব্লক বা ইউরোপিয়ান ছাত্রাবাস ছিলো বি ই কলেজ মডেল স্কুল, এখন তার একটা অংশে হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অফিস।
এছাড়াও ছিলো ওভাল মাঠের পশ্চিমে PWD-র ড্রয়িং হল বা পরবর্তী কালে বিশপ কলেজের পাঠাগার বা লাইব্রেরি, যেটা পরে বেশ কিছুদিন বি ই কলেজের লাইব্রেরি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পুরোনো কিছু ছবি থেকে দেখা যায় এখানেও ক্লাস চলতো বিশপ কলেজের। তবে এখন সেটা জিমন্যাসিয়াম - আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের শরীরচর্চার স্থান। এছাড়াও কিছু ব্যারাক ছিল, জনশ্রুতি হিসেবে সেগুলো ছিলো এখনকার স্লেটার হলের জায়গায় এবং আর কিছু ১৬নং হোস্টেল ও সেনগুপ্ত হলের পিছনে। একটা হসপিটাল ছিলো নিম ঝিলের শেষপ্রান্তে - এখনকার স্লেটার হল ও ১১নং হোস্টেলের পিছন দিকে। তখন বিশপ কলেজ বা বোটানিক্যাল গার্ডেন আসতে হতো জলপথে, গঙ্গা বা হুগলী নদীর দিক থেকে। তাই কলেজ বা চ্যাপেলের মুখ ছিলো গঙ্গার দিকে, মানে দক্ষিনমুখী। এছাড়াও লক্ষ্যনীয় পুরনো বাড়িগুলোর স্থাপত্য। উপাচার্য্যের বাসভবন, মধুসূদন ভবন বা আগের বিশপ কলেজ, ডাউনিং হল, কলেজ ওয়ার্কশপ ও পূর্তবিভাগ, এখনকার হসপিটাল - সবগুলোরই মাঝে গেট হাউস - চারটি অষ্টকোণী পিলারের মধ্যে কাস্ট আইরনের তৈরী সিংহদুয়ার। এই অষ্টকোণী পিলারের মধ্যে দিয়ে উঠে গেছে সরু ঘোরানো সিড়ি। আর বাড়িগুলোর একদম প্রান্তে ছোটো ছোটো অষ্টকোণী পিলার যার মাথার দিকটা শঙ্কুর মতো সুঁচালো।
রাইটার্স বিল্ডিং থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে ১৮৮০ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আসে এই ক্যাম্পাসে। খ্রীষ্টান সমিতির কাছ থেকে PWD তিন লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে নেয় পুরো ক্যাম্পাস - যার মধ্যে দু'লক্ষ বাড়িগুলির জন্যে আর বাকি এক লক্ষ ১২০ বিঘা জমির জন্যে। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস হতো পূর্ত দপ্তরের ওয়ার্কশপগুলোতে এবং নতুন তৈরী কিছু বিল্ডিং-এ। এখন এগুলোর মধ্যে অনেকেগুলোই টিকে আছে, কয়েকটা ভগ্নপ্রায়, কয়েকটার মেরামত করা হয়েছে। প্রথমে গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের যেখানে ক্লাস হতো এখন সেগুলো প্রায় সবই মূল কলেজ ভবনের পিছনে অবস্থিত কলেজের ওয়ার্কশপ - কার্পেনট্রি, অটোমোবাইল, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি। এছাড়াও আছে একটা ছাপাখানা ও পূর্ত বিভাগ বা PWD-র অফিস। ছাপাখানার পাশে একটা সুড়ঙ্গ ছিলো যেটা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে একটা পাউরুটি তৈরীর কারখানা ছিলো ছাপাখানার ঠিক পাশেই। এই সুড়ঙ্গ সেই পাউরুটি কারখানার ফার্নেসের অংশ।
বি ই কলেজের হোস্টেলগুলোর ইতিহাসটাও বেশ চমকপ্রদ। যখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ কলেজ ছিলো, তখন ছাত্ররা ক্লাস করতো নিজেদের স্থায়ী বা ভাড়া নেওয়া বাসস্থান থেকে। ১৮৮০ সালে তদানীন্তন বিশপ কলেজের জায়গায় আসার পর থেকে কলেজ আংশিক আবাসিক হয়। প্রথম ছাত্রাবাস ডাউনিং হল তৈরী হয়ে যাবার পর ১৮৮৯ সাল থেকে বাধ্যতামূলক আবাসিকপ্রথা চালু হয়। ১৮৮০ থেকে ১৮৮৯ পর্যন্ত্য ছাত্ররা বিশপ কলেজের পুরোনো হোস্টেলেই থাকতো। ইউরোপিয়ান ছাত্ররা ছিলো ইস্টার্ন ব্লকে আর ভারতীয় ছাত্ররা অন্য ব্যারাকগুলোতে। তখন হিন্দু আর মুসলিম হোস্টেল এবং মেস ছিলো আলাদা।
ডাউনিং হল: দেশীয় ছাত্রদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মাথায় রেখে ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রায় এক লক্ষ আশি হাজার টাকা (১,৭৯,৩৬৩/-) বরাদ্দ করেন একদম পশ্চিমপ্রান্তে তিনটি ব্লকযুক্ত একটি হোস্টেল নির্মান করার জন্যে। এই হোস্টেলের ইস্ট এবং ওয়েস্ট ব্লক হলো দোতলা, আর সেন্ট্রাল ব্লক তিনতলা। প্রত্যেকটি ঘর চারশয্যার এবং আলো বাতাস যুক্ত। গঙ্গার দিকে মুখ করে তিনটি ব্লকের মাঝখানে প্রশস্ত লন এবং পিছনে বোটানিক্যাল গার্ডেন নিয়ে রাজকীয় এই হোস্টেলের কাজ শেষ হয় ১৮৮৬ সালে । প্রথমে এই হোস্টেলের নাম ছিলো নেটিভ হিন্দু মেস যা ১৯১০ সালের পরে হয় ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস মেস। ১৯২১-২২ সাল পর্যন্ত্য মেকানিকাল, ইলেকট্রিক্যাল ও মাইনিং-এর ছাত্রদের বলা হতো আপ্রেন্টিস বা শিক্ষানবিশ এবং সিভিলের ছাত্রদের বলা হতো ইঞ্জিনিয়ার বা বাস্তুশিল্পী। তাই কিছুদিন পরে আবার এর নাম পরিবর্তন হয়ে হয় - হিন্দু আপ্রেন্টিস ব্যারাক। যদিও এখানে হিন্দু ও মুসলিম - সব ভারতীয় ছাত্ররাই থাকতো। সেন্ট্রাল ব্লকের পূর্বদিকে মুসলিম ছাত্রদের রাখা হতো এবং তাদের নিজস্ব মেস সিস্টেম ছিলো। সেন্ট্রাল ব্লকের মাঝের অংশে একতলার বিশাল ঘরটি ছিলো হিন্দু ছাত্র ও কর্মচারীদের প্রার্থনার জায়গা - হরিসভা। ১৯২৪ সালে এই হোস্টেলের নাম হয় ডাউনিং হাউস। সেই বছর থেকেই মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরো ইস্টার্ন ব্লকটাই মুসলিম ছাত্রাবাস করা হয়। ১৯৪০ নাগাদ হিটন হলের হিন্দু ছাত্রদের এখানে নিয়ে এসে হিটন হলকে পুরোপুরি মুসলিম হোস্টেল করে দেওয়া হয়। যদিও প্রথম থেকেই ছাত্রদের পয়সাতেই মেস চলতো, তবু মেসের নিয়ন্ত্রণ ছিলো সরকার নিযুক্ত মেস সুপারিনটেনডেন্টের হাতে। ১৯১৫-১৬ সালে ছাত্রদের অভিযোগের ফলে হোস্টেল সুপারের পদ তৈরী হয় যার অধীনে ছাত্রদের নিয়ে তৈরী মেস কমিটি মেসের আংশিক নিয়ন্ত্রণ পায়। হিন্দু ও মুসলিম সবকটি মেসের দায়িত্বে প্রথম হোস্টেল সুপার ছিলেন শ্রী সুরেন্দ্র নাথ দাস। এছাড়াও ডাউনিং হলের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো - ১৯২৩ সাল নাগাদ ইস্টার্ন এবং ওয়েস্টার্ন ব্লকে একটি করে শৌচাগার নির্মান, ১৯৩৮ সাল নাগাদ স্নানের ঘেরা জায়গা, ১৯৫৫ সাল নাগাদ তিনটি ব্লকের দ্বিতীয়তলের মধ্যে সহজে যাতায়াতের জন্যে ওভারব্রিজ। ডাউনিং হলে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অফিস। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় মিঃ এস এফ ডাউনিং-এর নামে যিনি ১৮৮০ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
স্লেটার হল: আপ্রেন্টিসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ইঞ্জিনিয়ার ছাত্রদের জন্যে ১৯০৩ সালে তৈরী হয় এখনকার স্লেটার হল। এটার তিনটে অংশ - সর্বপশ্চিমে সর্বাধিক আশিজন হিন্দু ছাত্রদের জন্যে একটি দশকামরা যুক্ত দোতলাবাড়ি, একটু ফাঁকা জায়গার পর তার পূর্বে সর্বাধিক ষোলোজন মুসলিম ছাত্রদের জন্যে একটি দু'কামরা যুক্ত একতলাবাড়ি এবং একদম পূর্বদিকে একটা ডাইনিং হাউস। ডাইনিং হাউস আসলে তৈরী হয়েছিলো ছিলো বি ই কলেজ মূল হসপিটালের ছোঁয়াচে রুগীদের জন্যে একটি বিশেষ ওয়ার্ড হিসেবে। আর তখন মূল হসপিটাল ছিলো ডাউনিং হলের মধ্যভাগের পূর্বদিকের অংশে। পরবর্তী বিভিন্ন পরিবর্তনের পর ১৯৯০ নাগাদ এটা ছিলো ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের মুখ্য অফিস। ২০১১ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মূখার্জী এই ভবনটি তরুণ মনের জন্য উৎসর্গ করেন - যার নাম স্টুডেন্টস সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশন। এখানে এখন আছে একটা ফোটোগ্রাফি ক্লাব - কাথার্সিস (Catharsis), একটা মিউজিক ক্লাব, ড্রামা ক্লাব ও কুইজ ক্লাব। আর একটা স্থাপত্যের নিদর্শন - একতলায় পশ্চিমদিকের ঘরটা দুভাগ করা আছে একটা Waffle Slab দিয়ে। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় মিঃ জে এস স্লেটার-এর নামে যিনি ১৮৯২ থেকে ১৯০৩ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
হিটন হল: এটা হলো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় হোস্টেল - শুধুমাত্র ইউরোপিয়ান ছাত্রদের জন্যে তৈরী ১৯২৩ সালে, মাত্র এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা (১,২০,০০০/-) ব্যায়ে। স্বাধীনতার অনেক আগেই ইউরোপিয়ান ছাত্রদের সংখ্যা খুব কমে এলে দুর্গের মতো আকৃতির তিনতলা এই হোস্টেলটায় হিন্দু ছাত্রদেরও রাখা হতো। ১৯৪০ থেকে হিটন হল শুধুমাত্র মুসলিম ছাত্রদের জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়। এখন এই বিল্ডিংটা কলেজের হসপিটাল বিল্ডিং এবং সেন্টার ফর হেলথকেয়ার এন্ড টেকনোলজি। নিচের তলায় বাকি অংশে এনসিসির অফিস, স্টোররুম, কলেজের মধ্যে প্রথম ব্যাঙ্ক - ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং সদ্যনির্মিত এটিএম। কিছু অংশ অব্যবহৃত। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় মিঃ বি হিটন-এর নামে যিনি ১৯০৩ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
১নং হোস্টেল - রিচার্ডসন হল: নতুন নকশার হোস্টেলগুলো তৈরী শুরু হয় এই বিল্ডিং-এর হাত ধরে ১৯৫১ সালে। হোস্টেলের নম্বর সিস্টেম চালু করা হয় এই সময় থেকেই। ১৯৫০ সালেই তৈরী হয় নতুন কলেজ বিল্ডিং। তখন ছিলো শুধু ফার্স্ট লবি আর সেকেন্ড লবি। পাঁচলক্ষ একষট্টি হাজার পাঁচশ তিপ্পান্ন টাকা (৫,৬১,৫৫৩/-) য়ে রিচার্ডসন হল তৈরী হয় কলেজ ভবনের সেকেন্ড লবির মুখোমুখি একটি প্রশস্ত খেলার মাঠের অন্যপ্রান্তে। খেলার মাঠটি এখন পরিচিত লর্ডস নামে। এই সময় থেকে তৈরী হোস্টেল বা আমরা যেগুলোকে হল বলেই চিনি, সেগুলো সব তিন বা চারবাহু বিশিষ্ট একটি করে তিনতলা ভবন - ভালো বাতাস চলাচলের সুবিধাযুক্ত একশয্যার একশটি করে ঘর, একটি প্রশস্থ ডাইনিং হল, একটি বিশাল রান্নাঘর এবং বাসিন্দাদের সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কাজকর্মের জন্যে আধুনিক সুবিধাযুক্ত দুটি করে সাধারণ কক্ষ। এছাড়াও রয়েছে হলের ছাত্রদের রক্ষণাবেক্ষণে তৈরী একটি সুন্দর বাগান। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় মিঃ টি এইচ রিচার্ডসন-এর নামে যিনি ১৯২৩ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। রিচার্ডসনের ছাত্রদের বার্ষিক নিবেদন Richter - বি ই কলেজের একমাত্র কোনো ছাত্রাবাসের দ্বারা উপস্থাপিত নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আরও উল্লেখযোগ্য এই হোস্টেলের সামনেই ১৯৫৬ সালে ছাত্রদের তৈরী বেন্ডিং মোমেন্ট গেট (Bending Moment Gate) কলেজের একটা ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরে বর্তমান Alumni House-এর সামনে সরিয়ে আনা হয়।
২নং হোস্টেল - ম্যাকডোনাল্ড হল: পাঁচলক্ষ বাহাত্তর হাজার ন'শ বারো টাকা (৫,৭২,৯১২/-) ব্যায়ে নির্মীত ম্যাকডোনাল্ড হলের যাত্রা শুরু ৭ই জুলাই, ১৯৫২ থেকে। এই হোস্টেলে একশয্যার ঘর একশ দুইটি। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় মিঃ এ ম্যাকডোনাল্ড-এর নামে যিনি ১৯২৮ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৫৪ সালে মিঃ ম্যাকডোনাল্ড ৩,৭০০/- টাকা দান করেন যার সুদ থেকে প্রতি বছর এক শত টাকা মূল্যের পুরস্কার দেওয়া হয় এই হলের সেরা ছাত্রকে। এই পুরস্কার ম্যাকডোনাল্ড প্রাইজ নামে পরিচিত।
৩নং হোস্টেল - উল্ফেন্ডেন হল: ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে তৈরী হয় উল্ফেন্ডেন হল মোট সাতলক্ষ বত্রিশ হাজার আটশ ছেচল্লিশ টাকা (৭,৩২,৮৪৬/-) ব্যায়ে। অনান্য বৈশিষ্ট্য আগের দুটো হলের মতো হলেও ওভালের সামনে তৈরী তিনবাহু বিশিষ্ট এই হলটির স্থাপত্যবিষয়ক নকশা একটু আলাদা। কমন রুম বা বিভিন্ন সুবিধাযুক্ত সাধারণ কক্ষ ছাড়াও একতলায় একটা পাঠকক্ষ আছে। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় মিঃ আর উল্ফেন্ডেন-এর নামে যিনি ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
৪নং হোস্টেল - পান্ডিয়া হল: এই হলটির নির্মান শেষ হয় ১৯৫৫ সালে মোট ছ'লক্ষ সাতান্ন হাজার সাতশ ছ'টাকা (৬,৫৭,৭০৬/-) ব্যায়ে। এটিরও মূল বৈশিষ্ট্য আগের হলগুলির মতো হলেও স্থাপত্যবিষয়ক নকশা একটু আলাদা। ফার্স্ট গেটের ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় ডঃ এ এইচ পান্ডিয়া-এর নামে যিনি ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ডঃ পান্ডিয়া হলেন এই কলেজের প্রথম স্থায়ী ভারতীয় অধ্যক্ষ। পরবর্তী কালে ১৯৯০ দশকের একমাত্র ছাত্রীনিবাস। ক্রমবর্ধমান ছাত্রীসংখ্যার জন্যে ডঃ বিমল সেনের কার্যকালে ১৯৯১ সালে একটিতলা বাড়ানোর ফলে এটি এখন চারতলা বিল্ডিং।
৫নং হোস্টেল - সেন হল: ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় এই হলটি। স্থাপত্যবিষয়ক নকশায় চারবাহু বিশিষ্ট রিচার্ডসন বা ম্যাকডোনাল্ড হলের সঙ্গে অনেক মিল থাকলেও অল্প অদলবদল হয়। রিডিং রুম যোগ হয় নকশার সঙ্গে এবং রান্নাঘরের অবস্থান একটু পাল্টে যায়। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় প্রোঃ এন এন সেন-এর নামে যিনি ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রোঃ সেন ছিলেন এই কলেজের স্বাধীন ভারতের প্রথম অধ্যক্ষ।
৬নং হোস্টেল - সেনগুপ্ত হল: ১৯৫৭ সালের শেষের দিকে নির্মিত এই হলটি স্থাপত্যবিষয়ক নকশায় সেন হলের হুবহু নকল। এটি কলেজের পূর্বপ্রান্তের একদম শেষ হোস্টেল। এই বিল্ডিং-এর নামকরণ হয় ডঃ এস আর সেনগুপ্ত-এর নামে যিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত্য এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
৭নং হোস্টেল - এ সি রায় হল: ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০-র মধ্যে কোনো একসময়ে নির্মীত একদম উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত এই হোস্টেল থেকে শুরু হয় অন্য এক ধরনের নকশায় নির্মান। আয়তকার বিল্ডিংগুলো সব চারতলা। টানা বারান্দার সাথে লাগোয়া সারি সারি রুম - একসাথে সর্বাধিক চারজন ছাত্র থাকার উপযুক্ত। এছাড়া ঠিক মাঝখানে একটা বড় সাধারণ কক্ষ বা কমন রুম। অনেক সময় এগুলো রিডিং রুম বা টিভি রুম হিসেবে ব্যাবহার হতো। আবার অনেক সময় ছাত্রসংখ্যা বেশী থাকলে এখানে সর্বাধিক পাঁচজন ছাত্র থাকতে পারতো। প্রথমতলে অনেকটা জায়গা নিয়ে রান্নাঘর আর একটা প্রশস্থ খাবার জায়গা। এছাড়া একটা বিশাল কমন রুম, যেটা অনেক সময়ই টিটি, ক্যারম বা বাসিন্দাদের অনান্য সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কাজকর্মের জন্যে ব্যবহার হতো। বাকি জায়গায় কয়েকটা চারশয্যার ঘর। প্রথমতলে মাঝের কমন রুম না থেকে, থাকতো একটা ঢাকা গাড়িবারান্দা। এছাড়াও পাঁচতলায় সাধারণের ব্যবহারের জন্যে একটা ছাদ ছাড়াও থাকতো শুধু মাঝের কমন রুমটা। সম্প্রতি এই হোস্টেলের নামকরণ হয় মিঃ এ সি রায়-এর নামে যিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত্য।
৮নং হোস্টেল - ডি ব্যানার্জী হল: ৭নং হোস্টেলের পূর্বে অবস্থিত একই নকশায় তৈরী এই হোস্টেল ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০-র মধ্যে কোনো একসময়ে। এখন এই হোস্টেলগুলি জুনিয়র ছাত্রদের থাকার জন্যে ব্যবহার হয়। আর সব হোস্টেলেই আছে একফালি নিজস্ব বাগান। সম্প্রতি (২০০৫ নাগাদ) এই হোস্টেলের নামকরণ হয় মিঃ দূর্গাদাস ব্যানার্জী-এর নামে যিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত্য।
৯নং হোস্টেল - ডঃ বিমল সেন হল: ৭নং, ৮নং হোস্টেলের সঙ্গে এই হোস্টেলটিও নির্মীত ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০-র মধ্যে কোনো একসময়ে। এই পরম্পরার সবগুলোতে সর্বাধিক ১৫৮ জন ছাত্র থাকতে পারতো। যদিও দুই, তিন ও চারতলায় মাঝামাঝি দিকের একটি করে ঘরে ফ্লোর ক্যান্টিন চলতো। সেকেন্ড গেটের কাছেই এই হোস্টেলের সম্প্রতি (২০০৫ নাগাদ) নামকরণ হয় ডঃ বিমল সেন-এর নামে যিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত্য। ডঃ বিমল সেন ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শেষ প্রিন্সিপাল বা অধক্ষ্য এবং স্বশাসিত বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ - ডিমদ ইউনিভার্সিটির প্রথম ডিরেক্টর বা অধিকর্তা।
১০নং হোস্টেল - এ কে শীল হল: ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে ৯নং-এর পরে হলেও ১০নং ও ১১নং হোস্টেলের কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সাল নাগাদ। ৯নং-এর ঠিক দক্ষিনে এই হোস্টেল ১৯৯৮ সাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০০০ সাল নাগাদ এই হোস্টেলের নামকরণ হয় প্রোঃ অরুন কুমার শীল-এর নামে যিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত্য।
১১নং হোস্টেল: মুচিপাড়ার দিকে এই পরম্পরার একমাত্র হোস্টেল যেটা এখনো নম্বর দিয়েই পরিচিত এবং কোনো নামকরণ হয়নি। এটিরও কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সাল নাগাদ।
১২/ ১৩ নং হোস্টেল - প্রতীচি এবং পি জি হোস্টেল: এই দুটো হোস্টেলের নামকরণ বা নম্বরকরণ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। দুটো হোস্টেলই নির্মান হয় প্রায় একই সময় ১৯৬১ সালে। মানে ১০ আর ১১ নম্বরের আগেই কাজ শেষ হয়েছিলো এই দুটি হোস্টেলের। ১১ নং-এর দক্ষিনে নিমঝিলের পাশের হোস্টেলটির নম্বর ১২ এবং তার একটু দক্ষিনপূর্বে গঙ্গার দিকে মুখ করে ১৩ নম্বর। মিঃ ডি এম সেন নামক এক ব্যাক্তি ছিলেন অংকের Wrangler, মানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্র। তিনি ছিলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সরকারের শিক্ষাসচিব এবং ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন বা জনশিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা। জনশ্রুতি তাঁর ছেলে ১৯৬১ সালে বি ই কলেজে ভর্তি হন। স্বামী শিক্ষাসচিব, তাই স্ত্রীর আব্দার হলো আমার সন্তান যেন থাকে গঙ্গার পাড়ে। তাই হলো। কিন্তূ কলেজে এসে ওনারা বুঝতে পারেন সেই হোস্টেলের মানে এখন যা প্রতীচি, তার নম্বর ১৩। খুবই অমঙ্গলজনক সংখ্যা বদলের জন্যে অধক্ষ্য এ সি রায়-এর শরণাপন্ন হলে, অধক্ষ্যমহাশয়ের নির্দেশে ১৩ আর ১২ নম্বরদুটিকে অদলবদল করে দেওয়া হয়। পরবর্তী কালে ১২ নম্বর হয় অধ্যাপকদের বাসস্থান, তাই নকশায় কিছুটা রদবদল করা হয়। ৭নং থেকে ১৬নং-এ একসারি দিয়ে ১১টা করে ঘর ছিলো। একটা করে ঘর সবতলায় বাড়ানো হয়, যাতে সবতলায় তিনটি করে চারকামরার কোয়ার্টার তৈরী করা যায়। এই হলের নাম পাল্টে হয় "প্রতীচি"। ১৩নং হোস্টেল পরে বেশ কিছুদিন গার্লস হোস্টেল ছিলো। পরে পান্ডিয়াতে সমস্ত ছাত্রীদের নিয়ে আসা হলে এই হোস্টেলটি কিছুদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পরে থাকে। ১৯৯৭ থেকে এটি হয় স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের ছাত্রদের হোস্টেল বা পি জি হোস্টেল।
হারিয়ে যাওয়া দুর্গাপুর হোস্টেল - ই-১ ও ই-২: এখন যেখানে কলেজের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি সেটা ২০০০ সালেও ছিলো একটা ফুটবল মাঠ। তার পূর্বদিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা কিছুটা চড়াই পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে সোজা তিননম্বর গেটের দিকে চলে গেছে। এই বাঁকের মুখের ছিলো দুটি হোস্টেল ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত্য। এখন এই দুটিই প্রশাসনিক কর্মচারীদের বাসস্থান। ১৯৬০ সালে শুরু হয় দুর্গাপুর রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কিন্তূ REC, Durgapur-এর ক্যাম্পাসের কাজ শেষ না হওয়ায় এক বৎসরের একটু বেশী সময় আর ই সি দুর্গাপুরের ক্লাস হতো বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই আর ছাত্ররা থাকতো এই দুটি হোস্টেলে। পরে দুর্গাপুরের ছাত্ররা নিজেদের ক্যাম্পাসে ১৯৬১ সালে চলে গেলে, আরও প্রায় তিনবছর বি ই কলেজের ছাত্ররা থাকতো এই দুটি হোস্টেলে - যাদের সরকারী নাম ছিলো E1 এবং E2।
আরও দুটি এফ-১ ও এফ-২: E1, E2-র পাশে দুটো ডি টাইপ কোয়ার্টার তৈরী হয় ১৯৬২ সাল নাগাদ। কিন্তূ সেই বৎসর কলেজের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ১৮, ১৫ আর ১৬-র কাজ শেষ না হওয়ায় দুবছরের একটু বেশি সময় এই দুটি স্টাফ কোয়ার্টার ব্যবহার করা হয় ছাত্রাবাস হিসেবে। সরকারী নাম ছিল F1 ও F2।
১৪, ১৫, ১৬ নং হোস্টেল - ক্রমবর্ধমান ছাত্রসংখ্যার চাপে ১৯৬৪ সাল নাগাদ নির্মীত হয় এই তিনটি হোস্টেল। যেহেতু সিনিয়র ছাত্রদের হলের সামনে নির্মীত তাই প্রথম থেকেই এগুলোতে সিনিয়র ও জুনিয়র ছাত্ররা একসাথেই থাকতো। যে পরম্পরা শেষ হয় ১৯৯৮ সালে। তারপর এই তিনটি হোস্টেল হয় শুধুমাত্র প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্যে নির্দিষ্ট। কয়েক বছর পর থেকে এই তিনটি হোস্টেল এখন শুধু দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের জন্যে চিহ্নিত।
নতুন ছাত্রীনিবাস - নিবেদিতা হল: ২০০৫ সাল নাগাদ তৈরী হয় তিনতলা এই হোস্টেলটি উল্ফেডেন হল এবং ওভাল মাঠের মাঝামাঝি জায়গায় সম্পূর্ণ নতুন নকশায়। কিছু মানচিত্রে এটিকে দেখানো হয়েছে গার্লস হোস্টেল ফর এসসি ও এসটি, যদিও এটাতে মুষ্টিমেয় কিছু স্নাতকোত্তর ছাত্রীর সঙ্গে মূলত প্রথম বর্ষের ছাত্রীদেরই রাখা হয়। প্রাথমিক পরিচয় Girls Hostel For SC/ST-র কারণ হলো এটা UGC-র তফসিল জাতি ও উপজাতিদের উন্নয়নের জন্যে বরাদ্দ অর্থসাহায্যে নির্মীত। আগে ওভালের পাশ দিয়ে হোস্টেল ৭, ৮, ৯, ১০ ও ১১-তে যাবার একটা সোজা রাস্তা ছিলো, যার পাশে একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি ছিলো যেটা কথিত বিশপ কলেজের রসায়ন পরীক্ষাগার। নিবেদিতা হল তৈরী হওয়ায় সেই বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং সেই রাস্তাও বন্ধ। তার বদলে আগের বিকল্প রাস্তা উল্ফেডেনের পাশ দিয়ে ওই হোস্টেলগুলিতে যেতে হয়।
সদ্য তৈরী লেফটেনেন্ট উইলিয়ামস হল অফ রেসিডেন্স: সুইমিং পুলের ঠিক উল্টোদিকে ২০১৩ সালে নির্মীত এই হলটি। এটি একটি তিনতলা হোস্টেল। নতুন নকশাই প্রত্যেক তলায় একসারি দিয়ে সাজানো রুমগুলো। এটিকে তৈরী করা হয়েছে নতুন ছাত্রীনিবাস হিসেবে এবং উদ্বোধনে আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রথম স্নাতক পাশকরা ছাত্রী শ্রীমতি ইলাদিকে। হলটির নাম গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম অধক্ষ্য লেফটেনেন্ট ই সি এস উইলিয়ামস সাহেবের নামে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.