-১৫. নয়: এতো প্রেম নয়
হোস্টেল নয়ে থাকার সময় দুবার পি জি হসপিটালে (Presidency General Hospitla) - বা যাকে আমরা বলি শেঠ সুখলাল কারনানি মেমোরিয়াল হাসপাতাল, সংক্ষেপে SSKM, যেতে হয়েছিলো। নিজের জন্যে নয়, অন্যদের জন্য। তখন বি ই কলেজের সামনে দিয়ে মাত্র তিনটে বাসরুট ছিলো। হাওড়া থেকে বি গার্ডেনের ৫৫ নম্বর বাস, বি গার্ডেন থেকে হাওড়া হয়ে ধর্মতলা ৬ নম্বর মিনিবাস আর বি গার্ডেন থেকে ধর্মতলা হয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত্য ট্রাম কোম্পানির বাস C6। এরও পরে চালু হয়েছিলো MS35 বি গার্ডেন থেকে নিক্কোপার্ক পর্যন্ত্য আর একটা ট্রাম কোম্পানির বাস T9 বি গার্ডেন থেকে মধ্যমগ্রাম। যতদুর জানি এর মধ্যে অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন বন্ধ হয়ে গেছে ১৯০৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত্য চলা হাওড়া শিবপুর এক কামরার ইলেকট্রিক ট্রাম। যদিও এখন ভূতল পরিবহনের কয়েকটা বাস চালু হয়েছে।
তৃতীয় সেমেস্টার সবে শেষ হয়েছে। সেকেন্ড গেট থেকে আমি, সন্দীপ মণ্ডল, রণজয় মানে মৃত আর দ্যুতিমান হাজরা বিকেলের C6 বাস ধরলাম। পরীক্ষা শেষ, রাতে গ্র্যান্ড ফিস্ট আছে, শীতটাও জমিয়ে পড়েছে। পকেটে সবাই কিছু টাকা নিয়ে বেড়িয়েছি, মানে শ'দুয়েক করে। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো ধর্মতলার ফুটপাথ থেকে একটা করে জ্যাকেট কিনবো আর বাকি পয়সায় কুলিয়ে উঠতে পারলে নিউ এম্পায়ারে একটা সিনেমা দেখবো। নিউ এম্পায়ারের পাশে একটা মুরগির খাঁচায় দাঁড়িয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে সবথেকে সস্তার টিকিট কিনে উপরের ব্লকে বসে সিনেমা দেখাই তখন আমাদের কাছে পরম বিলাসিতা। আর আমাদের রীতি ছিলো বাস সেকেন্ড ব্রিজ বা বিবেকানন্দ সেতু পার করলেই যে যেখানে পারবো টুকটাক খসে পড়ব, তারপর হাঁটতে থাকবো বাস রাস্তা ধরে ধর্মতলার দিকে। বাসের টিকিট কেটে বাজে পয়সা নষ্ট করতাম না। বিনাটিকিটে ভ্রমণের এইটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। তখন তো আর মোবাইল ছিলো না। তাই পরের স্টপেজে যারা নামতো তারা সেখানেই অপেক্ষা করতো যতক্ষণ না পিছন থেকে বাকিরা এসে হাজির হয়। অনেক সময় একজন টিকিট কাটতাম আর সব থেকে পিছনে নামতাম। কন্ডাক্টর টিকিট চাইলে বাকিরা পিছনের ব্যাক্তিকে দেখিয়ে দিয়ে কেটে পড়ত, আর পিছনের জন নেমে বেমালুম অস্বীকার করতো তার সাথে আর কেউ ছিলো বলে। একদম ধরা পড়লে বলতাম টোল ট্যাক্স থেকে উঠেছি, কারন তাতে পঞ্চাশ পয়সা বাঁচানো যেতো। হয়তো সেইসব কারনেই আজ আর ট্রাম কোম্পানি বি ই কলেজ থেকে বাস চালায় না।
সেদিনও আমরা পি টি এস, ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্র সদন এই সব জায়গায় ভাগাভাগি করে নেমে পড়েছিলাম, আর তারপর জড়ো হয়েছিলাম রবীন্দ্রসদনের কাছে। তখন ক্যাথেড্রাল রোড, মানে রবীন্দ্রসদন থেকে তারামণ্ডলের মাঝের রাস্তাটা সারাদিন দ্বিমুখী থাকতো। মাঝেখানে কোনো ডিভাইডারও ছিলো না। আমরা বামদিক দিয়ে ধর্মতলার দিকে হাঁটছি। তখনও ভিক্টোরিয়া আর রাস্তার মাঝের জায়গাটা ছিলো ফাঁকা মাঠ, মাঝে মাঝে মেলা হতো। ফোয়ারা বা মোহরকুঞ্জ ছিলো না। একাডেমী অফ ফাইন আর্টসের সামনে রাস্তার উল্টোদিক দিয়ে একটা ম্যাটাডোর প্রবল গতিতে বেশ কিছু লোক নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, হঠাৎ আমাদের সামনে এসে একটা যুবকের দেহ পড়লো। একটু থরথর করে কেঁপেই থেমে গেলো দেহটা। আর একটা ট্যাক্সি রবীন্দ্রসদনের দিক থেকে এসে সজোরে ব্রেক কষলো যুবকটির নাকের থেকে ঠিক এক আঙ্গুল দুরে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপরই দ্যুতি ছুটলো দুটো লেনের মাঝ দিয়ে যদি ধাক্কা মেরে পালানো ম্যাটাডোরের নম্বরটা দেখা যায় এই আশায়।
বাকি তিনজন ছুটে গেলাম দেহটার দিকে। আমি বুকে হাত রেখে দেখলাম বেঁচে আছে তখনও। কলকাতা শহরে ভিড় জমতে দেরি হলো না, কিন্তূ সবাই ময়নাতদন্তে ব্যাস্ত, অনেকে বিজ্ঞের মতো মতামত দিচ্ছে। পুলিশেরও দেখা নেই, আশাও করিনি। আমরা বললাম, দাদা একটু হাত লাগান, একটা এম্বুলেন্স ডাকুন। সবাই একে অপরের মুখ চাইছে, কেউ এগিয়ে আসছে না। এগিয়ে এলো সজোরে ব্রেক কষা সেই বিহারী টাক্সি ড্রাইভার। আমরা হাত ধরাধরি করে যুবকের দেহটাকে ট্যাক্সিতে তুলে পিছনের সিটে আমি আর মৃত কোলে নিয়ে বসলাম। ব্যাগপত্র নিয়ে সামনে সন্দীপ আর দ্যুতি। কোলে শোয়াতেই একটু নড়ে উঠলো দেহটা আর চোখের কোণ দিয়ে রক্তের ধারা আমার গায়ে থাকা জ্যাকেটটা ভিজিয়ে দিলো। হয়তো শেষ রক্ষা হলো না। সাতপাঁচ না ভেবে লাল কাপড় নাড়াতে নাড়াতে ট্যাক্সি ঢুকিয়ে দিলাম পিজি-র গেট দিয়ে।
সেদিন পিজির ইমার্জেন্সিতে ভাগ্যক্রমে এক কমবয়েসী ডাক্তার ছিলেন। আমাদের হাতে বেশী পয়সাও ছিলো না, কিন্তূ সেদিন কোনো নিয়মকানুন বা টাকাপয়সার কথা না বলে কাল বিলম্ব না করে তিনি যুবককে নিয়ে চলে গেলেন অপারেশন থিয়েটারে। বাইরে বেরিয়ে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখলাম সেই ট্যাক্সি হাওয়া। হয়তো মানবিকতার খাতিরে এই অল্প ভাড়ার জন্যে অপেক্ষা করেনি, অথবা হয়তো ভেবেছিলো হয়তো ছেলেটি মারা গেছে, আর ওর ট্যাক্সিতে ধাক্কা লেগেছে বলে পুলিশ ওকে ধরে জেলে পুরে দেবে। ভিতরে ডাক পড়লো। রক্ত দেখে সবাই স্থির থাকতে পারেনা, সন্দীপ আর দ্যুতির অবস্থ্যা দেখে ওদের বাইরে পাঠিয়ে আমি আর মৃত ঢুকলাম ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। ততক্ষনে ছেলেটির একটু জ্ঞান এসেছে। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ করা, শুধু চোখদুটি বাদে। মুখের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম বাড়ি কোথায়। ডায়মন্ড হারবার রোডের উপড় পর্ণশ্রীর কাছে একটা ঠিকানা কোনোমতে উদ্ধার করলাম।
ডাক্তারবাবু বললেন আর দশ-পনেরো মিনিট দেরি হলেই কিছু করার থাকতো না। তবে এখন প্রাথমিক বিপদ কেটে গেছে। পালিয়ে না গেয়ে বা পাবলিকের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে একটা জীবন বাঁচিয়েছি ভেবে খুব গর্ব হলো। আমরা চারজন ডাক্তারের অভয় শুনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে। দ্যুতিমান দুর্গাপুরের ছেলে, রণজয় মেদিনীপুরের, আমি বর্ধমানের, শুধু সন্দীপ ডোভার লেনের ছেলে হলেও বেহালার দিকে যায়নি। জায়গাটা এখন মনে না থাকলেও এটা মনে আছে সেখানে বাড়ির নাম্বারগুলো অদ্ভুতভাবে সাজানো ছিলো। মানে ১২০-র পর ৯২, তারপর ৮১। যাইহোক অনেক যুদ্ধ করে সেই বাড়ি তো পাওয়া গেলো, কিন্তূ ভাবনা শুরু হলো কে বাড়ির লোককে গিয়ে বলবে। যাইহোক মহৎ দায়িত্বটা আমিই নিলাম। মেটে রঙের জ্যাকেটটা উল্টো করে পড়লাম রক্তের দাগ যাতে চোখে না পরে। তারপর আর একজনের সাথে কড়া নাড়লাম বাড়ির দরজায়। দেখলাম যুবকটির বাবা কর্মস্থলে, বাড়িতে তার দিদি আর মা। বললাম আমরা বি ই কলেজের ছাত্র, ওনাদের ছেলেটির একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেরকম কিছু নয়। আমরা পিজিতে ভর্তি করে দিয়েছি, কিন্তূ স্বাভাবিক কারনেই বাড়ির লোক না গেলে ছাড়বে না, তাই এক্ষুনি একটু হাসপাতালে যেতে হবে। যাইহোক কিছু প্রশ্ন, পাড়ার লোকের কিছু সন্দেহের অবসান করে ট্যাক্সির সামনে ছেলেটির দিদি আর মাকে বসিয়ে, আমরা গাদাগাদি করে পিছনের সিটে বসে এলাম পিজিতে। সন্দীপ বা মৃত ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিলো। এরপর থেকে বাকিটায় অন্যদের নাম সবসময় ব্যবহার করবো না সঙ্গতকারনে। আসতে আসতে জানলাম ছেলেটি আমাদেরই বয়সি। এয়ার ফোর্সে চাকরির একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো। ছেলেটির দিদি আমার থেকে এক বছরের বড়।
আই সি ইউ তে ঢুকেই ওরকম সারা মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে দুজনেই আর্তনাদ করে উঠলো। এরপর একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটলো, যেটার কারনে আমি বাকি তিনজনের কাছে ইর্ষার পাত্র হয়ে গেলাম। যেহেতু আমি দায়িত্ব নিয়ে মিথ্যে কথা বলে ওদের বাড়ি থেকে এনেছি, তাই ভাইকে ওইভাবে দেখে ছেলেটির দিদি আমার জ্যাকেট ধরে নালিশ জানালো, 'তুমি যে বলেছিলে, ভাইয়ের কিছু হয়নি', বলতে বলতে আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো। আমার জ্যাকেটে ভাইয়ের রক্তের সাথে মিশে গেলো দিদির চোখের জল। এক অচেনা সুন্দরী যুবতী বুকে মাথা দিয়ে কাঁদছে, কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। নিজেকে কিরকম অসহায় মনে হলো। একটু পরে মাথায় হাত দিয়ে স্বান্তনা দিলাম। বুঝতে পারলাম এই দৃশ্য দেখে বন্ধুদের কারো কারো চোখ ইর্ষায় জ্বলছে। যদিও ডাক্তারবাবু ওনাদের অভয় দিয়েছিলেন আর আমাদের প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন।
যাইহোক ছেলেটির বাবা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়ার লোকেরাও অনতিবিলম্বে এসে হাজির হলো। আমাদের কাজ শেষ, ওঁনারা বললেও আমরা কোনো টাকা পয়সা বা ট্যাক্সিভাড়া হাত পেতে নিতে পারিনি। ওঁদের কাছে বিদায় নিয়ে এসে দাঁড়ালাম রবীন্দ্রসদনের মোড়ে। হিসেব করে দেখলাম বাকি পয়সায় সবার জ্যাকেট কেনা হবে না, আর তাছাড়া মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। তাই ঠিক করলাম কলেজ ফিরে যাই। ফাঁকা বাসে উঠে নিজেরাই সেদিন কন্ডাক্টরের কাছে সঠিক মূল্যে নিজের নিজের টিকিট কেটে চুপ করে বসে রইলাম এক একটা সিটে। এসে নামলাম সেকেন্ড গেটে, মেসে রান্না চলছে রান্না চলছে জোরদমে, হোস্টেল প্রায় ফাঁকা। নয় নম্বরে ঢোকার মুখের কালভার্টে বসে কিছুক্ষণ সদ্যঘটা দুর্ঘটনার আলোচোনা করতে গিয়ে ঠিক করলাম পালা করে আমরা দেখতে যাব যতদিন না ছেলেটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আরও ঠিক করলাম যা খরচ হয়েছে বা দেখতে যেতে যা হবে, সেটা চারজনেই ভাগাভাগি করে নেবো। সেইমতো তারপর আমরা তাই করেছিলাম পরের দিন দশেক। রাতে গ্র্যান্ড ফিস্টে একটা ভেজিটেবিল চপ ছিলো, সাথে টম্যাটো সস। সেই সস দেখে বিকেলের চাপ রক্ত চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো। না খেয়ে চারজনই শুধু আইসক্রিম হাতে বাইরের কালভার্টে গিয়ে বসলাম।
আমরা দেখতে গেলে ছেলেটি একদিন বলেছিলো সেই মাসেই ওর বাবা অবসর নেবেন, আর কিছুদিন পরেই ছেলেটিও বিমানবাহিনীতে যোগ দেবে। আমরা যে ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম, তাতেই ছিলো তার নিয়োগপত্র। আমাদের অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছিলো, আমরাও খুব খুশী হয়েছিলাম যেদিন পিজি থেকে ছেলেটিকে ছেড়ে দেয়।
………………………………..
সবকিছু এখানেই শেষ হলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তূ হঠাৎ একদিন হোস্টেলে একটা চিঠি এসে হাজির হলো আমাদের চারজনের মধ্যে একজনের নামে। সাধারনতঃ দুরে বাড়ি যাদের বা যারা বাড়ি খুব অল্প যেতো, তাদের কারো কারো বাড়ি থেকে ডাকে চিঠি আসতো। কিন্তূ এটা কলকাতার ডাকঘরের স্ট্যাম্প, একটু অন্যরকম। পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটার নয়, একটা রঙ্গিন খামে কয়েকটা পাতা। এসব ক্ষেত্রে যা হবার নয়, তাই হয়। চিঠিটা পড়লো অন্য একজনের হাতে। যার নামে এসেছিলো সে ছাড়া আমরা তিনজন এবং আরও কিছু উৎসাহী জনগণের সামনে মেসে কেটলির মুখের গরম বাষ্পে খামের আঁটা নরম করে চিঠি খোলা হলো। খুলতেই বেড়িয়ে এলো মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা তিন পাতার চিঠি। পড়তে গিয়ে চোখ কপালে উঠলো, মাথা গরম হয়ে গেলো।
এতো সেই ছেলেটির দিদি - ধরা যাক তার নাম অনামিকা। আমাদের মধ্যে একজনের নামে অনামিকার কাছ থেকে চিঠি। চিঠি পড়ে বোঝা গেলো সে নিজের দাবী জোরদার করতে বলেছে বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন অনামিকার থেকে বয়সে ছোটো, আর একজন নাকি ইতিমধ্যে অন্য কারো সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই সেই একমাত্র অনামিকার যোগ্য স্বপ্নের রাজকুমার। এইভাবে আমাদের সরিয়ে দিয়ে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করা - এতএব বন্ধুত্ব এক পলকেই উধাও। বিনাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইর্ষায় আর অবিশ্বাসে আমরা চড়াও হলাম তার উপড়। ধিৎকার দিলাম এই বলে যে সে বন্ধুত্বের অপমান করেছে; আর অনামিকার দুর্বলতা বা কৃতজ্ঞতা যার দাবিদার আমরা চারজনেই, সেটার সে একাই সুযোগ নিয়েছে। আমরা এতো হতবাক যে কোনো অজুহাত, যুক্তি শুনতে রাজি নই। এমনও দাবী করেছিলাম যে, তুই যখন একাই ক্ষীর খাবি, তখন আমরা কেনো লোকসান করবো। অতএব দে শালা সুদসমেত পুরো ট্যাক্সিভাড়া ফেরত। এও বললাম না দিলে ফোন করে তোর শাশুড়ীর কাছ থেকে চাইবো।
যে দুজনকে বয়সে ছোটো বলে সরিয়ে দিয়েছিলো, তার মধ্যে আমিও ছিলাম। বললাম এটা অন্যায়, আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিলো যখন তখন দাবিটা আমারই বেশী ছিলো। মনে করিয়ে দিলাম বয়সের ছোটো বড়তে কিছু হয়না, মনের মিলটাই আসল। উদাহরণ দিলাম সইফ আলি খানের তখনকার বউ অমৃতা সিংহের বা শচীন তেন্ডুলকারের হবু বউ অঞ্জলির। অন্যজন বললো, তুই কি আমার জন্মের প্রমাণপত্র দেখেছিস, আমি এখুনি আমার বয়স এক বছর বাড়িয়ে ফোন করবো, আর বলবো তোর আসল বয়স যা বলেছিস তার থেকেও পাঁচ বছর বেশী। তৃতীয়জন সত্যি সত্যি কারও সাথেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো না। তাই তার দাবী ছিলো, কে বলেছে তোকে যে আমি এনগেজড। এর থেকে তুই যদি বলতিস আমি কালো বা ঘুমলে আমার নাক ডাকে তাও মানা যেতো। এটা মানতে পারবো না, আমি নিজের পয়সায় ট্যাক্সি ভাড়া করে গিয়ে তোর হবু শাশুড়ীকে সব বলে আসবো। বলবো বি ই কলেজের সব ছেলে বজ্জাত, তাই মেয়েকে সামলান।
……………
কয়েকদিন এইভাবে চললো, আস্তে আস্তে আমরা ব্যাপারটাকে আঙ্গুরফল টক বলে ভুলে গেলাম। ওদের প্রেম বা প্রেম প্রেম খেলা চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে ছেলেটি সেজেগুজে, সেভ করে একাই সেকেন্ড গেট থেকে কলকাতার বাস ধরতো, আমরা বঞ্চিতের দল অবজ্ঞার হাসি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম। মনে মনে অভিসম্পাত করতাম, বলতাম দেখ মেয়ের মা দেখেছে বি ই কলেজের ইঞ্জিনিয়ার জামাই পাবে, তাই সম্মতি দিয়েছে। তারপর তৃতীয় বছরে ছেলেটি হলে চলে গেলো, আমি দশ নম্বর হোস্টেলে আর বাকি দুজন অন্যত্র। চতুর্থ বছরে একদিন ছেলেটির পাশের রুমের একজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, যে ব্যাপারটা ছেলেটার দিক থেকে অনেকটা এগোলেও মেয়েটি একটু টাইম পাস করছিলো। আমরা ভাবতাম হয়তো ছেলেটা কলকাতায় যায়, তারপর দুজনে হাতে হাতে, চোখে চোখ রেখে ভিক্টোরিয়া বা ময়দানে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে একসাথে কোনো রেস্তোরাঁতে রাতের খবর খেয়ে আসে। আসলে মেয়েটা শুধু ফোনে আর চিঠিতেই যোগাযোগ রাখতো। আর ছেলেটি তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতো। সেই আত্মীয় মানে কাকু কাকিমা অফিস থেকে দেরী করে ফিরতো, তাই তাদের আসার আগে নির্বিঘ্নে ফোনালাপ চলতো। তারপর কাকু কাকিমা ফিরলে রাতের খাবার খেয়ে হোস্টেলে ফিরে আসতো। ছেলেটি নিজের বাড়িতেও বলেছিলো অনামিকার কথা। অনামিকা অনেক অনুরোধ উপরোধে একটা ছবি পাঠিয়েছিলো, একটা গ্রুপ ফটো, তাও অনেক দূর থেকে তোলা। মুখ প্রায় বোঝাই যায় না সেই ছবিতে।
ততোদিনে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ প্রায় অনেকগুলোই হয়ে গেছে, ছেলেটি মরিয়া চেষ্টা করেও একটাতেও নির্বাচিত হয়নি। মাস্টারডিগ্রির জন্যে গেট দিয়েও সুযোগ পায়নি। একদিন ছেলেটি জানতে পারে অনামিকারা বাড়িবদল করছে, তাই পুরনো নাম্বার কাজ করছে না। নতুন বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নাম্বার যথাসময়ে জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ছেলেটি অনুরোধ করেছিলো একবার সামনাসামনি দেখা করতে। অনামিকা অবশেষে রাজি হয় বাড়ি বদলের ঠিক আগের দিন। বলে তার এক বান্ধবীর সাথে আসবে, দেখা হবে বইমেলার গেটে। তখন বইমেলা হতো পার্কস্ট্রিটের মোড়ের উল্টোদিকে, ময়দানে। ছেলেটিও হাজির হয় সময়ের আগেই সেই পাশের রুমের ছেলেটিকে সাথে নিয়ে। কিন্তূ সেই দেখা আর হয়নি, কারন সেদিন বইমেলাতে আগুন লেগে প্রায় দশ হাজার বই পুড়ে যায় - এই কাহিনীটিকে সঙ্গে নিয়ে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.