- ১৬. নয় থেকে দশ
এই পর্বে থার্ড সেমেস্টারের পর থেকে দ্বিতীয় বর্ষের বাকি দিনগুলো। আমাদের রুমের তিনজনই মানে আমি, সন্দীপ আর সমিত ছিলাম সিভিলের 'বি' সেকশনের ছাত্র। সেকশন আর রোল নম্বর ঠিক হতো ইংরেজিতে পদবির বানান অনুসারে। হোস্টেল নয়ের পুরোনো ছাত্রদের মধ্যে 'বি' সেকশন হবার সুবাদে আমাদের সাথে মিশে গেলো পলাশ, যাকে আমরা পাগলু বলতাম। সমিত ছিলো বেশ ফান্ডাবাজ, আর একটু খামখেয়ালী। আমি আর সন্দীপ পড়াশুনোয় মোটামুটি ছিলাম, তাই তালিকায় মাঝামাঝি দিকে থাকতাম। পাগলু মাঝে মাঝেই আমাদের রুমে একসাথে পড়তে আসতো। আমাদের সময় কলেজের সেকশন আর ছাত্রসংখ্যাগুলো নিচে দেওয়া হলো। এখন অল্প অদলবদল হয়েছে বা শীঘ্রই হবে:
সিভিল - মোট ৯০ - সেকশন AX, AY, BX, BY
ইলেকট্রিকাল - মোট ৬০ - সেকশন CX, CY
মেকানিকাল - মোট ৬০ - সেকশন DX, DY
মেটালার্জী - মোট ৩০ - সেকশন EX
মাইনিং - মোট ৩০ - সেকশন EY
ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন - মোট ৩০ - সেকশন FX
কম্পিউটার সায়েন্স - মোট ৩০ - সেকশন FY
আর্কিটেকচার - মোট ২৪ - কোনো সেকশন ছিলো না এবং একমাত্র পাঁচবছরের কোর্স।
এছাড়াও আমাদের আগের বছর জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ভর্তি নিয়ে একটা কোর্ট কেস হয়। আদালতের নির্দেশে ঠিক হয় অন্য রাজ্যের মনোনীত এবং তপসিল জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন ভর্তি না হলে, ক্রমতালিকায় পিছনে থাকা সাধারন ছাত্রদের সুযোগ দিতে হবে সেই আসনগুলো ভর্তি করবার। আমাদের সময় ক্রমতালিকা মানে ছিলো সর্বাধিক ১৮০০ বা ২০০০। আদালতের নির্দেশে আগের বছরের সেই ছেলেদের জায়গা দিতে কয়েকটি ডিপার্টমেন্টে আসনসংখ্যা কিছু বাড়ানো হয়। যেমন সিভিলের আসনসংখ্যা ৯০ হলেও আমাদের সময় প্রায় ১০৬ জন প্রথমে ভর্তি হয়। পরে কিছুজন ছেড়ে যায়, কিছুজন ডিপার্টমেন্ট বদল করে, আবার বছর নষ্ট হওয়ায় আগের বছরের দুয়েকজন এসব নিয়ে প্রায় ৮৬ জন শেষ পর্যন্ত্য ১৯৯৭ সালে সিভিলে স্নাতক হয়। যতদুর মনে পরে আমি সবথেকে খারাপ ক্রম ৪৯ করি দ্বিতীয় সেমেস্টারে আর সপ্তম এবং নবম সেমেস্টারে ১২ বা ১৫ করে, শেষ করি চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ নম্বর হিসেবে। কিছুজন বেশ ফাটাফাটি নম্বর পেতো। ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হলে তাকে বলা হতো ডিপু আর সব ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ে মানে ফ্যাকালটিতে ফার্স্ট হলে বলা হতো ফ্যাকু। আমি স্নাতকের সময় ডিপু বা ফ্যাকু হওয়ার ধারে কাছে থাকতাম না।
তবে যখন সমাবর্তনে দেখলাম চারবছরের শেষে যারা ডিপার্টমেন্টাল ফার্স্ট, ডিরেক্টর তাদের মঞ্চে ডেকে একটা করে মেডেল পড়িয়ে দিচ্ছেন তখন খুব আফশোস হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো একটু মন দিয়ে তো পড়লেই হতো। কিন্তূ তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। তারপর ভাবলাম, ধুর সবাই কি আর ফার্স্ট হয়। পরে কখনো সুযোগ পেলে দেখা যাবে। পরে সুযোগও এসেছিলো, কারন বি ই কলেজ থেকেই স্নাতকোত্তর শিক্ষালাভ করেছিলাম। তাতে অনেকেই আমার থেকে বেশী বয়স্ক বা অভিজ্ঞ ছিলেন। একজন তো আমার থেকে ঠিক ত্রিশ বছর আগে আমাদের কলেজেরই সিভিলের স্নাতক ছিলেন। তবু একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পুরোদস্তুর চাকরি করতে করতে পড়াশুনো চালাতাম। মাঝে মাঝেই অফিসিয়াল ট্যুরেও যেতে হতো। শুধু শেষ সেমেস্টারটা স্পেশাল স্টাডি লিভ পেয়েছিলাম। তাও ২০০২ সালের মাস্টার ডিগ্রী পরীক্ষায় ফেকালটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার এবং টাউন ও রিজিওনাল প্ল্যানিং-এর সমস্ত পরীক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ইউনিভার্সিটি মেডেলের দাবীদার হয়েছিলাম। তখন যদিও আমি কলেজে মাঝে মাঝেই যেতাম আর থাকতাম কলেজ থেকে পাঁচ মিনিট দুরেই স্বরস্বতী প্রজ্ঞানন্দ স্কুলের ঠিক বিপরীতে, কিন্তূ আমাদের কলেজের প্রশাসনিক অবহেলায় সমাবর্তনের খবরটুকু কলেজ বা ডিপার্টমেন্ট কোথা থেকেই পাইনি। অবশেষে সান্মানিক রৌপপদকটি সর্বসমক্ষে গ্রহণ করার সুযোগ হারিয়ে, এক্সামিনেশন সেন্টার থেকে দুদিন পরে চুপিচুপি তুলে নিয়ে এসেছিলাম। এই কারনেই, বিরক্তিতে তারপরে প্রায় চার পাঁচ বছর কলেজের পথ খুব একটা মারতাম না।
ফিরে আসি হোস্টেল নয়ে। তৃতীয় সেমেস্টারে আমাদের ছিলো প্রথম সার্ভে ক্যাম্প। পরীক্ষা শেষ হলো, সব ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা বাড়ি চলে গেলো, শুধু সিভিলের ছেলেমেয়েরা রয়ে গেলো। আরও ছিল কিছু জনগন, যাদের বাড়ি খুব দুরে। সাধারনতঃ সিকিম, ভুটান বা উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলো থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা আসতো, তারা অনেকেই থেকে যেত। এদের মধ্যে যাদের দেখতে চীনাদের মত বা মঙ্গোলিয়ান মুখমন্ডল, তাদের নিজেদের একটা দল থাকতো। এরা খুব কমই দলের বাইরে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতো। আমরা এদের বলতাম চ্যাং। কারন এরা সাপ, ব্যাঙ, কুকুর এসব খায়। তবে শুধু এরাই নয় আমাদের সময় রিচার্ডসনের কিছু জনগন একটা মেটে সাপ মেরে সেটাকে পুড়িয়ে খেয়েছিলো। এরা সবাই তথাকথিত চ্যাং নয়, বরং বং - বঙ্গসন্তান। সেইসব বাঙ্গালীরা সেটা খেয়ে দাবী করেছিলো একদম মাছের মতো খেতে। এছাড়াও অনেক হিন্দু বা ব্রাহ্মণ সন্তান কাজিপাড়ায় গিয়ে গোমাংসের কাবাব আর পরোটা সাঁটিয়ে আসতো। আবার সেরকমই কিছু মুসলিম ছাত্র হোস্টেলে কখনো শুয়োরের মাংস হলে, সানন্দে সেই স্বাদও গ্রহন করতো। অর্থাৎ সুযোগ পেলে মানুষ যে সর্বভুক তার জ্বলন্ত প্রমান।
…………..
এই প্রসঙ্গে আমার ছোটোবেলার একটা ছোট্ট ঘটনা। ষষ্ঠ আর সপ্তম শ্রেণী পড়েছিলাম পুরুলিয়ার ঝালদাতে। জায়গাটা প্রায় পশ্চিমবঙ্গের সাথে ঝাড়খন্ডের (তখন বিহার) সীমান্তে। তখন অনেক শান্তিপুর্ন জায়গা ছিলো। বরং আমার বাবা যেহুতু সরকারী পদস্থ আধিকারিক; তাই বাবার সাথে আড়া, হুড়া, খাতড়া, বাগমুন্ডি - যেখানেই যেতাম; দেখতাম সাদর সন্মান আর তার সাথে গ্রামের মোড়ল বা মান্যগন্য লোকেদের ভালবাসার উপহার কলাটা, মুলোটা বা মুরগিটা। আমার বেশ কিছু সহপাঠী ছিল মাজি, কুর্মি বা সাঁওতাল; যাদের সাথে খেলতে তাদের পাড়ায় যেতাম। অভাবের সংসারে ওদের মূল খাবার ছিলো বাঁশের কোরক, ফুলকপির পাতা, কন্দমূল ইত্যাদি। একদিন ওদের পাড়ায় গেছি এক বন্ধুর মা বললেন, 'বাবু আজ আমাদের বাড়ি খেয়ে যাবি, মাংস করেছি'। লোভী মন এক কথাতেই রাজী। অল্প পরিমানে ঢেঁকি ছাঁটা মোটা লাল চালের ভাতের সঙ্গে বেশ নরম তুলতুলে মাংস, ঠিক যেন কাঁটাছাড়া মাগুর মাছের টুকরো। পরে বন্ধুদের সাথে হালকা হলুদ পাকা মহুয়া ফলের কচকচে টুকরো খেতে খেতে জানতে চেয়েছিলাম, সুস্বাদু সেই মাংস কিসের? এক বিষাক্ত সাপের মাংস শুনে প্রায় বমি উঠে আসার জোগাড়। পরে একদিন মাংস খাবার প্রস্তাব পেয়ে সবিনয়ে এবং সভয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সেদিন নাকি ধানের মড়াই থেকে ধরা খানকয়েক ধেড়ে ইঁদুরের মাংস হয়েছিল।
……………
আমাদের সার্ভে ক্যাম্পে বেশ মজা হতো। ফার্স্ট লবির সামনে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকতো, যেটাকে বেঞ্চ মার্ক ধরে সার্ভে করা হয়। গাছ, ল্যাম্পপোস্ট, অন্য বস্তু বা যেকোনো বাড়ির অবস্থান এবং দিক নির্ণয় হত বেঞ্চ মার্ক থেকে। সিভিলের সব ছেলেমেয়েকে বেশ কয়েকটা গ্রুপ বা দলে ভাগ করে দেওয়া হতো। সব দলের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে অধ্যাপক। আমার তাত্ত্বিক বিষয়ে (Theoretical Subjects) আগ্রহ পরিমিত থাকলেও, বরাবর ব্যবহারিক বিষয়গুলিতে (Practical / Sessionals) বেশ উৎসাহ থাকতো। যতদূর মনে পরে একটা দলে ছিলাম আমি, সন্দীপ, রাজেশ মিত্র, অরূপ মুন্সী, পলাশ মানে পাগলু, অপূর্ব মন্ডল মানে সিভিলের ডিপু, সৌগত মানে গুললু, সিতাংশু, সুব্রত পান্ডা আর সুনন্দন লাহিড়ী মানে হাম্পু। সবাই যে ক্লাসের রোল নাম্বার অনুসারে তা নয়, কিছুটা নিজের পছন্দ বা নিজের হোস্টেলের জনতার সঙ্গে দলে ভিড়ে যেত। আমাদের দলের দায়িত্বে মূলতঃ ডঃ অমলেন্দু ঘোষ। তবে অন্যরাও মাঝে মাঝে ঘুরে যেতেন বা দরকারে সাহায্য করতেন, যেমন প্রোঃ বি চ্যাটার্জী, ডঃ পি কে রায় এবং আরো অনেকে।
আমাদের মূলতঃ চারটে বিষয় নিয়ে ফিল্ড সার্ভে বা জরিপ করানো হতো তৃতীয় সেমেস্টারে। একটা ছিলো চেইন সার্ভে বা শৃঙ্খল দিয়ে জরিপ। যাতে একটা শিকল দিয়ে একটা জায়গা জরিপ করে আসা হতো। একটা বাহুর সঙ্গে পরবর্তী বাহুর কোণ বা দিকনির্দেশ করা হতো, সংযোগস্থলের কাছাকাছি কোনো গাছ বা কোনো বাড়ির কোণা থেকে দুরত্ব মেপে। পুরো ক্ষেত্র বা জায়গাটা ঘুরে এসে যেখানে শুরু হয়েছিল, সেখানেই শেষ করা হতো। এরপর সব থেকে আকর্ষণীয় ছিল, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত্য নকশা ড্রয়িং সিটে আঁকলে দেখা যেত কিছুটা ভুল হয়েছে, যেটাকে বিভিন্ন কারন গণনা করে সমানুপাতে সবকটা বাহুতে সংশোধন করে আসল ক্ষেত্রটা পাওয়া যেত। তারপর বসানো হতো সব গাছপালা, বাড়িঘর, ল্যাম্পপোস্ট ইত্যাদি। নতুন নতুন সব কায়দা, দেখা যাচ্ছে না সেরকম বস্তুকে চিহ্নিত করা, শুধু একটা শেকল দিয়ে সব মাপ, মানে দুরত্ব বা উচ্চতা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা এসব বিদ্যে রপ্ত করতে বেশ দারুন লাগতো।
সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই এই বিদ্যেটি আবিস্কার করেছিলেন এডমন্ড গুন্টার নাম এক পাদ্রী ১৬২০ সালে, তাই এই শিকলের আরেকনাম গুন্টার চেন। নির্ভুল জরিপ করার জন্যে সবচেয়ে সহজ উপকরণ। এই শিকলের ১০০টি আংটা থাকতো, যেগুলো একটা করে রিং দিয়ে জোড়া থাকতো। প্রতি দশ নম্বর রিংটা পিতলের তৈরী হতো মাপের সুবিধার জন্যে। এক একটি আংটা হতো ৭.৯২ ইঞ্চি, তার মানে সর্বমোট ৭৯২ ইঞ্চি বা ৬৬ ফুট বা ২২ গজ। এখনো ইউরোপের রেলওয়ে থেকে শুরু করে আমাদের দেশেও অনেক ব্যবহারিক কাজে গুন্টার চেন ব্যবহার হয়। ক্রিকেট পিচের দৈর্ঘ্য হলো এক গুন্টার চেন, মানে ২২ গজ। তবে আমরা যে চেইন সচরাচর ব্যবহার করি সেগুলো হয় ২০ মিটার বা ৩০ মিটারের মেট্রিক চেইন। পিতলের রিং থাকে প্রতি মিটারের মাথায় আর প্রতি পাঁচ মিটারে একটা করে ট্যাগ। এই চেইন প্রতিদিন গুটিয়ে রাখা আর ধীরেসুস্থে না প্যাঁচ খাইয়ে খোলা একটা বেশ ঝকমারী কাজ ছিলো, তাই ভাগাভাগি করে করা হতো।
এছাড়া থাকতো কম্পাস সার্ভে বা কম্পাস দিয়ে একটা ক্ষেত্রের মাপজোপ। তারপর প্লেন টেবিল সার্ভে বা সমতল টেবিল জরিপ, যেখানে ড্রয়িং বোর্ডকে জরিপের শীর্ষবিন্দুতে বসিয়ে ক্ষেত্রের বাহুর সঙ্গে মিলিয়ে জরিপ করা হতো। আর ছিলো লেভেলিং বা সমতলকরণ, যেখানে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দু পর্যন্ত্য বিভিন্ন জায়গায় ভূমির উচ্চতার নকশা আঁকা হতো। এই উচ্চতা ঠিক হতো সমুদ্রপিষ্ঠের উচ্চতার সাথে পার্থক্য হিসেব করে বা কোনো পূর্বনির্ধারিত জায়গার একটা উচ্চতা অনুমান করে নিয়ে। আর শেষে থাকতো কনটুরিং বা সমোন্নতি-রেখা নির্ধারণ। ক্ষেত্রের সমস্ত জায়গার উচ্চতা বের করে সমান উচ্চতার জায়গাগুলো একটা রেখা দিয়ে যোগ করা।
এসব করতে গিয়ে পরিচয় হতো বেশ অভিনব সব জিনিসের সাথে। কাঠের বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরী লেভেলিং স্টাফ বা উচ্চতা মাপার দণ্ড। এটা অনেক সময় এডজাস্টেবল হতো - কমানো বাড়ানো যেতো, ব্যবহারের এবং রাখার সুবিধার জন্য। আর তার দোসর ছিলো ডাম্পি লেভেল, একই সমতলে কোনো বিন্দুর অবস্থান বা উচ্চতা মাপার জন্য। ডাম্পি লেভেলের বীক্ষণ যন্ত্রের নিচে একটা কাঁচের নল, তাতে একটা তরল থাকতো, যেটা মাঝামাঝি থাকলে বোঝা যেতো ডাম্পি লেভেল ঠিক বসানো হয়েছে। দুজন চেইন ধরে রাখতো, একজন নির্দিষ্ট জায়গায় লেভেলিং স্টাফ ধরে দাঁড়াত, একজন চেইন থেকে সেই জায়গার দুরত্ব ফিতে দিয়ে মাপতো, একজন ডাম্পি লেভেলে চোখ রেখে মাপ নিতো আর একজন সার্ভে নোটবুকে সেই হিসেব তুলে নিতো। আরো কেউ দলে থাকলে তার কাজ হতো সব ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তা চেক করা। বেশ একটা দলবদ্ধ প্রয়াস, বেশ মজা লাগতো। তবে অনেকসময় সার্ভে করতে করতে স্টাফ কোয়ার্টার বা অধ্যাপকদের বাসস্থানের দিকে চলে গেলে ডাম্পি লেভেল দিয়ে লেভেলিং স্টাফের মাপ ধরা না পরে, ধরা পড়ত কোনো বালিকা বা যুবতী বা তরুণী বা কোনো ঘরণী। তবে আমরা ফাঁকি মেরে তাড়াতাড়ি জরিপ বন্ধ করতাম না। কাজ হয়ে যাক বা না যাক বিকেল চারটের একটু আগে মোটামুটি অনেকেই জরিপ করতো সেকেন্ড গেট দিয়ে হোস্টেল নয়-দশের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটার আশেপাশে। কারণ মডেল স্কুলের মেয়েরা ছুটি হলে ওই পথ দিয়েই বাড়ি যেত। এইসব পাঠক্রম বহির্ভূত কাজকর্মের জন্যে রাতে হোস্টেলে ফিরে একটু গোঁজামিল দিয়ে জরিপের হিসেব নামাতে হতো বা দলের মধ্যে ভালো ছেলেদের সততা এবং নারীজাতির প্রতি অনাগ্রহের উপর ভরসা করতে হতো।
হোস্টেল ফিরে প্রথম কাজ হতো বিকেলে টিফিন সেরে এসে, রাতের খাবারের যোগাড় করা। বেশ কিছু ছেলে থাকলে সেই হোস্টেলে মেস খোলা থাকতো। তবে আমরা অনেকেই নিজেরাই রান্না করতাম বা শ্যামদার হোটেলে অথবা ধর্মতলা থেকে সিনেমা দেখে ফেরার সময় কোনো ফুটপাথের স্টলে রাতের খাবারটা সেরে আসতাম। নিজেদের রান্নাটাও বেশ রোমাঞ্চকর হতো। চালু মেনু ছিলো ভাত, আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ আর তার সাথে আর যা কিছু সেদ্ধ করা যায় মানে ডাল, পেঁপে, কুমড়ো ইত্যাদি। আহাঃ একটু মাখন বা ঘি দিয়ে কোনোদিন গলে যাওয়া, কোনদিন শক্ত থেকে যাওয়া ভাত-আলু সহযোগে অমৃতের আস্বাদ নিতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো একটু সবজি দিয়ে ডাল বা তরকারী করতে। কোনো কোনো দিন হয়তো শুরু করতাম একটা পদ, শেষ হতো অন্য একটা পদে। এর মাঝে দুয়েকবার দারুন সুস্বাদু কিছু তৈরী হয়ে যেত, তবে কিভাবে সেটা বলা ভারী মুস্কিল। আর সার্ভে ক্যাম্পের শেষে বা সপ্তাহান্তে বাইরে থেকে রুটি কিনে এনে মুরগির মাংস রেঁধে দারুন একটা ভোজ হতো। একবার তো তার সাথে টমাটোর চাটনিও করেছিলাম, শুধু রঙটা একটু কালো হয়ে গিয়েছিলো এই যা।
এছাড়াও ক্যাম্পের মাঝে কখনও সখনও অন্যসময়ের মতো বসতো মদ্যপানের আসর। তবে তখন দোকান বা পয়সা দুটোই কম থাকায় এসব খুব কমই হতো। অনেকেই খেত না, তার অবশ্য বিভিন্ন কারণ ছিলো। বাড়ির বারণ, প্রেমিকার দিব্যি, নিজের শপথ এসব বোরিং কারণ ছাড়াও অনেকে ভাবতো পেতে দুফোঁটা পেটে পড়লেই কি না কি বলে ফেলবো, তখন আরেক বিপদ। এসব কারনে না হলেও, আমি কলেজ জীবনে মদ্যপান করিনি। কারণ একবার এক চুমুক রাম খেয়ে এতো জঘন্য লেগেছিলো যে হড়হড় করে বমি করে দিয়েছিলাম। আসলে কুকুরের পেটে তো ঘি সহ্য হয় না, তাই হয়তো। তবে আমাদের ঘরে বা বন্ধুদের ঘরে মদের আসরে আমি থাকতাম, চাট তৈরী করে দেবার জন্যে। শসা, পিঁয়াজ, মোটরশুঁটি, টমেটোর স্যালাড বা চানাচুরের সাথে পিঁয়াজ লঙ্কার চাট তৈরী করতে গিয়ে মোটামুটি আমার রাতে খাবার খাওয়া হয়ে যেত। আর একটা আগ্রহ ছিলো একটু পেটে পড়ার পর আসরের মধ্যমনিদের বেশ রসালো স্বীকরোক্তি বা উপভোগ্য মাতলামী।
……………………….
হোস্টেল নয়ে আরো কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি আছে। হোস্টেলের দরজায় রুমের আবাসিক যতোজন, ততোগুলো তালা ঝোলানো থাকতো মালার মতো করে। প্রথমে ঢুকলে সবাই নিজের তালা খুলে ঘরে ঢুকতো বা শেষে বেরোলেও সেই নিয়ম। আমাদের দরজাগুলো বাইরের দিকে খুলতো। তবে একটানে খোলা যেতো না, তাতে দুটো লোহার পাল্লা আরো আটকে টাইট হয়ে যেতো। আর বেশী জোরে টানলে হঠাৎ খুলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা থাকতো। দোতলার একটা ঘরে প্রোঃ পি কে রায় থাকতেন। শোনাকথা সেই রুমের দরজায় ওনারই হাতের লেখা। যা লেখা ছিলো তা হলো "দরজা খোলার নিয়ম কানুন, আস্তে ঠেলে, এবার টানুন!" কোনো দরজায় লেখা থাকতো, 'আগে কড়া নাড়ুন, সাড়া না পেলে লাথি মারুন, তাতেও না হলে পরে আসুন'।
……………………….
এছাড়া হোস্টেলের ২০১ বা ৩০১ বা ৪০১-এর সামনে সকাল বিকেল একটা ভিড় জমতো, মডেল স্কুল শুরু আর ছুটির সময়। মাঝে মাঝে উৎসাহী জনতার গায়ে এসে পড়তো এক বালতি জল। সেই দুর্দশা মডেল স্কুলের ছাত্রীরাও বেশ সানন্দে উপভোগ করতো। এই নিয়ে মারামারি বা বাওয়ালিও হতো অল্পবিস্তর। হোস্টেল নয়ের এক আদি বাসিন্দা, আমাদের সাথেই মাইনিং পড়া এক ছাত্র নাকি মডেল স্কুলের এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েছিলো। কিন্তূ সেই চপলমতি বালিকা সব হোস্টেলের সব ফ্লোরের সব ছেলের দিকেই তাকিয়ে বেশ প্রাণখোলা হাসি হাসতো। কিন্তূ সেই নায়কের মনে হতো সবাই তার হবু বউের দিকে ঝাড়ি মারছে। সেই নিয়ে একদিন বিশাল ঝামেলা হয়ে গেলো।
……………………….
হোস্টেল নয় আর হোস্টেল দশ ছিলো একদম পাশাপাশি। তাই যেমন জানলা দিয়ে দুই হোস্টেলের বাসিন্দাদের মধ্যে আলাপ চলতো, তেমন মাঝে মাঝেই বাওয়ালি বা ঝামেলাও হতো। একবার কেউ একজন রাস্তার কিছু নুড়ি পাথর কুড়িয়ে খেলার ছলে ছুড়ছিলো হোস্টেল নয়ের দিকে। সেই সুত্রে দুই হোস্টেলের মধ্যে এক রাতে বিশাল ঝামেলা হয়ে গেলো। হাতাহাতি হয়নি, এই যা। তবে সেই ঝামেলায় কেউ নয় থেকে বলেছিলো, দশের জনগনের 'ছিঁড়ে আনবো', মানে ভদ্রভাষায় বিশেষ স্থানের কুঞ্চিত কেশদাম উৎপাটন করবো। সেই শুনে আমাদের বছরের সিভিলের এক ছাত্র উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিল, 'আয় কে ছিঁড়বি আয়'। বাইরের লোকজন পাশের রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার সময় এই নাটক বেশ উপভোগ করছিলো।
তবে একবার, যতদুর সম্ভব ফোর্থ সেমেস্টারের সময় বেশ বাড়াবাড়ি রকমের ঝামেলা হয়েছিলো। নয়ে থাকত মেকানিকালের চয়ন পাণ্ডা বা পাণ্ডু। কোনো কারনে ডিপার্টমেন্টে সিনিয়াররা ওকে কিছু হুমকি দেয়, সেই দলে ছিলো দশের এক সিনিয়ার। হোস্টেলে রটে গেলো ডিপার্টমেন্টে দশের সিনিয়াররা পাণ্ডুকে কেলিয়েছে। মানে লোকমুখে হুমকি হয়ে গেলো একবারে উত্তম মধ্যম। সেই নিয়ে উত্তেজনা শুরু, নয়ের বেশ কয়েকজনের একটা দল সেই রাতে দশে গিয়ে সেই সিনিয়ারকে একটু ধোলাই দিয়ে এলো, তাতে নাকি মশারী টাঙানোর জন্যে ব্যবহৃত লোহার রডও কেউ নিয়ে গিয়েছিলো। ব্যাস আর যায় কোথা, হোস্টেল নয় বনাম হোস্টেল দশ ঝামেলা শুরু। আমরা সবাই প্রায় সেই ঝামেলায় হোস্টেলের বাইরে বেড়িয়ে এলাম। গোটা মুচিপাড়া শুধু নয়, সাহেবপাড়া থেকেও লোকজন জড়ো হয়ে গেলো। পাল্টা মার দিতে দশের কিছু সিনিয়ার আসতে পারে এই আশঙ্কায় হোস্টেল নয়ের সব দরজা জানলা বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা যারা বাইরে তারা আটকা পরে গেলাম। হল থেকে বেশ কিছু সিনিয়র বা ছাত্র সংগঠনের নেতারা ব্যাপারটা মেটানোর জন্য এসে হাজির হয়েছিলো। মনে হয় পাম্পু, অশেষ পাল, ড্যাড এরা ছিলো সেই দলে। কিন্তূ কোনো সমাধান করা যায় নি।
রাতের দিকে এলেন কিছু অধ্যাপক। মেকানিকালের বিভাগীয় প্রধান, পিকসা (Professor In Charge of Students' Affairs - PICSA) সুদ্ধু আরও কয়েকজন। কিন্তূ উত্তেজনা তখনও পুরোমাত্রায়, যারা নয় থেকে গিয়ে দশের সিনিয়রদের পিটিয়ে এসেছিলো তারা উদ্বিগ্ন হয়ে নয়ের চারতলায় বসে জটলা করছে। উপস্থিত অধ্যাপকরা আলোচনা করে ঠিক করলেন ডিরেক্টরকে ডেকে আনা ছাড়া উপায় নেই। তখন তো আর মোবাইল ছিলো না, তাই সামনে থাকা আমাদের কয়েকজনের উপড় ভার পড়লো ওনাকে খবর দেবার জন্যে। এই সুযোগে প্রথম এবং শেষবার ঢুকেছিলাম ডিরেক্টরের প্রাসাদোপম বাসভবনে। গার্ডকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ওভালের দিকের বিশাল গেট হাউসের ঢালাই লোহার তৈরী দরজার সামনে। নজরে পড়লো চারটে অষ্টকোণি পিলারের একটির গায়ের ছোটো দরজাটা খোলা, আর তার মধ্যে দিয়েই উঠে গেছে ঢালাই লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। কি অপূর্ব স্থাপত্য। ডিরেক্টরের অনুমতি আসার পর ঢুকলাম সুবিশাল গেট হাউসের মধ্যে। শাল কাঠের মসৃন ও কারুকার্য্য করা ঘোরানো সিড়ি উঠে গেছে দোতলার বেলে পাথরের মেঝের দিকে। গেট হাউসের মধ্যে কয়েকটা বেশ নকশা করা বেলজিয়ান কাঁচের জানালা।
তখন ডিরেক্টর সেই বিমল সেন। প্রায় রাত দেড়টার সময় ঘুম থেকে উঠে এসে বিষয়টা শুনে বললেন 'গিয়ে বলো আমি আসছি'। ওনার আসতে একটু সময় লাগবে আন্দাজ করে আমরা বিদিশা ঝিলের পাড় ধরে, ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে গল্প করতে করতে হোস্টেলের দিকে রওনা দিলাম। আমরা হোস্টেলের কাছে এসে পিকসা ও অন্য অধ্যাপকদের সবে ডিরেক্টরের বক্তব্য পেশ করছি, গটগট করে এসে হাজির হলেন ডঃ বিমল সেন। ওইটুকু সময়ের মধ্যে, পরনে স্যুট, একদম অফিসিয়াল পোশাক। ওনার ব্যক্তিত্ব এমনই ছিলো হইচই এক মুহুর্তে থেমে গেলো, সুঁচ পড়লেও শব্দ হবে। অল্পক্ষণের মধ্যে অন্যান্য অধ্যাপকদের কাছে সব শুনে ডেকে পাঠালেন সেই মার খাওয়া সিনিয়ারকে। শনাক্ত করতে বললেন যারা ওকে মারতে গিয়েছিলো। সে এসে চিনিয়ে দিলো সর্ব্বজিত, সৈকত, চয়ন পান্ডা, গাম্বো আর অভিকে। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য অন্য অনেকে যেমন গোকুল, ঋতায়ন এরা মারামারির সময় সামনে ছিলো; আর সর্ব্ব, অভি এরা মারধর না করলেও দলে ছিলো আর পিছন থেকে হুমকি দিয়েছিলো। কিন্তূ গোলেমালে যা হয়, চেহারা একটু ভালো বা লম্বা হলে, তারাই বেশী নজরে পড়ে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। বিমল সেন কালবিলম্ব না করে শনাক্ত করা পাঁচজনকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে সাস্পেণ্ড করে ফিরে গেলেন। কয়েকঘন্টা ধরে চলা ঝামেলাটা মিনিট দশেকের মধ্যেই শেষ।
যেহুতু ক্লাস করার ও হোস্টেলে থাকার অনুমতি নেই, তাই সাস্পেণ্ড হওয়া পাঁচজন ভোরের আলো ফুটতেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। পরে জেনেছিলাম ওদের কেউ বাড়ি যায়নি, ব্যান্ডেলের দিকে কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলো। কয়েকদিন পরে তারা ক্লাসে না গেলেও গুটিগুটি এসে হাজির হলো হোস্টেলে। দুয়েকদিন পর ধুত্তেরিকা বলে হাজিরা না দিয়ে ওরা ক্লাস করতেও শুরু করে দিলো। এর মধ্যে কিছু প্রভাবশালী অধ্যাপকের মধ্যস্থতায় দিন দশেক পরে ডঃ বিমল সেন একটা মুচলেকা নিয়ে সেই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিলেন।
তবে যা জানা গিয়েছিলো যে, সব মিটে যাবার পর বরখাস্তের চিঠি গিয়ে পৌছায় ওদের বাড়িতে। সে এক খোরাক, বাড়ির লোক এসে জানতে পারলো ব্যাপারটা কিছুই নয় আর কবেই মিটে গেছে। একজনের বাবা নাকি চিঠি পেয়ে কলেজে এলে পিকসা তাকে নালিশ জানান, 'শুনেছেন আপনার ছেলে কিসব গণ্ডগোল করেছে। একটু বোঝান যাতে এসব আর না করে'। পিকসা, প্রোঃ পি কে রায়কে অবাক করে সেই ভদ্রলোক উত্তরে বলেছিলেন, 'দেখুন আমার কাছে তো আঠারো বছর ছিলো, তখন তো এসব কিছু করেনি। এখন তো আপনারাই ওর অভিভাবক, তাই এসবের দায়টাও আপনাদেরই আর বোঝানোর ভারও আপনাদের'।
……………………….
কলেজের নিয়ম মেনে সব হোস্টেলে প্রতি মাসে একজন করে মেস ম্যানেজার হতো। হোস্টেল নয়ে এসে এক মাসে আমি প্রথমবার মেস ম্যানেজার হই। মেস ম্যানেজারদের যেমন মেনু ঠিক করার অধিকার থাকতো, তেমনি মেনু খারাপ হলে বাকিদের গালাগালিও শুনতে হতো। এছাড়া পালা করে মেস ডিউটি পড়তো, বড়ঠাকুরের হিসেবমতো ফর্দ মিলিয়ে ভাঁড়ার থেকে জিনিসপত্র বার করে দেওয়ার। পালা করে হতো নিরামিষ, ডিম, মাছ আর মাঝে মাঝে মাংস। সাধারনতঃ মেস ফি কম রাখার জন্যে সাধারণ দিনে মুরগি করার চেষ্টা হতো আর খরচ কম বলে রবিবার দুপুরে খাসির মাংস। তখন তো আর এতো চিকেনের স্টল ছিলো না, সেকেন্ড গেট দিয়ে বি গার্ডেনের দিকে যেতে গেলে খাঁচা নিয়ে বসতো বাপী, আমাদের কাছে বাপী মুরগি। মাসের শুরুতেই মেস ম্যানেজারদের কাছে এসে কথা বলে যেতো। যেহেতু মেস সেকশন থেকে বিল মেটাতে বেশ খানিকটা দেরী হতো তাই মাসের শেষ পর্যন্ত্য অপেক্ষা না করে মেস ম্যানেজাররা যদি একটু উদ্যোগী হয়ে হোস্টেল সুপারকে দিয়ে বাপীর বিলগুলো আগেই পাশ করিয়ে দেয়। তার বদলে বাপীর প্রস্তাব ছিলো বিল প্রতি পঞ্চাশ টাকা করে নজরানা। মানে মাসে আটবার মুরগির মাংস হলে চারশ টাকা।
আমি পত্রপাঠ বাপীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তূ অন্য মেস ম্যানেজাররা বোঝায় যে এটাই সিস্টেম। না হলে বাপির পক্ষেও উচিতমূল্যে চিকেন যোগান দেওয়া মুশকিল। আমি প্রস্তাব দিলাম, তাহলে আমাকে না দিয়ে বাপি যেন বিলে ওই টাকাটা ছাড় দেয়। বাপী রাজি হয়ে গেলেও, অন্য মেস ম্যানেজাররা আমাকে বলে যে, মুরগির দামের হঠাৎ কমবেশী হলে সবার সন্দেহ হবে আর সব সিস্টেম উল্টোপাল্টা হয়ে যাবে। তবু হাত পেতে টাকা নিতে একটা অস্বস্তি ছিলো। একদিন আমি সেকেন্ড গেটের সামনে ষ্টুডিও ক্যামেলিয়াতে গেছি একটা হটশট ক্যামেরা কেনার উদ্দেশ্যে, দাম তখন তিনশ টাকা। হাতখরচ জমিয়ে আমার হাতে মাত্র দুশ। তাই নেওয়া গেলো না। সেদিন মেসে চিকেন ছিলো। বাপী মুরগী সাইকেল করে আসতে আসতে আমাদের দেখে দাড়িয়ে গিয়েছিলো, কারণ আমরা না ফিরলে মাংসের ওজন হবে না। সেটা ছিলো মাসের প্রায় শেষ। মাংসের ওজন হয়ে যাবার পরে বাপী ওর সঙ্গে ডেকে নিয়ে গেলো। ষ্টুডিও ক্যামেলিয়াতে গিয়ে আমার পছন্দের ক্যামেরাটা দেখিয়ে বলেছিলো, 'দাদাভাই তুমি তো টাকা নেবে না, তাই এই ক্যামেরাটা নাও আমার উপহার হিসেবে'। দোনামনার সাথে একটু যুক্তিতর্কের পর নিয়েও নিয়েছিলাম। একটা শখ পূর্ণ হবার আনন্দের সঙ্গে, পরে খারাপ লেগেছিলো এই ভেবে যে সিস্টেমের সঙ্গে আপস করে ঘুরপথে সেটাও ছিলো একধরনের ঘুষ।
………………..
আর একটা জিনিস এখানে কবুল করে নিচ্ছি, আমার রুমমেট সমিত ছিলো অন্য একটা মাসের মেস ম্যানেজার। কানপুর থেকে মাস্টার ডিগ্রী আর ক্যালিফর্নিয়া থেকে ডক্টরেট করে এখন আই আই টি কানপুরের অধ্যাপক। কোনো কারণে তখন কয়েকদিন ওর সাথে আমার আর সন্দীপের একটা ঠান্ডা লড়াই চলছিলো। একদিন মেসের ভাঁড়ার থেকে মালপত্র বার করে এসে সমিত মেসের চাবিটা বিছানার উপড় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো। আমরাও ঠিক করলাম ভুলোমনার একটু শিক্ষা দেওয়া যাক। চাবিটা ওরই বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখে দিলাম, ঠিক করলাম যখন খোঁজাখুঁজি করবে তখন একটু জ্ঞান দিয়ে ফেরত দেব। পরদিন দেখলাম ওকে আবার চাবি নিয়ে ফিরতে, তার মানে হয়তো ও নিজেই চাবিটা খুঁজে পেয়ে গেছে ভেবে আর মাথা ঘামাইনি।
কদিন পরে একটা লম্বা ছুটিতে বাড়ি যাবার আগে বিছানাটা গুটিয়ে রাখছি। সন্দীপ, সমিত আগেই বাড়ি চলে গেছে। হঠাৎ আমার আর সমিতের খাটের ফাঁক থেকে দেখলাম উঁকি মারছে সেই চাবির গোছাটা। বড়ঠাকুরের কাছে জানলাম সেদিন আমরা বিকেলের টিফিন করতে কোলে মার্কেট চলে যাবার পর, হঠাৎ দরকার পরে ভাঁড়ার থেকে কিছু বার করার। চারদিক খুঁজেও চাবি পাওয়া যায় নি। শেষে তালা ভেঙ্গে নতুন চাবির গোছা তৈরী হয়। সব শুনে আরও ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্যে অদরকারী চাবির গোছাটা বাড়ি যাবার পথে একটানে পাশের একটা ঝোপে ফেলে চলে যাই।
…………………..
আগেই বলেছি আমাদের ফ্লোরেই হোস্টেল পনেরো থেকে আসার দলে ছিলো মেকানিকালের কল্যাণ গাঁতাইত মানে পাখি। খুব সুন্দর পোট্রেট করতো। যে কাউকে সামনে বসিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যে তার মুখের ছবি পেন্সিল দিয়ে ফুটিয়ে তুলতো। মনে আছে বইমেলায় গিয়ে অনেকের ছবি এঁকে দিয়ে প্রশংসা পেয়েছিলো। যাদের ছবি এঁকেছিলো, তাদের মধ্যে ছিলেন নারায়ণ সান্যাল, সুনীল গাঙ্গুলি প্রমুখ। এছাড়া একজন প্রতিভাবান ছিলো মেটালার্জির, যার অদ্ভুত দক্ষতা ছিলো বইমেলায় গিয়ে বই সরানোর। সেকেন্ড ইয়ার থেকে নিজের প্রতি আস্থা এতই বেড়ে যায় যে, রীতিমতো লোকজনের কাছ থেকে চাহিদার তালিকা নিয়ে যেত এবং যত বড়ই হোকনা কেনো সেই বই এনে হাজির করতো। এই দুঃসাহসিক কাজের মূল্য ছিলো বইয়ের দামের অর্ধেক মূল্য।
…………………
হোস্টেল নয়ের শেষদিকে আর একবার যেতে হয় পি জি হসপিটালে। এক শনি বা রবিবারে হঠাৎ আমাদের বড়ঠাকুরের একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি মেসস্টাফ সুনীলদা বড়ঠাকুরের রক্তে ভিজে যাওয়া ধুতিটাকে সামলে, তার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি ডেকে আমরা কয়েকজন বড়ঠাকুরকে নিয়ে যাই পিজিতে। কাকতালীয়ভাবে সেদিন ডিউটিতে ছিলেন সেই অল্পবয়সী ডাক্তারবাবু, যিনি আগের পর্বে বলা সেই পথ দুর্ঘটনায় পড়া ছেলেটির চিকিৎসা করেছিলেন। আমাদের দেখেই চিনতে পারেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা করেন বড়ঠাকুরের। বলাই বাহুল্য বড়ঠাকুর তিন-চার দিন পরেই সুস্থ হয়ে ফিরে আসে আর কয়েকদিন পর থেকেই নিজের ডিউটিতে যোগ দেয়।
…………………..
দ্বিতীয় বছরের শেষে অনেকেই তৃতীয় বছরের জন্যে হলে চলে যায়, একশয্যার ঘরে পড়াশোনা ভালো হবে বলে। তবে হলগুলোতে মেস ফি একটু বেশী পড়তো। হোস্টেলজীবন উপভোগ করবো বলে ঠিক করি হোস্টেলেই আর এক বছর থেকে যাবো। কিন্তূ হা কপাল, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ জারী হলো সাত, আট ও নয় খালি করে দিতে হবে; কারণ আমাদের পরের ব্যাচ মানে, সদ্য সেকেন্ড ইয়ার যারা তাদের জন্য। এবারে আর প্রতিবাদ করিনি। সন্দীপ আর সমিত চলে যায় ম্যাকডোনাল্ড হলে। আমি বর্ধমানের ছেলে আমাদের ব্যাচের ইলেকট্রিকালের সৌমিকের সাথে চলে যাই হোস্টেল দশে। নতুন বছর, নতুন রুমমেট, নতুন হোস্টেল, তিন বছরে তিনবার।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.