Tuesday, May 21, 2013

খাপছাড়া

খাপছাড়া

 

সেদিন বেহালা চৌরাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, দেখি সাদা দাড়িওয়ালা এক বুড়ো দুই কান চেপে ধরে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে। বেশ চেনা চেনা লাগলো, কিন্তূ চট করে মনে এলোনা। প্রথমে ভাবলাম রামগরুড়ের ছানা; তারপর ভাবলাম কোনো বুদ্ধিজীবী, কিন্তূ তাহলে কই মাথায় টাক নেই তো! এমনকি আশে পাশে দু চারটে স্তাবকের দলও নেই। তাহলে কি কোনো সন্ত্রাসবাদী। নাহ তাও তো নয়, কাধে বন্দুক বা ঝোলাও নেই তো! এমনকি চোখে তো কালো চশমাও নেই।

 

ওহো এইবার মনে পড়েছে এতো আমাদের রবিঠাকুর। কপিরাইট উঠে গেছে বলে বিশ্বভারতীর অনুমতি ছাড়াই যেখানে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে ঢুকে পড়ছে। বাস রিক্সার মাঝ দিয়ে এদিক ওদিক না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পেরোতে দেখে ডাক দিলাম,

 

- দাদু, রবিঠাকুর, একটু দাড়ান। 

 

দাদু কি একটা বিড়বিড় করছিলেন। দাঁড়িয়ে গিয়ে স্মিত হেসে বললেন, যা তুই আমাকে দেখতে পেয়ে গেলি। এখনো তোরা আমায় মনে রেখেছিস?

 

- কেনো গো ঠাকুর তোমাকে তো আমরা সবসময় মনে রাখি। তোমার গান শুনি, তোমার ছবিতে মালা দি। এখনকার সিনেমা আর সিরিয়ালে তোমার কবিতা, গান কতো জনপ্রিয় জানো। তোমার জন্মদিনে সরকারী অফিস সব ছুটি থাকে।

 

- থাক, থাক অনেক হয়েছে। তোদের সরকারী অফিস খোলা থাকলেই কি আর বন্ধ থাকলেই কি। কাজ তো হয় না। আর ছুটিটা সোমবার বা শুক্রুবার হলে তো কথাই নেই। ছেলেবউকে নিয়ে মন্দারমনি বা দার্জিলিং গিয়ে, সন্ধ্যেবেলায় একটু ভাজাভুজি আর হাতে গেলাস নিয়ে তোরা যা রবীন্দ্রজয়ন্তী করিস তা কি দেখতে পাই না! আর আমার গান আর কবিতা গুঁজে না দিলে সিরিয়ালগুলো চারশ ছাপান্ন পর্ব চলবে কি করে শুনি। যাদের নিজেদের মুরোদ নেই একটা নতুন গান লেখার, বাংলা ভাষাটাও ভালো করে বলতে পারেনা বা বাংলার বাইরে থেকে উড়ে এসে বাংলা ছায়াছবি করছে তারাতো বলবেই 'দেখিয়ে তো, রবিন্দর নাথকা কোন সা গানা ইধার ফিট হোগা' ব্যাস এমনি সেই সুরকার একটা আমার পূজার গান প্রেমের সিনে জুড়ে দিলো। আর তোরা টিসু পেপারে চোখ মুছতে মুছতে দেখলি। তারপর আবার মূল সুরের সাথে প্র-সুর আর উপ-সুর লাগিয়ে এমন বেসুরো করে দেয় যে কানে হাত চাপা দিতে হয়। সবাই নিজেকে ভাবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী বা হেমন্ত মুখার্জী। সবাই নাকি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। বলি এটা হচ্ছেটা কি! না নতুন গান, না নতুন সুর, শুধু আমার গান আর সুর গুলোর পিন্ডি চটকাচ্ছিস।

 

আমি বললাম, কিন্তূ ঠাকুর আমরা তো সাধারন মানুষ, আমরা তো আর প্রযোজক বা সুরকার নই। এটা ঠিক অনেকে এগুলো করে, কিন্তূ ওদের টাকা পাবলিক বললে শুনবে কেনো?

 

- তোরা সাধারন মানুষগুলো একবারে ভণ্ড! ওরাই তো বলে, 'এসব করলে পাবলিক হেব্বি খাবে' তোরা খাস তাই ওরা বানায়। আর নিজের টাকা কিরে? তোরাই তো দুবছরে পাঁচগুন হবে বলে রামকৃষ্ণ না সারদা কোথায় সব টাকা রাখিস। আর তোদের ভোটে জিতে আসা নেতা মন্ত্রীরা, তোদের আয়করের পয়সায় রাখা সরকারী পেয়াদারা লুটেপুটে খেয়ে কিছু টাকা এসব জায়গায় খাটায়। ওরা খাওয়ালে দোষ, আর তোরা খেলে দোষ নেই? ফালতু ফালতু পিছু দেকে খানিকটা সময় নষ্ট করে দিলি হতভাগা।

 

- না ঠাকুর আমি দেখলাম আপনি আপন মনে কিসব বিড়বিড় করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছেন। তাই একটু সাবধান করে দেবার জন্য ডাকলাম, যাতে না গাড়ী চাপা পড়ে যান।

 

- থাক অনেক করেছিস। তোরা তো আমাকে কবেই চাপা দিয়ে দিয়েছিস। 'ক্ষুদিত পাষান' তো পড়িসনি, ফেসবুক আর টিভি দেখার পর তোদের সময় কোথায়! জানিসনা মরা মানুষ কে চাপা দেওয়া যায় না। মাঝে মাঝে একটু গণ্ডগোল না হোলে, তোদের আর আমাদের জগত তো পুরো আলাদা। আরে যারা বেঁচে আছে তারাই তো চাপা পড়বে। ট্রাফিক সিগনালে আমার গান চালিয়ে কি হয়। কে শোনে, পাবলিক না গাড়ির চালক না ট্রাফিক পুলিশ। কিসব তোদের সংস্কৃতি। সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত, শুনলে চাপা পড়বেই। শুনতে হয় পার্কে লাগা, ট্রেনের মধ্যে লাগা, বাসে লাগা; তা নয় ট্রাফিক সিগনালে। উফ ফাটা চোঙার কি আওয়াজ! তাইতো আমি নিজেই কানে চাপা দিয়ে পালাচ্ছি।

 

- কিন্তূ ঠাকুর আপনি এমন বিড়বিড় করছিলেন কেনো?

 

- কি করবো একবার বললাম 'দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর', কেউ চুপ করলো না। হঠাৎ দেখি একটা অটো ধা করে দুটো বাসের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে এসে অদ্ভুত কায়দায় পূব থেকে ঈশান কোনের দিকে মুখ করে লাল সিগনালের পরোয়া না করে তেড়ে এলো। একটা পেয়াদা হাত তুলে বললো 'দিব না দিব না যেতে' কিন্তূ কে শোনে কার কথা, 'হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়' শুনিলাম 'চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে' পেয়াদাকে আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি, 'বুঝেছি, সব বুঝেছি; তুমি অমন ব্যাকুল হোয়ো না।' কিছু ক্ষণের জন্যে সব শান্ত হয়ে যায়। আবার দেখি মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে একটা চারচাকার গাড়ি এলে সেই পেয়াদা ভারি ব্যস্ত হয়ে ওঠে; আবার সেই থর্থর্ঝর্ঝর্ঝল্মল্ তখন কতো তার হাঁকডাক, কতো তার লম্ফঝম্প। দোষ নেই তবু একশ বা নিদেনপক্ষে দশ টাকা দণ্ড পকেটে না ভরে সে শান্ত হবে না।

 

- তবে ঠাকুর আমরা কিন্তূ গতবছর আপনার সার্ধশতবর্ষ পালন করেছি

 

আমি কথা শেষ করার আগেই জবাব এলো -  তোরা সার্ধশতবর্ষ করেছিস না, শ্রাদ্ধশতবর্ষ করেছিস জানিনে। আমার নোবেলটাকে সরকারী হেফাজতে নিয়ে ওটার পিণ্ডি চটকে দিলি তারপর ঘটা করে জনগনের কাছ থেকে কর আদায় করা সরকারী টাকার শ্রাদ্ধ না সার্ধ করলি। ব্যাস হয়ে গেলো।

 

- আপনার গানকে জাতীয় সঙ্গীত করেছি।

 

- সে যা বিজাতীয় জিনিস দাঁড়িয়েছে দেখে মনে হয় কেনো লিখলাম। আর জাতীয় সঙ্গীতের তো মানেই বুঝিস না। জনগণ গাইছে কজন আর বাকিরা চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। দুয়েকজন যদি মনে করিয়ে দেন উঠে দাঁড়ানোর কথা, তারা তেড়ে বলে ওঠে, একবার উঠলে চেয়ার হাতছাড়া হয়ে যাবে। এতো উদ্যোগ নিয়ে বঙ্গভঙ্গ আটকে দিলাম আর তোরা কিনা দেশটাকে তিন টুকরো করে দিলি।

 

আমি দেখলাম দাদু খেপে আছে, তাও আজ আবার ২৫শে বৈশাখ, তাই ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। তবু মিনমিন করে বললাম, কিন্তূ আপনি উত্তরের জোড়াসাঁকো ছেড়ে এই দক্ষিনে।

 

- তার কি আর উপায় আছে রে। সেখানে একদল সকাল থেকেই দখল করেছে। কয়েকজন বাদ দিলে অনেকেরই আজকের দিনটাতেই নাকি আমার কথা মনে পড়ে। গাদাগাদি ভিড়ে ভক্তিতে গদগদ। মধ্যকলকাতায় আসবো দেখি রবীন্দ্রসদনের সামনে গন্যমান্য ব্যাক্তিরা আমার কিসব করবে। রাস্তা জুড়ে বিশাল ম্যারাপ বাঁধা। সেপাই-পুলিশ থিকথিক করছে, এগুতে গেলাম আমার পরিচয়পত্র দেখতে চাইলো। আমার নামের জায়গায়, আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে, আমাকে ঢুকতে দেবার ছাড়পত্র চাইলো? দেখাতে পারলাম না, আমাকে আমারই লেখা লাইন চুরি করে বললো 'যেতে নাহি দিব'

 

আরো কিছু কথা বাকি ছিলো, কিন্তূ হঠাৎ বিকেলের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো পাশের মাঠ থেকে মাইকে ভেসে আসা একটা ঘোষনায়, "উই আর গোয়িং স্টার্ট আওয়ার ফান ফিলড কালচারাল ইভনিং টু সেলিব্রেট টোয়েন্টি ফিফথ বৈশাখ। অল আর রিকোয়েস্টেড টু কাম এন্ড জয়েন আস। আফটার আ শর্ট ফিউসন বাই আওয়ার চিলড্রেন, উই উইল প্রেসেন্ট মিস মোমো উইথ বেঙ্গলি ব্যান্ড ডিফেন্ডার। এন্ড দা লাস্ট এট্রাকশন উইল মিউজিকাল এক্সট্রাভাগাঞ্জা বাই ডিজে ম্যাস।"

 

একটা স্বপ্নের অকাল মৃত্যু।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.