Thursday, November 14, 2013

৫. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: বঙ্গে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী


৫. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: বঙ্গে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী

পঞ্চদশ শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপিলাই মনসামঙ্গলে লিখে গেছেন 'গঙ্গা আর সরস্বতী/ যমুনা বিশাল অতি/ অধিষ্ঠান উমা মহেশ্বরী।' ১৬৬০ সালে ভূতাত্ত্বিক ভ্যান ডি ব্রুক ভারতের, বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশের অনেকগুলি নকশা এঁকে গেছেন। কালের স্রোতে তার থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্নসুত্র থেকে একদম শুরুর কথা যা পাওয়া যায় তা হোল জুরাসিক যুগে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে যখন গণ্ডয়ানা অনেকগুলো টুকরোয় ভেঙ্গে যায়, তখন সৃষ্টি হয় গঙ্গা ও ব্ৰহ্মপুত্ৰের। ধীরে ধীরে পলি জমে সৃষ্টি হয় অন্তর্বর্তী বদ্বীপের এবং আরও পরে গঠন হয় বঙ্গোপসাগরের তটরেখার। পৌরাণিক মতে গঙ্গা নদী নয় একটি খাল। এটির খনন করেছিলেন কোশালার (অধুনা উত্তরপ্রদেশের অবধ) সাগর রাজার ছেলে ভগীরথ। এই বিতর্কের মধ্যে এখন না গিয়ে দেখে নেওয়া যাক গত পাঁচশ বছরে এই গুরুত্বপূর্ণ নদী ও তার শাখানদীগুলির আদি পথ এবং পরবর্তী গতি পরিবর্তন।  

হুগলী জেলার সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তগ্রাম ছিল একটি প্রধান নদীবন্দর, প্রধান শহর এবং প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় সময়ে কখনও কখনও দক্ষিণ বাংলার রাজধানী। ত্রিবেণী হোল গঙ্গা ও তার দুই প্রধান শাখানদী যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থল। ষোড়শ শতকেও ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিক ধরে সপ্তগ্রাম হয়ে বয়ে চলত সরস্বতী নদী। যমুনা বইত দক্ষিণ পূর্ব দিক ধরে। আর মূলধারা ভাগীরথী বা হুগলী নাম নিয়ে বইত মাঝামাঝি। খোঁজ করলে ত্রিবেণী (Tribeni) নামটিকে অনেকগুলি জায়গায় পাওয়া যাবে। যেমন নেপালে দুটি ত্রিবেণী (Tribeni) আছে একটি ধবলগিরি অঞ্চলে পারবাত জেলায়, অন্যটি রাপ্তি অঞ্চলে সাল্যান জেলায়। ভারতেও দুটি ত্রিবেণী আছে একটি এই হুগলীর, অন্যটি ঘটনাচক্রে এলাহাবাদের কাছে গঙ্গা ও উত্তর ভারতের যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলের নামও ত্রিবেণী (Triveni) সঙ্গম।

সপ্তগ্রাম তৈরী সাতখানি গ্রাম নিয়ে বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বাচোরা ও বলদঘাটি। সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী ঘিরে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। কন্নৌজের রাজা প্রিয়বান্তার সাত পুত্র ছিল অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বাপুষ্মান, জ্যোতিষ্মান, দ্যুতিষ্মান, সবান এবং ভাব্য। এঁরা রাজকীয় জীবনযাত্রা ও ভোগবিলাসে বিরক্ত হয়ে বেড়িয়ে পরেন এক নতুন জায়গার খোঁজে যেখানে ওঁরা ধ্যানযোগ করতে পারেন। ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে এসে জায়গাটি এতো পছন্দ হয়ে যায় যে তপস্বীর জীবনযাপন করার জন্যে তাঁরা সাতখানি গ্রাম স্থাপন করেন। এই সপ্তগ্রামের অবস্থান বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার মুখ্য শহর ও রেল জংশন ব্যান্ডেল থেকে মাত্র ৪ কিমি দুরত্বে। যদিও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ভারতে রেল বিপ্লব ঘটেনি তখন এখানে কয়েকটি মাত্র কুঁড়ে ঘর ছিল। কারণ এটি যে সরস্বতী নদীর তীরবর্তী বন্দর ছিল সেই নদীটির কালের গর্ভে মজে যাওয়া এবং জব চার্নকের হাত ধরে কলকাতা বন্দরের শ্রীবৃদ্ধি।

সরস্বতীর (Saraswati) প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মনসামঙ্গল কাব্যে সংস্কৃত আর বাংলা বানান এক হলেও এটি ঋগবেদে উল্লিখিত উত্তর ভারতের সরস্বতী (Sarasvati) নদী নয়। মনসামঙ্গল প্রথম লিখেছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কানা হরিদত্ত যেটি খুঁজে পাওয়া যায় নি। এরপরে ১৪৮৪-৮৫ সালে নতুনকরে মনসামঙ্গল লেখেন বিজয়গুপ্ত ও পুরুষোত্তম নাম দেন পদ্মপুরান। একই নামে পরে এটি লেখেন নারায়নদেব। ১৪৯৫-৯৬ সালে বিপ্রদাস পিপিলাই লেখেন মনসাবিজয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে আরও কিছু কবি মনসামঙ্গল রচনা করেছিলেন যেমন কেতকাদাস ক্ষমানন্দ, জগজীবন ঘোষাল, জীবনকৃষ্ণ মিত্র প্রমুখ।

মনসামঙ্গল অনুসারে চাঁদ সওদাগর ছিলেন অধুনা আসামের কামরূপ জেলার ছয়গাও তথা তৎকালীন চম্পক নগরের প্রভাবশালী বণিক। ছয়গাও (ছয়গাঁ) ও সপ্তগ্রাম (সাতগাঁ)-এর মাঝামাঝি ব্ৰহ্মপুত্ৰের তীরবর্তী জনপদ ছিল অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বগুড়া যেখানে বেহুলা ও লখিন্দরের লোহার বাসরের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই রচনাটি মনসামঙ্গলের উপর নয় কিন্তু তথ্যগুলি উল্ল্যেখ করা হল যাতে তখন নদীমাতৃক বঙ্গদেশের বানিজ্য পথগুলির একটা ধারনা করা যায়। পরিশেষে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপোতের সাগরযাত্রার পথটি ছিল সপ্তগ্রাম থেকে উজানে ত্রিবেণী সঙ্গম। সেখান থেকে চিৎপুর সালকিয়া - বেতড় (অধুনা শিবপুর ব্যাতাইতলা, যা গার্ডেনরিচের ঠিক উল্টোদিকে) কালিঘাট চুরাঘাট বারুইপুর ছাত্রভোগ  - বদ্রিকুণ্ড হাথিয়াগড় চৌমুখী শতমুখী সাগর সঙ্গম (অধুনা বোড়াল, নরেন্দ্রপুর, কোদালিয়া, মহিনগর, জয়নগর, লক্ষ্মীকান্তপুর, নামখানা)।

পাঠককে অনুরোধ করবো তৎকালীন ভাগীরথী বরাবর যাত্রাপথটি খেয়াল করতে। তখন গঙ্গা বা ভগীরথীর অভিমুখ ছিল বেতড় থেকে কালীঘাটের দিকে। এখন যেটি শিবপুর থেকে সাঁকরাইল, বজবজ, উলুবেড়িয়া, ফলতা, নুরপুর (রূপনারায়নের সঙ্গম), ডায়মন্ড হারবার, কুলপি, হলদিয়া, নয়াচর, কাকদ্বীপ হয়ে সাগরে গিয়ে পড়েছে। সরস্বতী নদী ত্রিবেণী থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমদিকে ভাগীরথীর সমান্তরাল ভাবে বইত আন্দুল - সাঁকরাইল হয়ে অধুনা গঙ্গার পথ মানে বজবজ, উলুবেড়িয়া হয়ে। দ্বাদশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিমে আন্দুল থেকে বেতড় এসে সরস্বতী একটি লুপ তৈরী করে আবার দক্ষিণপূর্ব দিকে বইত। বিশ্বাস করা হয় সরস্বতী অধুনা রূপনারায়নের খাত বরাবর বয়ে মোহনায় পড়ত তাম্রলিপ্ত (অধুনা তমলুক) হয়ে। তখন সরস্বতীর উপনদী ছিল রূপনারায়ন, দামোদরসহ অনেক ছোট নদনদী। বলাই বাহুল্য তাম্রলিপ্ত আগে একটি সমৃদ্ধ সমুদ্রবন্দর ছিল। সরস্বতীর একটি মজে যাওয়া শাখা আন্দুলে প্রভু জগৎবন্ধু কলেজের ডানপাশ হয়ে এখনও বইছে। 

সপ্তম শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে সরস্বতীর উৎপত্তিস্থলে পলি জমতে শুরু করে এবং ধীরেধীরে ষোড়শ শতক নাগাদ সরস্বতী প্রায় শুকিয়ে যায়। এরফলে সরস্বতীর জল ভাগীরথী হয়ে সাঁকরাইল থেকে সরস্বতীর নিম্নভাগ দিয়ে বইতে শুরু করে। অনেকে মনে করেন সরস্বতীর উপড়ভাগ শুকিয়ে যাবার ফলে নবাব আলীবর্দি খাঁ কৃত্রিমভাবে বেতড় থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত্য জুড়ে দেন যাতে বনিকদের নৌবহরগুলি সহজে সাগরে যেতে পারে। অর্থাৎ অধুনা গঙ্গা বেতড় পর্যন্ত্য ভাগীরথীর এবং জুড়ে দেওয়া অংশ ধরে সাঁকরাইল থেকে সরস্বতীর খাত ধরে বইছে। এর ফলে ভাগীরথীর আদি পরিত্যক্ত ধারাটিও শুকিয়ে যায় যেটি আমরা আদিগঙ্গা বলে জানি। অন্যমতে সরস্বতী থেকে আদিগঙ্গার মধ্যে একটি জোয়ারের খাড়ি ছিল। ওলন্দাজ নাবিকরা সাগর অভিমুখী বানিজ্যতরী যাতায়াতের জন্যে এই অংশটি গভীর করে খনন করে।

অষ্টাদশ শতকের শুরুতে আদিগঙ্গা গোবিন্দপুর খাড়ি বলে পরিচিত ছিল যা ছিল গোবিন্দপুর গ্রামের দক্ষিণ সীমানা। ১৭২০-র দশকে এডওয়ার্ড স্যুরমান এটির সংস্কার করেন। তাই কিছুদিন আদিগঙ্গার নাম হয় স্যুরমান নালা। ১৭৭৩ সালে উইলিয়াম টলি এটি আরও গভীর করেন ও সার্কুলার ক্যানালের সাথে জুড়ে দেন - নতুন নাম হয় টলি নালা। ১৭৭৫ সালে টলি এটিকে বিদ্যাধরী নদীর সাথে জুড়ে দেন। এটি তখন নাব্য থাকলেও ক্রমাগত অবহেলা ও শহরান্নোয়নের কুফল হিসেবে আস্তে আস্তে মজে যায় এবং একটি নিকাশিনালার চেহারা নেয়। গার্ডেনরিচ থেকে খিদিরপুর হয়ে আলিপুর চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে কালীঘাট, সিরিটি, টলিগঞ্জ, আজাদগড়, রাণীকুঠি, নেতাজীনগর, বাঁশদ্রোণী, রথতলা (অধুনা বৈষ্ণবঘাটা), গড়িয়া, বোড়াল, মহামায়াতলা, নরেন্দ্রপুর, রাজপুর, হরিনাভি, কোদালিয়া, চাঙ্গারিপোতা (অধুনা সুভাষগ্রাম), অতিসারা গ্রাম (অধুনা মহিনগর ও বারুইপুর), জয়নগর ও মজিলপুর হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। কলকাতা মেট্রোর সম্প্রসারণ হবার সময় টলিগঞ্জ থেকে গড়িয়া অংশ আদিগঙ্গার উপর দিয়ে গেছে। আদিগঙ্গার সংস্কারের অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরিবেশবিদদের মতে মেট্রোর সম্প্রসারণ আদিগঙ্গার শেষ ত্বরান্বিত করবে।

পরিশেষে আসা যাক যমুনার (Jamuna) কথায়। বলাই বাহুল্য এটি উত্তর ভারতের যমুনা (Yamuna) বা বাংলাদেশে একই নামে অন্যান্য নদীর থেকে আলদা। শুরুতে ত্রিবেণী থেকে গঙ্গার অন্যতম শাখানদী হিসেবে যমুনা বইত দক্ষিণ পূর্ব দিক ধরে। যদিও সময়ের সঙ্গে হুগলী নদীর সাথে যমুনার যোগসূত্রটি শুকিয়ে গিয়ে এটি এখন একটি স্বতন্ত্র নদী হিসেবে পরিচিত যার উৎপত্তি নদীয়া জেলার দক্ষিনে হরিণঘাটা মাদার ডেয়ারি কেন্দ্র এবং সঙ্গম উত্তর চব্বিশ পরগনার চারঘাটের কাছে বাংলাদেশের অন্যতম নদী ইছামতি। মুলনদীটি ত্রিবেণীর গঙ্গা থেকে উৎপন্ন হয়ে অধুনা উৎপত্তি হরিণঘাটা থেকে আঁকাবাঁকা পথ ও অনেকগুলি তীক্ষ্ণ মোড় ঘুরে নাগারুখ্রা, গাইঘাটা, গোবরডাঙ্গা, মছলন্দপুর হয়ে চারঘাটে ইছামতিতে পড়ত। এই নদীর তীরে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে যেমন ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশান অ্যান্ড রিসার্চ, গাইঘাটা শ্মশান, গোবরডাঙ্গা গ্রামীণ হাসপাতাল, গোবরডাঙ্গা শিশু হাসপাতাল, গোবরডাঙ্গা রাজবাড়ী ইত্যাদি।

গুরুত্বপূর্ণ নদী হলেও এখন আদিগঙ্গার মতো যমুনাও প্রচণ্ড দূষিত একটি নদী। সময়ের সাথে দিক পরিবর্তন করায় যমুনার অনেকগুলি অশ্মক্ষুরাকৃতি হ্রদ তৈরী হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোল গোবরডাঙ্গার কঙ্কনা ঝিল। কঙ্কনা ঝিলকে বেষ্টন করে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান যেমন গোবরডাঙ্গা জমিদার বাড়ী, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, বিখ্যাত চণ্ডীমন্দির যেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে প্রথম বিধবা বিবাহ হয়েছিলো। এছাড়াও এটি মৎস্যশিকার ও নৌকাবিহারের সুবিধাযুক্ত সর্ষেখেত ও নারিকেল বাগানে ঘেরা একটি সম্ভবনাময় শস্যশ্যামলা পর্যটনকেন্দ্র। এই নদীগুলির সংস্কার ও পর্যটনের প্রসারের জন্যে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি দরকার জনসচেতনতা।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.