Wednesday, November 20, 2013

বাবার ফেসবুক

বাবার ফেসবুক
=======
 
এটা "লেখালেখি" এবং "Jokes কৌতুক" গ্রুপ নিয়ে একটা লেখালেখি। আমার বাবা পশ্চিমবঙ্গ অর্থ দপ্তরের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী - দপ্তরের নাম রেজিস্ট্রেশান বা নিবন্ধিকরণ। বাবা ছিলেন অবরনিবন্ধক - মুল কাজ জমিজমা কেনাবেচা থেকে বিবাহ নথিভুক্ত করা। সাব রেজিস্ট্রোর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ডি আই জি হিসেবে অবসর নেন ২০০৮ সালে। বাবার কর্মজীবন নিয়ে এতো কথা বলার কারন - বাবা হলেন সেই ব্যক্তি জার অধীনে পাইলট প্রোজেক্ট হিসেবে প্রথম হুগলীর কিছু রেজিস্ট্রী অফিসের কম্পিউটার সিস্টেম চালু হয়। এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব অফিসেই কম্পিউটারে নথিভুক্তিকরণ হয়।
 
কিন্তু, বাবার নিজের কম্পিউটারের দক্ষতা ছিল অনেকটা আমার ক্রিকেট মাঠের মতো। মানে ঐ যে বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়া, কিভাবে বলটা খেলতে হবে, কেন যে শচিন লুজ বলে আউট হল থেকে কাকে দলে নেওয়া উচিত সব বলে দিতে পারি, কিন্তু ঐ মাঠে নেমে খেলতে বলবেন না, প্লিজ। বাবার হল সেই অবস্থা। পিছনে দাঁড়িয়ে যখন দেখতে বলি সব বুঝে যায়, তারপর ঘুমোতে গিয়ে সব ভুলে যায়। চেষ্টা করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খায় আর আমায় ফোন করে এমন এমন প্রশ্ন করে যে আমি ঘাবড়ে যাই।
 
কয়েক বছর আগে আমার গাব্দামতন কম্পিউটার বিক্রি করে একটা মোটামুটি নতুন কম্পিউটার আর প্রিন্টার কেনা হয়েছিলো, বাবা অবসর নেবার পর কম্পিউটার শিখবেন বলে। একদিন শুনলাম ওয়ার্ডে সেভ করা যাচ্ছে না। আমি বললাম ফাইল মেনুতে গিয়ে সেভ-এ ক্লিক করতে। বাবা ওয়ার্ড বন্ধ করে এক্সপ্লোরার-এর একটা ফাইলে গিয়ে রাইট ক্লিক করে বললেন কোন সেভ অপশন নেই। কম্পিউটার খারাপ হয়ে গেছে। যাইহোক তবু মাঝে কিছুদিন কম্পিউটার রপ্ত করলেন, মানে টুকটাক চিঠিপত্র টাইপ আর প্রিন্ট নেওয়া। মাঝে মাঝে অতি সঞ্চয়ী স্বভাবের জন্যে বেশ কিছুদিন প্রিন্ট না নেওয়ায় প্রিন্টার খারাপ হয়ে যেত। বাবাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন।
 
একপাতা টাইপ করে দুপিস প্রিন্ট নেবার বদলে, ১৫ মিনিট হেঁটে কোন কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে তাদের দিয়ে একটা টাইপ করিয়ে, আবার ১০ মিনিট হেঁটে একটা জেরক্স সেন্টার থেকে এক কপি জেরক্স করে আনা বাবার অনেক সহজ মনে হতো। আস্তে আস্তে কম্পিউটারের উপর ধুলোর আস্তরণ পুরু হতে লাগলো। আমি গেলে কখনো খুলতাম আর আমার মেয়ে বা ভাগ্নি গেলে গেমস খেলত। বাবা কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন, আর আমি বাবাকে কম্পিউটার শেখানোর প্রতি।
 
মনে মনে বাবার ডঙ্গেল লাগিয়ে ইন্টারনেট করার উপর এতো বেশী অনাস্থা ছিল যে ঐ পথেই হাঁটি নি। এবারে পুজোর কিছু আগে দেখলাম পাড়ায় কেবল ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপন পড়েছে। দরদাম করে বাড়ীতে লাগিয়ে ফেললাম। এটা জেনেই যে এরা যা বলে তার অনেকটাই আদপে দেয় না। বাবার একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিলাম আর দু-তিনদিন ধরে ধরেবেঁধে ট্রেনিং দিলাম। মাঝে মাঝে বাবার সব গুলিয়ে যায়, আর আমার মেজাজ হারিয়ে যায়। দূর তোমার হবে না বলে উঠে যাই। মাঝে মাঝে আবার বসি, বাবা বলে দূর এসব হবে না, বরং দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে আমার বেশী আগ্রহ। মা বলেন তোর বাবার ধৈর্য নেই। আমি বলি আমার মেয়েকে শেখালে শিখে যেত এতদিনে।
 
তবু এই ধাক্কা, চেষ্টা আর ইচ্ছে অনিচ্ছের মধ্যে দোলা খেতে খেতে বাবা একটু আধটু শিখে নিলেন কিভাবে ইন্টারনেট আর ফেসবুক খুলতে হবে। কখনো বিকেলে ঘুম থেকে উঠে, কখনো বা সকালে একটু ফাঁক পেলে বসে পড়েন ইন্টারনেট নিয়ে। তাতে আমি মনে মনে রোমাঞ্চিত হতাম এই ভেবে - এই তো হচ্ছে, হবে হবে। আবার মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম। বাবার ফোন - শোন ফেসবুকটা কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি বলি হারায় নি, ঠিক আছে, তুমি ভুল জায়গায় গেছ। বাবা অসহিষ্ণু হয়ে বলেন এইতো কম্পিউটার খুলেছি, ইন্টারনেট চালু আছে, এখানে শুধু গুগুল বলে দেখাচ্ছে। আমি বুঝলাম কি হয়েছে, বললাম অ্যাড্রেসে লেখ facebook.com। বাবা ঠিক আছে দেখছি বলে গুগুলের সার্চে টাইপ করলেন facebook.com।
 
একটু পরে আবার ফোন ফেসবুক খুলছে না। আমি বিরক্ত হয়ে বলি এতদিনেও বুঝলে না গুগুলের সার্চ কোনটা আর অ্যাড্রেস কোনটা। বাবা বললেন - কোনটা বল দেখি? রাগও হয়, মায়াও লাগে - আহা চেষ্টা করছে, পারছে না কি করবে। আবার বোঝাতে শুরু করি একদম উপরে দেখো কি লেখা আছে? বাবার উত্তর - কালোর উপর লেখা এ এস ইউ এস। আমি ঘাবড়ে গেলাম, কালো! এ এস ইউ এস! তারপর বুঝলাম বাবার চোখ গেছে আক্ষরিক অর্থেই মনিটরের একদম উপরের দিকে - যেখানে কালোর উপর লেখা আছে কোম্পানির নাম - আসুস। উফ পারা যায় না, ফোনেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো চীৎকার করতে করতে বোঝালাম মনিটর আর কম্পিউটার-এর ডিসপ্লে কাকে বলে।
 
এবারে আর আগের মতো বাবা ধৈর্য হারিয়ে ফোন কেটে দিতেন না বা রাগ করতেন না। মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী পাশ থেকে এসব শুনে হাসতে হাসতে বলতো, দেখো তবু তো এই বয়সে শেখার চেষ্টা করছে, আমার বাবার তো এসব আগ্রহ নেই, তাই শিখেও উঠতে পারলো না। আমার স্ত্রীর একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম বছর তিনেক আগে। এর মধ্যে যত মাস পেরিয়েছে, ততবারও ফেসবুক খুলে বসার আগ্রহ দেখায় নি। বললে বলে, কতো কাজ, মেয়ের পিছনে দৌড়ানো ইত্যাদি। আমি রেগে বলি আরে ইচ্ছে নেই সেটা বল, এসব অজুহাত দিও না।
 
আস্তে আস্তে বাবার নেশা শুরু হল। মুলতঃ "Jokes কৌতুক" বলে একটি গ্রুপ আর এই "লেখালেখি" গ্রুপের লেখা পড়া, একটু আধটু মন্তব্য করা। মাঝে মাঝে নিজের দেওয়ালে ঢুকে গুলিয়ে ফেলত মেন ফেসবুকে কি করে ফিরে আসবেন। আমি বললাম উপরের বামদিকে ফেসবুক লোগোতে ক্লিক করো। বাবা অবধারিত ভাবে উপড়ের ট্যাবে ক্লিক করে হয়তো সেটাকে ক্লোজ করে দিলেন। একদিন দেখলাম একজনের লেখার নিচে কমেন্ট করতে, কিন্তু কমেন্টের সাথে পোস্টের কোন মিল নেই। পড়ে বুঝলাম একটা পোষ্টে কমেন্ট করতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু তার নিচে যেহেতু কারও কমেন্ট নেই, ছোট্ট কমেন্ট বাটনটা খুঁজে না পেয়ে, পরের পোষ্টে যার নিচে কিছু কমেন্ট আছে সেখানে কমেন্ট করে বসলেন।
 
একদিন আমি একটা উইন্ডচিটার পড়া কুকুরের ছবি পোষ্ট করলাম "Jokes কৌতুক" গ্রুপে। নিচে দেখলাম বাবার একটা অদ্ভুত কমেন্ট। মনে হচ্ছে যেন একটা গল্পের মাঝের বা শেষের অংশ। পড়ে খোঁজাখুঁজি করে আর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম, একটা কৌতুক গল্প লিখতে লিখতে মাঝামাঝি এসে ভুল করে পোষ্ট হয়ে গেছে। বাবা খুঁজে না পেয়ে আর কোথায় মাউস ক্লিক হয়েছে না দেখে আমার ছবিটার তলায় বাকিতা লিখে দিয়েছেন। একদিন দেখি গ্যাস নিয়ে নিজের একটা প্রশ্ন স্ট্যাটাসে লেখার বদলে "লেখালেখি" গ্রুপে পোষ্ট করে দিয়েছেন আর একটা ছোট গল্প "লেখালেখি"-তে না লিখে নিজের দেওয়ালে লিখে পোষ্ট করেছেন।
 
কোলকাতায় থাকলে রাতে শোবার সময় আমি ফেসবুক খুলে ভালো কোন লেখা বা গল্প বা কৌতুক থাকলে পড়ে শোনাই আমার স্ত্রীকে। আমার মেয়েও নাক গলায়। একদিন বাবার একটা কৌতুক পড়ছি, পড়তে গিয়ে বুঝলাম সেটাও মাঝপথে পোষ্ট হয়ে গেছে আর বাবা হয় অন্য কোথাও বাকিটা লিখেছেন বা কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু জোকসের মজা পুরোমাত্রায় পেলাম একজনের কমেন্ট দেখে। তিনি লিখেছেন - "ও দাদা আপনি এমন হঠাৎ হঠাৎ থেমে যান কেন বলুন তো?" শুনে আমার স্ত্রী-কন্যার কি হাসি, এটাই সব থেকে ভালো জোকস বলে।
 
বাবা এখন পুরো মাত্রায় ফেসবুক চালিয়ে যাচ্ছেন। আগে বিকেলে একটা ঘুরতে যেতেন, ঠাণ্ডাও লাগতো এখন ফেসবুক নিয়ে বসেন। আমার মেয়ের লেখায় কমেন্ট না করলে মেয়ের রাগ হয় - দাদু কিছু বলেনি? আবার কোন পোষ্টে কমেন্টে শুনল দাদু লিখেছে - 'পাজি দুষ্টুটার এসবে বেশ মন'।. শুনেই আমার ফোন নিয়ে দাদুকে ফোন করে একটু ঝাড় দিল। আমরা রাতের দিকে বাবার কমেন্ট বা কৌতুক পড়ে মজা নি। মাঝে মাঝে বাবার লেখা কিছু কাহিনী পড়ে নতুন কিছু জানতে পারি। আমার স্ত্রী অধিকাংশ সময় এসবের শ্রোতা। কোন পোষ্ট পড়ে আমি বলি এটা ঠিক জমেনি। আমার স্ত্রী বলে কেন খারাপ নয়। আস্তে আস্তে ভালোই তো হচ্ছে।
 
কিছুদিন আগে একটা আড্ডায় "লেখালেখি"-র এক মাথা বললেন ওনার লেখা মধ্যে বানান ভুল প্রায় হয় না। তবে হয়তো লিখতে গেলেন 'আমি ভাত খেলাম'; বাংলা কীবোর্ডের দয়ায় হয়ে গেল 'আমই ভাট খেলাম'। তবে গল্প হলেও সত্যি এসব শুরু মাত্র এক মাস আগে। কে বলে চেষ্টা করলে ফল পাওয়া যায় না। তবে পরিশেষে ধন্যবাদ "Jokes কৌতুক" এবং "লেখালেখি" গ্রুপের সকলকে। আপনাদের লেখা পড়ার আগ্রহেই বাবার এই ফেসবুক শেখা।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.