Thursday, November 14, 2013

৭. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: ট্রামগাড়ির ইতিকথা

৭. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: ট্রামগাড়ির ইতিকথা

ভারতীয় উপমহাদেশে ট্রামগাড়ি প্রথম চালু হয় ২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৮৭৩ সালে - ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাটের মধ্যে মাত্র .৮৬ কিমি যাত্রাপথ। প্রথম ট্রাম ছিলো ঘোড়ায় টানা এক কামরার গাড়ি - কিন্তূ আশানুরূপ যাত্রী না হওয়ায় সেই বছর ২০শে নভেম্বর কলকাতার ট্রাম উঠে যায় দীর্ঘ বছর জন্যে। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি হিসেবে লন্ডনে নথিভুক্ত হয় ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি (CTC) - নতুন লাইন পাতা হয় বউবাজার স্ট্রিট, ডালহৌসী স্কোয়ার, কাস্টমস হাউস আর স্ট্র্যান্ড রোড জুড়ে। নতুন কলেবরে ঘোড়ায় টানা ট্রাম পরিষেবা চালু হয় ১৮৮০ সালের ১লা নভেম্বর থেকে। ১৮৮২ সালে একমাত্র কলকাতায় পরীক্ষামূলকভাবে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে টানা ট্রাম চালু হয় কিছুদিনের জন্যে।

কলকাতার সব ট্রামলাইনই তখন ছিলো মিটার গেজ ('.৩৭") ১৯০০ সালে শুরু হয় ট্রামলাইনের স্ট্যান্ডার্ড গেজে ('.") পুনর্গঠন। সেই সময় ট্রামকোম্পানির সম্পত্তি ছিলো ১৮৬ টি ট্রামগাড়ি, ১০০০ ঘোড়া, টি ষ্টিম ইঞ্জিন এবং ১৯ মাইল (সাড়ে ত্রিশ কিলোমিটার) ট্রামলাইন। ১৯০৫ সালে কলকাতায় ইলেকট্রিক ট্রামের প্রচলন হয়। ১৯৫১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্রাম কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং ১৯৬৭ সালে ট্রাম কোম্পানিকে আংশিক অধিগ্রহণ করে। ১৯৭৬ সালের ৮ই নভেম্বর থেকে অর্ডিন্যান্স জারি করে পুরোপুরি অধিগ্রহণ করার ফলে এটি এখন পাবলিক সেক্টর প্রতিষ্ঠান।

১৯০৫- কলকাতা ছাড়াও ট্রাম চালু হয় গঙ্গার অপরপ্রান্তের শহর হাওড়ায় - হাওড়া স্টেশন থেকে বাঁধাঘাট আর ১৯০৮ সালে জি টি রোড ধরে শিবপুর পর্যন্ত্য। ১৯৪৩ সালে হাওড়া কলকাতা ট্রাম জুড়ে যায় হাওড়া ব্রিজের উপড় পাতা লাইন দিয়ে - সর্বমোট দৈঘ্য দাঁড়ায় ৬৭.৭৩ কিলোমিটার (৪২.০৯ মাইল)  ১৯৭০ সালে হাওড়ার দিকের ট্রাম বন্ধ হয়ে যায় যানজটের কারনে। স্বাধীনতার পরে প্রথম ট্রামলাইন সম্প্রসারণ ঘটে ১৯৮৫ সালে - মানিকতলা থেকে উল্টোডাঙ্গা স্টেশন এবং ১৯৮৬ সালে বেহালা থেকে জোকা। তবে আস্তে আস্তে অনেক লাইন বন্ধ হয়ে যায় সংস্থার আর্থিক দুরাবস্থা, যানজট এবং আধুনিকরণের অভাবে। ২০১২ সালে বেহালা থেকে জোকা লাইন বন্ধ করে মেট্রোরেলের উড়ালপুলের কাজ শুরু হয়। ২০১১ সালে খিদিরপুর থেকে চেতলা সহ অনেকগুলি ট্রামলাইন নতুন করে পাতা হলেও পরিষেবা চালু হয় নি।

পরিকল্পনা হচ্ছে বিদেশী প্রযুক্তি সহায়তায় নতুনভাবে কলকাতা ট্রামকে পুনরজ্জীবিত করার। ১৯৯২ সাল থেকে ৪০ টি বাস নিয়ে শুরু হয়েছে ক্রমবর্ধমান সিটিসি বাস সার্ভিস। উল্লেখযোগ্য সিটিসি কিছু ট্রাম ও বাস চালায় শুধুমাত্র মহিলাদের জন্যেই, সেখানে কন্ডাকটরও মহিলা। তবে নোনাপুকুর এবং অনান্য ডিপো থেকে কিছু আধুনিক ঝাঁ চকচকে ট্রাম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরী হয়। চালু হয়েছে পর্যটনের জন্যে এক কামরার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম রেস্তোরা 'চরৈবেতি'ট্রাম শুধু দূষণমুক্ত যানই নয়, এটি অনান্য যানের তুলনায় অনেক নিরাপদ এবং সস্তা। কলকাতার ট্রামে নুন্যতম ভাড়া মাত্র টাকা এবং এখনো মাসিক টিকিট পদ্ধতি চালু আছে। ট্রামের বেলাইন হওয়া বা গবাদি পশুর সাথে ধাক্কা মাঝে মাঝে হলেও ট্রামের সাথে কোনো যাত্রী বা পথচারীর দুর্ঘটনার সংখ্যা মাত্র একটি। ১৪ই অক্টোবর ১৯৫৪ সালে ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন এক পথচারী - আটদিন পরে তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়সহ অনান্য ডাক্তারদের চেষ্টা বিফল করে মারা যান কবি জীবনানন্দ দাশ।

কলকাতার পর ট্রাম পরিষেবা শুরু হয় বম্বে শহরে। ১৮৬৪ সালে গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে ছয় বা আট ঘোড়ায় টানা প্রথম ট্রাম চালু হয় পরলে ও কোলাবার মধ্যে। ১৯০৭ সালে চালু হয় ইলেকট্রিক ট্রাম আর ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে একমাত্র দোতলা ট্রাম পরিষেবা। ১৯৩৫ নাগাদ ট্রাম কোম্পানি রমরমার সময় ৪৩৩ টি ট্রাম গাড়ি ৪৭ কিলোমিটার (২৯ মাইল) লাইন জুড়ে চলাচল করতো শহরে লোকাল ট্রেন চালু হলে ট্রামের পরিষেবা আস্তে আস্তে কমতে থাকে এবং ১৯৬৪ সালের ৩১শে মার্চ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মুম্বাই শহরে পৌর নিগমের অধীনে আজকে যে বেস্ট (BEST - বৃহন্মুম্বাই ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্ট) কোম্পানীর বাস চলে সেটি চালু হয় বম্বে ট্রাম কোম্পানি নাম ১৮৭৩ সালে। ১৯০৫ সালে ইলেকট্রিক ট্রামের জন্যে এঁরা একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করেন ওয়াদি বন্দরে - সেই থেকে নাম হয় বম্বে ইলেকট্রিক সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। আজও এঁরা বাস পরিষেবার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করেন।

১৯০৫-এ রাজধানী পরিবর্তন হবার সুবাদে দিল্লী ট্রাম সার্ভিসের শুরু হয় ১৯০৮ সালের ৬ই মার্চ থেকে। ১৯২১-এ দিল্লী ট্রাম কোম্পানির সর্বাধিক ২৪টি খোলা ট্রাম গাড়ি ছিলো ১৫ কিলোমিটার লাইন জুড়ে চলাচল করার জন্যে। এই সার্ভিস মূলতঃ ছিলো চাদনী চক, জামা মসজিদ, লাল কুঁয়া, ফতেহ্পুরি মসজিদ এবং সদর বাজার এলাকা জুড়ে (দিল্লী ৬, পিন কোড ১১০০০৬)। ১৯৬৩ সালে দিল্লীর ট্রাম চিরতরে উঠে যায়।

ভারতে কয়েকটি স্থানের মধ্যে পাটনায় শহুরে পরিবহন হিসেবে ঘোড়া টানা ট্রাম ছিল। জনবহুল অশোক রাজপথ দিয়ে পাটনা সিটি থেকে বানিকপুর যেত ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলি। এই ট্রামের ডিপো ছিল সবজিবাগের পশ্চিম টার্মিনাস (পিরবাহর থানার বিপরীতে)।  পাটনা শহরের পৌরসভা অভিমুখে। এটিকে আরোও পশ্চিমে প্রসারিত করার পরিকল্পনা ছিলো, কিন্তূ অপ্রতুল যাত্রীসংখ্যার জন্যে অল্পদিনের মধ্যেই ১৯০৩ সাল থেকে এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়।

কানপুরে (Cawnpore) ট্রাম চালু হয় ১৯০৭ সালের জুন মাসে। গঙ্গার তীর ঘেঁষে কানপুর স্টেশন থেকে সির্সায়া ঘাট পর্যন্ত্য ৪ মাইল লাইন জুড়ে ২০টি এক কামরার খোলা ইলেকট্রিক ট্রাম চলাচল করতো। এই ধরনের ট্রাম চালু ছিলো দিল্লী, বম্বে, মাদ্রাজ ও হাওড়ায়। ১৯৩৩ সালের ১৬ই মে থেকে বন্ধ হয়ে যায় এই পরিষেবা।

নাসিকে ১৮৮৯ সালে নির্মিত ট্রাম লাইন ছিলো ২'৬"-র গেজ (৭৬২ মিমি) - পরামর্শকারী প্রকৌশলী ছিলেন এভেরার্দ কালথ্রোপ, যিনি বার্সি লাইট রেলওয়ে বানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথমে ছিলো চার ঘোড়ায় টানা দুই কামরার ট্রামগাড়ি। প্রধান রাস্তার উপর অবস্থিত পুরোনো পৌর নিগম ভবন থেকে নাসিক রোড রেল স্টেশন পর্যন্ত্য প্রায় ১০ কিলোমিটার পথে এই ট্রাম চলতো। নাসিক এবং নাসিক রোডের মধ্যে ছিলো ঘন জঙ্গল - স্টেশন থেকে শহর যাবার যানবাহন বলতে ছিলো দুয়েকটি ট্যাক্সি আর ঘোড়ায় টানা এই ট্রামগাড়ি। ১৯৩১ সাল থেকে এই ট্রাম বন্ধ হয়ে যায়।

মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) প্রথমে ট্রাম চলতো জাহাজ-ঘাটা থেকে অন্তর্দেশীয় এলাকায় বহন পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্যে। ৭ই মে ১৮৯৫ সালে ভারতের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয় মাদ্রাজ শহরে এবং খুব জনপ্রিয় হয়। এই ট্রামের যাত্রাপথ ছিলো মাউন্ট রোড, প্যারিস কর্নার, পুনামাল্লি রোড ও রিপন বিল্ডিং। ১৯২১ সালে ৯৭টি গাড়ি ২৪ কিলোমিটার লাইন জুড়ে চলাচল করতো। ট্রাম কোম্পানি ১৯৫০ সাল নাগাদ দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ১৯৫৩ সালের ১২ই এপ্রিল থেমে যায় মাদ্রাজ ট্রামের চাকা।

কেন্দ্র সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দূষণমুক্ত যান হিসেবে ট্রাম পরিষেবা শুরু করা হবে - যেমন গুজরাতের ঢোলেরা; মধ্যপ্রদেশে ইন্দোর ও পিথামপুরের মধ্যে; পাঞ্জাবে ফাগবারায় লাভলী প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস; হরিয়ানায় মানেসর ও বায়েলের মধ্যে। এছাড়াও বিবেচনার মধ্যে আছে মুম্বাইয়ে ভাসাই-ভিরার এবং মিরা-ভায়ান্দার এলাকা; কলকাতায় গঙ্গার তীর ধরে বাগবাজার থেকে প্রিন্সেপ ঘাট এবং সল্টলেকে রাজারহাট ও সেক্টর ফাইভ।

অবিভক্ত ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে এবং অধুনা পাকিস্তানে একমাত্র ট্রাম ছিলো করাচী শহরে। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকারে চালু করা এই পরিষেবা দীর্ঘ ৯০ বছর ধরে চালু থাকার পরে যানজট ও ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনার জন্যে ১৯৭৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তবে পাকিস্তানের গ্বাদার শহর ও বন্দরের মাঝে একটা ট্রাম পরিষেবা চালু হবার কথা - যার নির্মান কার্য ২০১১-র শেষভাগ থেকে শুরু হয়েছে।

১৯০০ সাল থেকে শ্রীলঙ্কায় ট্রাম চালু ছিলো কলোম্বো শহরের উত্তর ও মধ্য অঞ্চলে। এটি ছিলো ৪২" (৩'৬")-র গেজে বৈদ্যুতিক ট্রাম গাড়ি সিস্টেম। প্রথমে ট্রাম পরিষেবার দায়িত্বে ছিল কলোম্বো ইলেকট্রিক ট্রাম এন্ড লাইটনিং কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তূ ১৯২৯ সাল নাগাদ একটি কুখ্যাত ট্রাম গাড়ির ধর্মঘট পরে, কলোম্বো পৌর কাউন্সিল এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ট্রাম সিস্টেম আস্তে আস্তে কমতে থাকে এবং ১৯৬৩ সালে পুরোপুরি উঠে যায়।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.