Thursday, November 14, 2013

৬. ধর্মের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: অজাচার


৬. ধর্মের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: অজাচার


এই লেখায় আমার অল্প বিদ্যায়, ধর্মে ধর্মগ্রন্থে কিছু অজাচারের কথা বলি। প্রথমেই বলে রাখি জন্মসুত্রে আমি হিন্দু, কিন্তূ আমার বিশ্বাস হিন্দু কোনো ধর্ম নয়। আমি মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী। তবু অজান্তে কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আর কোনো ভুল থাকলে সঠিক তথ্যপ্রমানসহ একটু শুধরে দেবেন। এই লেখার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই কোনো কামজ উত্তেজনা সৃষ্টি নয় বরং একটা অবিশ্বাস কে বিশ্বাস করা যে অজাচার ছাড়া এই পৃথিবী বা এই যে বিশাল মানবজাতি তৈরী কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না।

সনাতন বিশ্বাসে প্রমান করা যায় মুসলিম ধর্ম বা  খ্রিস্টধর্ম সনাতন হিন্দু ধর্ম থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এসেছে। আমি সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, তবে একটু ধর্মগুলোর উৎপত্তি দেখে নেওয়া যাক। হিন্দু ধর্ম বা বিশ্বাসের সূচনা বা বৈদিক সভ্যতা ১০,০০০ (দশ হাজার) বছরের পুরনো (ঋগবেদের সময় অনুসারে); কেউ মনে করেন হিন্দুধর্মের সূচনা ,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, আবার অনেকেই মনে করেন হিন্দু কোনো ধর্ম নয়, একটি সভ্যতা মাত্র। আমি শেষোক্ত দলে পড়ি। এছাড়া ,০৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ আব্রাহাম প্রচারিত ইহুদীধর্ম; ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জরথুস্ট্রপন্থা; ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীর প্রচারিত জৈনধর্ম; ৫৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম; ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কনফিউশিয়াসের কনফিউশিয়ানিজম; ৩০ খ্রিস্টাব্দে যিশু খ্রীষ্ট প্রচারিত খ্রীষ্টধর্ম;  ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হজরত মহম্মদ প্রচারিত ইসলাম বা মুসলিম ধর্ম; ষষ্ঠ শতাব্দের শিন্টো বা জাপানি ধর্ম; পঞ্চদশ শতাব্দীতে গুরু নানকের শিখধর্ম; ,৬৫০ নাগাদ দলাই লামার তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম; এবং ,৮৪৪ নাগাদ আবুল বাহা প্রচারিত মানবধর্ম - বাহাই।

হিন্দুবিশ্বাস যে আদি মানব বা প্রথম স্রষ্টা ছিলেন ব্রহ্মা। আদি তিনদেবতা হলেন - ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর; কিন্তূ লক্ষনীয় বিষ্ণু মহেশ্বর বিভিন্নরূপে পূজিত হলেও কেরালা বা পুষ্করসহ দু-চারটি জায়গা বাদে ব্রহ্মার কোনো মন্দির নেই বা উনি এই ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করলেও, নিজে সেরকমভাবে কোথাও পূজিত হন না। কারণ অনেকগুলো, তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ওনার অজাচারী স্বভাব। ব্রহ্মা স্বয়ম্ভূ - পদ্মফুল বা মতান্তরে জল থেকে জন্ম - একটি মাথা নিয়ে। নিজের দেহ থেকে উনি অন্য অনেক প্রাণীর সাথে এক অপরূপ সুন্দরী নারী সৃষ্টি করেন, যার নাম শতরূপা। শতরূপা অনেকসময় সাবিত্রী বা ব্রাহ্মি বা সরস্বতী বা গায়ত্রী নামেও পরিচিত। কিন্তূ এরপর গোল বাঁধলো, ব্রহ্মা নিজের সৃষ্ট কন্যার প্রেমে পড়ে গেলেন। শতরূপা লজ্জা পেয়ে যেদিকে লুকোতে যান, ব্রহ্মা সেইদিকে নিজের একটি করে মাথা তৈরী করেন। এভাবে উনি চারদিকে চারটি আর উপরে একটি - মোট পাঁচটি মাথা তৈরী করেন। দেবশ্রেষ্ঠ শিব এই সময় এগিয়ে এলে ব্রহ্মা শিব অপমান করে বসেন এবং পরিনামে শিবের তৃতীয় নয়নের তেজে উপড়দিকে মুখ করা মাথাটি পুড়ে যায়। সেই থেকে অজাচারী ব্রহ্মার পাঁচটি মাথা আর অজাচারের শাস্তি হিসেবে মর্ত্যলোকে পূজিত হন না।

হিন্দুবিশ্বাসের অন্য মতে সৃষ্টির আদিপুরুষ মনু - যার সন্তানদের সংস্কৃতে মানব বা মানুষ এবং ল্যাটিনে ম্যান বলে। মনুর সন্তানরাই ব্রাহ্মণ (যারা বেদচর্চা করতো), ক্ষত্রিয় (যারা দেশশাসন করতো), বৈশ্য (যারা ব্যবসা বানিজ্য করতো) এবং শুদ্র (যারা কায়িক পরিশ্রম করতো)। মনুর পুত্রসংখ্যা ষাটটিরও বেশী - এরমধ্যে অষ্টম সন্তান কন্যা - ইলা। স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে, একজন পুরুষ থেকে জাত সন্তানদের বংশরক্ষা হলো কি করে? তবে অনুমান করা ছাড়া অজাচারের কোনো সাক্ষ্য প্রমান নেই।

হিন্দুধর্মের দুটি অমূল্য সম্পদ আছে - যেগুলোকে কেউ বলেন পুরাণ, কেউ বলেন মহাকাব্য, কেউ বলেন ইতিহাস। সে দুটি হলো ত্রেতাযুগের ঘটনা নিয়ে লেখা রামায়ন এবং দ্বাপরযুগের মহাভারত। আমরা অমোঘবীর্য গুরু বৃহষ্পতির নিজের সন্তানসম্ভবা বৌদির সাথে বলপূর্বক মিলিত হওয়ার মতো ঘটনাগুলি বাদ দিয়ে চলে আসি কুরুবংশের কথায়। বিচিত্রবীর্য যখন টিউবারকোলেসিসে অকালে মারা যান, তখন বংশরক্ষার জন্য দুই সহোদরা পুত্রবধুর ঘরে শাশুড়ী সত্যবতী পাঠিয়ে দেন তাঁরই কুমারী অবস্থায় পরিত্যক্ত জারজ সন্তান কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসদেবকে। অর্থাৎ নিয়োগপ্রথায় ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর জন্ম অম্বিকা অম্বালিকার গর্ভে, তাঁদের সম্পর্কে ভাসুর ব্যাসদেব দ্বারা। তবে ব্যাসদেব বা পান্ডবদের জন্মগুলো অবৈধ কিনা সেই বিতর্কে না গেলেও বলা যায়, যাই হোক সেই সম্পর্কগুলো অজাচার নয়।

কোরানে বাইবেলের অনেক কাহিনীর উল্লেখ দেখা যায়।সেটাই স্বাভাবিক কারন ইসলাম দাবী করে ধারাবাহিকতার সূত্রে সে সর্বশেষ ধর্ম।আর তাই ইসলাম ধর্মের মধ্যে পূর্বোক্ত ধর্ম যেমন ইহুদি খৃষ্টান এগুলোর নানান কাহিনীর উল্লেখ থাকবে। তবে উল্লেখিত কাহিনীর মধ্যে বহু গরমিলও লক্ষ্যনীয়। দেখা যায়, বাইবেলে যেভাবে কাহিনীটা আছে কোরানে আছে ভিন্নরকম ভাবে। ইসলাম, ইহুদীধর্ম বা পরবর্তী খ্রিস্টধর্মে প্রথম মানুষ হিসেবে উল্ল্যেখ করা হয়েছে আদমকে। শুরুর দিকটা মোটামুটি একই রকম। ইহুদি, খ্রিস্ট বা ইসলামে আদম হলো প্রথম মানব - যাকে ঈশ্বর বা গড বা আল্লাহ খরখরে মাটি থেকে সৃষ্টি করেন। তারপর তাঁর দেহে প্রাণ সঞ্চার করা হয়। আর ইভ (কোরানমতে হাওয়া) হলো প্রথম মানবী - যার সৃষ্টি আদমের পাঁজর থেকে। সৃষ্টির পর তাঁদের আবাস হয় বেহেশত বা স্বর্গ। তবে শয়তানের ঘটনা, নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলা বা স্বর্গোদ্যান থেকে বহিষ্কারের ঘটনাগুলো পবিত্র কোরান, ওল্ড টেস্টামেন্ট বাইবেলে একে অপরের থেকে একটু আলাদা। ইসলাম মনে করে বহিষ্কারের পর আদমের জীবনকালেই নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলার পাপের  প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গিয়েছিলো। আবার বাইবেলের মতে সেই পাপ মানুষজীবনে ধারাবাহিকভাবে প্রবাহমান হয়, যার প্রায়শ্চিত্ত হয় যিশু খ্রিস্টের আত্মবলিদান বা ক্রুশবিদ্ধকরণের মাধ্যমে। নোয়ার (নূহের) নৌকা বা পৃথিবীব্যাপী বিধ্বংসী বন্যা বা সুনামী এই তিন ধর্মগ্রন্থেই প্রায় একই রকমভাবে উল্লিখিত - যা মাইল যায় বিষ্ণুপুরাণ বা মনুসংহিতায় উল্লিখিত বিধ্বংসী বন্যা এবং বিষ্ণুর মৎস্য অবতার হয়ে সপ্তম মনুকে সপারিষদ রক্ষা করার সঙ্গে।

আমরা ফিরে আসি অজাচারে - সরাসরি বাইবেল ও কোরান প্রসঙ্গে। কোরানের মতে পৃথিবীতে আসার পর আদম ও হাওয়ার ৩৬১টি সন্তান হয় - এর মধ্যে একমাত্র শীস ব্যতীত সবাই জোড়ায়। হাদিসে আছে আদম ও হাওয়ার গর্ভে প্রতিবার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম নিত। তারা যখন বড় হতো, তখন ছেলে পূর্বে জন্ম নেওয়া মেয়ের সাথে এবং মেয়েকে পূর্বে জন্ম নেওয়া ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হতো। যদিও তারা একই মায়ের সন্তান তবু প্রয়োজনের কারণে ও মানবজাতির বিকাশের জন্যে এটা বৈধ ছিল - অজাচার কিন্তূ অনাচার নয়। ইসলামে এখন আপন ভ্রাতা ভগ্নী ভিন্ন অন্য কোনো জ্ঞাতিভাই বা বোনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বৈধ। হিন্দু বিবাহ আইনের বিশেষ বিবাহ আইনে কিছু বিধিনিষেধসহ জ্ঞাতিভাই বা বোনের মধ্যে বিবাহ সিদ্ধ।

বাইবেলের মতে আদম ও ইভের অনেক সন্তানের মধ্যে প্রথম দুই ছেলের নাম ছিল কেইন ও আবেল। কেইনের এক জমজ বোন ছিলো আর আবেলের সাথে জন্মায় আরো দুই বোন - মানে ত্রয়ী। আদমের প্রথম দুই মেয়ের নাম ছিলো আজুরা ও আওয়ান। কেইন ও আবেল দুজনেই নিজেদের জমজ বোনকে বিয়ে করে। কিন্তূ তৃতীয় বোনকে কে বিয়ে করবে এই নিয়ে ঝগড়ায় কেইন আবেলকে বধ করে। আদমের তৃতীয় পুত্র শেথ তার এক ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বিয়ে করে। তওরাত আইনে (মোজেস প্রণীত) কাকা - ভাইঝি বিবাহ স্বীকৃত।

পরিশেষে পাঠকদের কাছে নিবেদন, সব তথ্য বিভিন্ন সুত্র থেকে যাচাই করে দেওয়া। তাই কোনো সংশোধন থাকলে সুত্রসহ উল্লেখ করবেন। মনে রাখা ভালো, মনু একটি উপাধিমাত্র এবং এক মনু ৩০,৬৭,২০,০০০ (ত্রিশ কোটি ষাটষট্টি লক্ষ কুড়ি হাজার) বছর বেঁচে থাকেন। আদমের উচ্চতা ছিলো ৩০ ফুট এবং বেঁচেছিলেন ৯৩০ বছর। নোয়া সেই বিধ্বংসী বন্যার পরেও ৩৫০ বছর বেঁচে, নিজের ৯৫০ বছর বয়সে মারা যান।

কাল অতো রাতে ঘুমের ঘোরে একটু গন্ডগোল হয়ে গেছে। আদমের তিন ছেলে আর দুই মেয়ে এক মতে, আবার ভিন্নমতে তিন মেয়ে দুই ছেলে। আর একটা কথা কথা ইভ (বা হাওয়া) আদমের পাঁজর থেকে তৈরী আবার আদমের স্ত্রী। তারমানে আদম নিজেই নিজের আত্মজাকে বিবাহ করেছিলো।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.