৮. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: বিমান আবিষ্কার
নিশ্চয় মনে করানোর দরকার নেই যে আমরা রাইট ভাতৃদ্বয়কেই প্রথম বিমান আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়ে থাকি। তাঁদের কিছু কৃতিত্ব আছে, সেটা অস্বীকার করে লাভ নেই। নাহলে রাইট না হয়ে লেফট বা টম ডিক হ্যারির ভাগ্যে এই কৃতিত্ব জুটত। কিন্তু ওই যে আমরা নিজেরাই নিজেদের অতীত সম্বন্ধে বেশ অজ্ঞ। আর শুনলেই বিশ্বাস করার আগে বলে উঠি এসব ফালতু কথা, সব যদি বেদেই থাকে তাহলে আমরা আবিষ্কার করিনি কেন ইত্যাদি। আসলে আমরা একটু সাদা চামড়ার গোলামী করতে পছন্দ করি। সাহেবরা বললে সব ঠিক। যদিও অনেকে জানেন "বৈমানিক শাস্ত্র"-এ শুধু তথ্য ছাড়াও "শকুনা ভিমান" বা "রুক্মা ভিমান" (সংস্কৃতে বানানটি বিমান নয় ভিমান) ইত্যাদির নকশাও দেওয়া আছে। তবু আপাতত সরিয়ে রাখা যাক "বৈমানিক শাস্ত্র"-এর কথা বা অনেকের মতে "বৈমানিক শাস্ত্র" বলে আদপে কিছু ছিল কিনা সেই কথা।
অনেকে শুনে থাকতে পারেন লিওনার্দোর নোটবুকের কথা। সেই লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (১৪৫২ থেকে ১৫১৯) যিনি 'কি ছিলেন' না বলে, 'কি ছিলেন না' সেটা বলাই হয়তো অনেক সহজ। চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, গণিতজ্ঞ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, শারীরস্থানবিৎ (অঙ্গব্যবচ্ছেদে দক্ষ ব্যক্তি), ভূবিজ্ঞানী, মানচিত্রকার, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, লেখক – আরও কিছু। এই ভদ্রলোক ইতালিয়ান ভাষায় পুরোপুরি উল্টোভাবে পাঁচহাজার পাতার উপর একটা নোটবুক লিখে গিয়েছেন। যার খুব সামান্য অংশই উদ্ধার বা পাঠোদ্ধার করা গেছে। অনেক আশ্চর্য্য জিনিসের সাথে লিখে গেছেন গতিবিদ্যার মুলনীতিগুলো। আজ্ঞে হ্যাঁ, বৈদিক সুত্র ছেড়ে দিন, আমরা এটাকে নিউটন সাহেবের আবিষ্কার বলেই জানি ও মানি। অবাক হচ্ছেন বা সন্দেহ হচ্ছে, তাহলে আরও বলি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবও তার কিছু নকশায় বলা ছিল। আগ্রহী পাঠক শ্রদ্ধেয় নারায়ণ সান্যালের "লেঅনার্দোর নোটবই এবং..." বইটি পড়ে নিতে পারেন। কি আশ্চর্য, একটা বিমানের নকশা দেওয়া হোল। এটা দিনের পর দিন বাজার থেকে পায়রা কিনে উড়িয়ে স্কেচ করা সেই লিওনার্দোর আঁকা যার নামই হয়ে গিয়েছিল 'পায়রা ওড়ানো কাপ্তেন"। নকশাটি বিভিন্ন কারনে পরীক্ষামুলকভাবে সফল না হলেও আজকের বিমানের সাথে কতো মিল!
আরও একটা তথ্য অন্তর্জালে খুঁজে দেখা যেতে পারে। আনুমানিকভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৬,০০০-এর আগে কোনসময় আমেরিকা থেকে ইজিপ্ট হয়ে ভারতবর্ষের উত্তরপ্রান্তের মধ্যে একটা বিমান পরিষেবা চলতো। অবাস্তব লাগছে, স্বাভাবিক। হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত প্রথম বিমান - রামায়নের উত্তরখণ্ডে পুস্পক রথের কথা মনে আছে? বিশাল আকৃতির এই দোতলা বিমানটি বিশ্বকর্মা তৈরী করেছিলেন ব্রহ্মার জন্যে, পরে ব্রহ্মা এটা জামাই কুবেরকে উপহার দেন। কুবেরের কাছ থেকে এটি চুরি করেন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই লঙ্কারাজ রাবন। পুস্পক রথে করে রাম, সীতা, বিভীষণ এবং সুগ্রীবসহ বানরসেনা লঙ্কাবিজয় করে অযোধ্যা ফিরে আসেন। বাল্মিকি উল্লিখিত মঙ্গলগ্রহ ও কোশালার বিশাখা নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে লঙ্কার যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৫ই নভেম্বর, ৭২৯২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ – ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ আমাবস্যায় রাবনের মৃত্যুর সাথে। রামায়নের সমস্ত বর্ণনা খুঁটিয়ে পড়লে এটাকে কাল্পনিক পুরাণ না বলে বাস্তব (বা ঐতিহাসিক) ভ্রমনকাহিনী বলা যায়।
ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাস সরিয়ে রেখে ফিরে আসা যাক কিছু প্রমাণিত ঐতিহাসিক তথ্যে। শিভকার বাপুজি তলপাড়ে (১৮৪৬-১৯১৬) নামে এক মহারাষ্ট্রের এক ব্যাক্তি ১৮৯৫ সালে সফলভাবে "মরুৎসখা" নামে একটি মানববর্জিত বা স্বয়ংক্রিয় বিমান উড়িয়েছিলেন প্রায় ১,৫০০ ফুট উচ্চতায়। রাইট ভাইদের বিমান উড়ানোরও আট বছর আগে। অনেকে ভাববেন যেমন হয়েছিল মার্কনি সাহেবের ক্ষেত্রে – এখানেও বোধহয় তাই। মানে তারাও বিমান আবিষ্কার নিয়ে কাজ করছিলেন আর কাজটি আগেই দাখিল করে দেন বিশ্বদরবারে। আজ্ঞে না, মার্কনি সাহেবরা কি করতেন তখন সে কথায় পরে আসছি। ১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ সূর্য মধ্যগগনে। সিপাহীদের দমন হয়ে গেছে। দেশীয় রাজারা বশ্যতা স্বীকার করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। সেই সময় এক কালা আদমির এই অভূতপূর্ব সাফল্য ইংরেজশাসক ভালো চোখে নেবার কথাই হয় না। বেশ কিছু বছর আগে বাবু রাধানাথ শিকদারের জরিপ করা শৃঙ্গের নাম হয়েছে উপরওয়ালা জর্জ এভারেস্টের নামে।
ভারতের ইতিহাস সবসময় শাসকের ইচ্ছায় হয় বিনষ্ট বা অন্যায়ভাবে পরিবর্তিত। তলপাড়ে ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত ও বেদজ্ঞ। একমতে 'মরুৎসখা' হল দেবী সরস্বতীর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত (ঋগবেদ ৭।৯৬।২)। অন্যমতে 'মরুৎ' মানে বায়ু বা বায়ুপ্রবাহ এবং 'সখা' মানে বন্ধু। তাঁর বৈদিক শাস্ত্রের মহিমা প্রমান করার প্রচেষ্টা ভারতীয় পণ্ডিতদের দ্বারা স্বীকৃত হয় – এবং তলপাড়ে বিদ্যা প্রকাশ প্রদীপ উপাধিতে ভূষিত হন। শোনা যায় এই পরীক্ষা চাক্ষুষ করার জন্য বোম্বে চৌপাট্টীর সমুদ্র সৈকতে বিশাল জনসমাগম হয়েছিল – যার মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ অফিসার, জাস্টিস মহাদেব গোবিন্দ রানাড়ে ও বড়োদার মহারাজা তৃতীয় সায়াজিরাও গাইকোয়াড। সফল উড্ডয়নের পরে ব্রিটিশ অফিসাররা এসে তলপাড়েকে রাজি করান (মতান্তরে ভয় দেখান) সব নকশা, গণনা ও নথিপত্র তাঁদের হাতে তুলে দেবার জন্যে। তাঁরা বলেন এইসব তথ্য ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে সারা বিশ্বের কাছে প্রদর্শন করা হবে। তা যে হয়নি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে করা হয় সব তথ্য ইংল্যান্ড হয়ে গিয়ে পৌছায় আমেরিকায়।
অন্য আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায়, এই পরীক্ষার মুল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বড়োদার রাজা। সফল উড্ডয়নের পরে তলপাড়ে তার সব তথ্য ইংরেজ শাসকদের হাতে তুলে দিতে রাজি না হওয়ায়, ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞায় বড়োদার মহারাজা তলপাড়েকে সাহায্য করতে অস্বীকৃত হন। তলপাড়ের স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তলপাড়ে আর্থিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এই আবস্থায় মহারাজার ঋণ শোধ করার জন্য তাঁর আত্মীয়রা মরুৎসখার অবশেষ বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ১৯১৬ সালে অস্বীকৃত দুর্ভাগা এই পণ্ডিত নিজদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এবার আসা যাক রাইট ভাইদের কথায়। প্লেন আবিস্কারের বা না-আবিস্কারের আগে এঁদের ছিল একটা প্রিন্টিং ও সাইকেল সারানোর দোকান। ১৮৮৫-৮৬ নাগাদ মুখে একটা হকি স্টিকের আঘাতে উইলবার গৃহবন্দী হয়ে যান। উইলবার ছিলেন লেখক। ১৮৮৮ সালে উইলবারের সহায়তায় বেশী বরাত নেবার জন্যে অরভিল একটা বড়সড় ছাপাখানা তৈরী করেন। প্রথমবার ছাপার অক্ষরে লেখা হয় 'রাইট ভ্রাতৃদ্বয়' (দ্যা রাইট ব্রাদার)। এরপর ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত্য রাইট ভ্রাতৃদ্বয় বেশ কিছু প্রকাশনা এবং কিছু স্বল্পস্থায়ী স্থানীয় সংবাদপত্রের কাজ করেন। ইতিমধ্যে ১৮৯২ সাল নাগাদ রাইটরা 'রাইট সাইকেল কোম্পানি' নামে বাইসাইকেল উৎপাদন ও মেরামতির ব্যবসা শুরু করেন। ১৮৯৬ থেকে ১৯০০-র মধ্যে অনেকগুলি ব্রান্ডের সেই ব্যবসাও বেশ ফুলেফেঁপে ওঠে। এরপর ১৯০৩ নাগাদ রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের 'তথাকথিত' বিমান আবিষ্কার। ইন্টারনেটে একটু খুঁজে দেখলে 'প্রিন্টিং প্রেস টু বাইসাইকেল রিপেয়ার সপ টু এয়ারপ্লেন' সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। এবার আসা যাক বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যেঃ
১। উইলবারের কোন প্রকৌশল শিক্ষা ছিল না এবং অরভিল উচ্চবিদ্যালয়ের গণ্ডী পার করেন নি। কিন্তু এনারা হঠাৎ সফলভাবে উড়োজাহাজের উত্তোলনের সমীকরণ আবিষ্কার করে ফেললেন! এর জন্যে কোন ইউনিভার্সিটির পরীক্ষাগারও দরকার পড়েনি। শোনা যায় ওনারা নাকি সাইকেল তৈরীর কারখানাতেই সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফেলেছিলেন!
২। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এরোপ্লেন আবিষ্কার করে ফেললেন এমন একটা সময় যখন ওনাদের বাইসাইকেল তৈরীর ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে এবং সবথেকে বেশী উত্পাদন করতে হচ্ছে!
৩। রাইটরা এরোপ্লেন আবিষ্কার করে ফেললেন, এদিকে প্রেস ও সাইকেল তৈরীর ব্যবসাও দারুন চলছে। বেশ কিছু মার্কিন ও ইউরোপীয়ান ধনকুবের অংশীদার হয়েছেন। যখন বৃহস্পতি তুঙ্গে তখন ১৯০২ সালে ওনারা সাইকেল ব্যবসাটি বেচে দিলেন হেনরি ফোর্ডকে!
৪। বলা হয় জাতে ফরাসী, কর্মসূত্রে আমেরিকান অক্টেভ চানুটে নাকি আসল এরোপ্লেন বানিয়েছিলেন। কিন্তু ওনার বয়স হয়ে গিয়েছিল বলে রাইট ভাইদের কপালে প্রথম প্লেন চালানোর সুযোগ জোটে। এটা নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্ত খেয়াল রাখা উচিত প্রথম প্লেন চালানো আর প্লেন আবিষ্কার এক নয়।
৫। মনে রাখা উচিত আমেরিকায় বসে পেটেন্ট নেওয়া সহজ হলেও তখন ভারতীয়দের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত, অনেক নিয়মের বেড়াজাল টপকাতে হতো, ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি নিতে হতো। ১৮৯৬ সালে, তলপাড়ের এক বছর পর অক্টেভ গ্লাইডার বাইপ্লেন তৈরী করেন এবং নিজেও সফল উড্ডয়ন করেন। তারমানে রাইট ভাইদের আগে এক ফরাসীয় আকাশে উড়েছিলেন!
৬। তলপাড়ের বিমান আকাশে ছিল কয়েক মিনিট আর এর মূল উপাদান ছিল সৌর শক্তি ও পারদ। রাইট ভায়েরা আকাশে ছিলেন মাত্র ৩৭ সেকেন্ড। তবু আমরা ছেলেমেয়েদের শেখাব বিমান আবিষ্কার করেছিলেন – উইলবার ও অরভিল রাইট।
৭। আরও আছে! ১৮৮০ সালে আলভা এডিসন একটি বেলুনে উড়েছিলেন এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন। ১৮৯৬ সালে আমেরিকান স্যামুয়েল ল্যাংলে বাস্পচালিত বেলুনে ১০০ ফুট উচ্চতায় প্রায় পৌনে মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৯০০ সালে জার্মান ইঞ্জিনিয়ার ফার্ডিন্যান্ড ভন যেপ্পেলিন ১,১০০ ফুট উচ্চতায় উড়েছিলেন। এগুলো ছাড়াও ১৯০১ থেকে ১৯০৪-এর মধ্যে ব্রাজিলিয়ান স্যান্টোস ডি মন্টি প্রায় ১৪ টি এরোপ্লেন তৈরী করেছিলেন এবং নিজেও সফলভাবে আকাশে উড়েছিলেন রাইট ভায়েদের অনেক আগেই।
৮। অক্টেভের বাইপ্লেনের নকশায় একটু অদলবদল করে রাইট ভায়েরা আকাশে ওড়েন ১৯০৩ সালে। তাঁদের কপালে জোটে বিমান আবিস্কারের (!) তকমা। অক্টেভের নামেও মিউজিয়াম আছে। লিওনার্দোকে লোকে মনে রেখেছে মোনালিসা (La Gioconda) বা শেষ সায়মাশ (Last Supper) আঁকার জন্যে। তলপাড়ের নামে এখনো নিজের দেশেও একটা মিউজিয়াম বা রাস্তা হয় নি। মুম্বাইয়ের ভিলে পার্লেতে এক প্রদর্শনীতে মরুৎসখার একটি মডেল দেখানো হয়েছিল এবং হিন্দুস্থান এরোনটিক্স লিমিটেডে এই ঐতিহাসিক পরীক্ষার কিছু তথ্য সংরক্ষন করা আছে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.