Monday, November 25, 2013

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কবিতা

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কবিতা 


অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী বাড়ি আছো?’

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে
অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী বাড়ি আছ?’

আমাকে পোড়াও
ও চির প্রনম্য অগ্নি আমাকে পোড়াও
প্রথমে পোঁড়াও ওই পা দুটি
যা ছলৎ শক্তি হীন ।
তারপর যে হাতে আজ প্রেম পরিচ্ছন্নতা কিছু নেই
এখন বাহুর ফাদে ফুলের বর
এখন কাঁধের পরে দায়িত্বহীনতা
ওদের পুঁড়িয়ে
এসো , এসো হৃদয়ের কাছে
দাঁড়াও লহমা।
তারপর ,ধংস করো
সত্য মিথ্যা রঙ্গে
শীতে স্তব্ধ জ্ঞান পীট ।
রক্ষা করো, রক্ষা করো দুটি চোখ
হয়ত তাদের এখনো দেখার কিছু কিছু বাকী আছে ।
অশ্রুপাত শেষ হলে , নষ্ট করো আঁখি ।
কুঁড়িয়ো না ফুলো মালা
স্তবক সুগন্ধে আলু থালু প্রিয়কর স্পর্শ
ওর গায়ে লেগে আছে
গঙ্গা জ্বলে ভেসে যেতে দিও ওকে মুক্ত ,স্বেচ্ছাচারী
ও চির প্রনম্য অগ্নি আমাকে পোড়াও।

আমি যাই
যেখানেই থাকো
এপথে আসতেই হবে
ছাড়ান্ নেই
সম্বল বলতে সেই
দিন কয়েকের গল্প
অল্প অল্পই
আমি যাই
তোমরা পরে এসো
ঘড়ি-ঘন্টা মিলিয়ে
শাক-সবজি বিলিয়ে
তোমরা এসো

আতাচোরা
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
হলুদ ?
বাঁশ বাগানে যইনে
ফুল তুলিতে পাইনে
কলুদ
হলুদ বনের কলুদ ফুল
বটের শিরা জবার মূল
পাইতে
দুধের পাহাড় কুলের বন
পেরিয়ে গিরি গোবর্ধন
নাইতে
ঝুমরি তিলাইয়ার কাছে
যে নদিটি থমকে আছে
তাইতে
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
হলুদ ? 


এবার হয়েছে সন্ধ্যা
এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না - নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
শ্রাবনের মেঘ কি মন্থর!
তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর
ছলোছলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে
নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে
কিশলয়, সবুজ পারুল
পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
চিরদিন হবে
এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে?
তুমি ভালোবেসেছিলে সব
বিরহে বিখ্যাত অনুভব
তিলপরিমাণ
স্মৃতির গুঞ্জন - নাকি গান
আমার সর্বাঙ্গ করে ভর?
সারাদিন ভেঙ্গেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তবু নও ব্যথায় রাতুল
আমার সর্বাংশে হলো ভুল
একে একে শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে। সকলে বিদ্রূপভরে দ্যাখে।

এক অসুখে দুজন অন্ধ
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক'রে
সঙ্গে আছে
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ । 

একবার তুমি
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো-
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।

বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক - ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল-
অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।

মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো
রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো । 

বাগানে কি ধরেছিলে হাত
যবে হাত ধরেছিলে হাতে
এ-প্রাণ ভরেছে অকস্মাতে
সকল বিস্ময়
তখনই তো ধ্বংসের সময়,
তখনই তো নির্মাণের জয়।

তোমার হাতের মাঝে আছে পর্যটন-
একথা কি খুশি করে মন?
একথা কি দেশ ঘুরে আসে
স্মরণীয় বসন্তবাতাসে!

এবার হলো না তবু ছুটি
দুলে ওঠে মোরগের ঝুঁটি
বেলা গেলো - বুকে রক্তপাত

বাগানে কি ধরেছিলে হাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত? 

ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ
ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় -
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু - প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন -
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে। 

ছিন্ন বিছিন্ন
এই যে আছি, থাকবো না আর
সময় হলে লুকিয়ে যাবার
তখন কি কেউ দেখতে পাবে
আমার সঙ্গে পথ হারাবে ?
কক্ষনো নয়,কক্ষনো না
আমিতো নই সবার চেনা !  

চতুর্দশপদী কবিতাবলী
ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা-
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে। 

দিন যায়
সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির ।

ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্‌লা হাওয়া নয়
ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার ।

জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চট্‌কা ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, ষাদে, মিছে দিন যায়  

কিছু মায়া রয়ে গেলো
সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই -
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই -
ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু। 

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় -
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু - প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন -
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে । 

পাবো প্রেম কান পেতে রেখে
বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব'সে আছো, দেবতা আমার |
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?
যেখানে শুইয়ে গেলে ধিরে-ধিরে কত দূরে আজ !
স্মারক বাগানখনি গাছ হ'য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁডা-বাসা শূন্য ক'রে পলাতক হলো |
আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে |
নীলিমা ঔদাস্তে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে | 

পরস্ত্রী
যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো
যাবো না আর ঘরে
সব শেষের তারা মিলালো
আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না
ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না
বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো
কখন যেন পরে?
সবার বয়স হয়
আমার
বালক-বয়স বাড়ে না কেন
চতুর্দিক সহজ শান্ত
হদৃয় কেন স্রোতসফেন
মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো
অচেনা,
কিছু চেনাও চিরতরে। 

শিশিরভেজা শুকনো খড়
শিশিরভেজা শুকনো খড় শিকড়বাকড় টানছে
মিছুবাড়ির জনলা দোর ভিতের দিকে টানছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে
ভাল ছিলুম জীর্ণ দিন আলোর ছিল তৃষ্ণা
শ্বেতবিধুর পাথর কুঁদে গড়েছিলুম কৃষ্ণা
নিরবয়ব মূর্তি তার, নদীর কোলে জলাপাহার
বনতলের মাটির ঘরে জাতক ধান ভানছে
শুভশাঁখের আওয়াজ মেলে জাতক ধান ভানছে
করুণাময় ঊষার কোলে জাতক ধান ভানছে
অপরিসীম দুঃখসুখ ফিরিয়েছিলো তার মুখ
প্রসারণের উদাসীনতা কোথাও ব'সে কাঁদছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে 

সীমান্ত প্রস্তাব - মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি নিবেদন
একটি ভিখারি ছেলে ভালোবেসে দেখেছিল ভাত
আর পরখ করেছিল
জ্যোত্স্নায় ছড়ানো ধানগাছগুলি, ধানের গোড়ায়
শুদ্ধ জলভরা মাখনের মতো
মাটির সাবলিলতার চিকণ-ফাঁপানো ধান,
ধানগুলি ভাত হতে পারে ?
নির্বাক দেবতা কথা বলতে পারে
লোহা গলতে পারে
কাঠের ভূভাগ পারে চিৎ হতে নারীদের মতো ?
তবু সে ভিখারি ছেলে ভালোবেসে দেখেছিল ভাত |
ভালোবেসে দেখেছিল বহুতর দর্শন জীবনে
জীবন ছেড়েও কতো গাঁজায় আক্রান্ত হয়ে কতো
জীবনেও ধান ছাড়া, নারী ছাড়া, জ্যোত্স্নাটুকু ছাড়া
ওপরে কি যেন আছে |
সবারই ওপরে আছেন ভগবান পান্থ-নির্যাতনে
সবারই ওপরে আছেন ভগবান পরিব্রজাতার
সবারই ওপরে আছেন ভগবান মানুষের হয়ে
ভিখারি ছেলেটিকে দুটি ভাত দেবার ব্যস্ততায়
বাসের মতো সমসাময়িক, বাসের চেয়েও মত্ত
পৌঁছে দিতে সৎ |

ভিখারির ভালো ছেলে ছাড়া ছিল বহু মন্দ ছেলে
তারা ভালোবাসা নিয়ে মাখামাখি করেনি কখনো
তারাও তো বেঁচে আছে তারাও তো আছে অনাবিল
আমলকির মতো কত ভলো ধরণের ফলই
পৃথিবীতে আছে
ভিখারির ভালো ছেলে মন্দ ছেলে ঝরে গেছে

স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি
মনে পড়ে স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি রাজপথ 'রে ক্রমাগত
সাইকেল ঘন্টির মতো চলে গেছে, পথিক সাবধান
শুধু স্বেচ্ছাচারী আমি, হাওয়া আর ভিক্ষুকের ঝুলি
যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা স্বাধীনতাপ্রিয়
'লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি।
তবু কোনো খর রৌদ্রে, পাটকিলে কাকের চেরা ঠোঁটে
তৃষ্ণার চেহারা দেখে কষ্ট পাই, বুঝে নিতে পারি
জলের অভাবে নয়, কোন টক লালার কান্নায়
তার মর্মছেঁড়া ডাক; কাক যেন তোমারই প্রতীক
রূপে নয়, বরং স্বভাবে - মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়
কোথায় বিমূঢ় হয়ে বসে আছো হাঁ-করা তৃষ্ণায়! 

 
চাবি
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?

থুতনিপরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাত্‍ লিখতে হলো ।

চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো -
লিখিও, উহা ফিরত্‍ চাহো কিনা?

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত্‍ চাহো কি না?

সরোজিনী বুঝেছিলো
দুপুরে আঁধার ঘর-মেঘে ঢাকা বিস্তৃত আকাশ
সরোজিনী চুরি করে নিয়ে যায় সাদা রাজহাঁস
হয়তো বা বৃষ্টি হবে, হয়তো বহিবে হাওয়া বেগে
মুখের অগ্নি কি তবে সরোজিনী ঢেকেছিলো মেঘে?
মাঠের উপরে সাদা হাঁসগুলি চরেছিলো একা
সরোজ ঘরেই ছিলো শুধু তার চোখ মেলে দেখা
এই সব হাঁসেদের বৃষ্টির সূচনা দেখে নেমে
জড়িয়ে গিয়েছে মেয়ে হাঁসে-ফাঁসে-কাপড়ের প্রেমে
শুধু চোখ মেলে দেখা, এই হাঁস স্পর্শ করা নয়
সরোজিনী বুঝেছিলো, শুধু তার বোঝেনি হৃদয়।

দাঁড়াও
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলায় মনে পড়ছে
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও অবং ভালোবেসে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

Thursday, November 21, 2013

চা-এর নাম চা কেন?

সেদিন এক বুদ্ধিজীবী কলেজ পড়ুয়ার সাথে দেখা। চে গেভেরার ছবি টিশার্টে। সদ্য 'শূন্য অঙ্ক' সিনেমাটা দেখেছি।
 
জানতে চাইলাম, এটা কার ছবি?
 
বলল - 'কুল ডুড, দিস ইস ছে। ছে গাভেরা'।
 
বললাম, তাই, উনি কোথাকার?
 
বলল, 'আই থিঙ্ক চায়না অর লাতিন অ্যামেরিকা'।
 
আমি বললাম উনি কিভাবে মারা গেছেন জানো?
 
হাসতে হাসতে বলল, 'হে হি ইজ অ্যালাইভ। লেনিন, মাও আর পাস্ট, বাট ছে ইজ ভেরি মাচ প্রেজেন্ট। হি ইজ হট।'
 
এতো তাড়াতাড়ি চে কুল থেকে হট হয়ে গেল দেখে, জানতে চাইনি সুনীলবাবুর লেখা পড়েছিল কিনা বা বলিভিয়ার জঙ্গলের কাহিনী জানে কিনা। ঐ বয়সে আমি জানতাম।
 
তাই এই নিয়ে লিখলাম, একটা রম্যরচনা। বিপ্লবী নামগুলোর পিণ্ডি চটকে।
 
 
+++++++++++++++++++++++
চা-এর নাম চা কেন?
+++++++++++++++++++++++
 
(এখানে সব চরিত্র কাল্পনিক। কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির সাথে কোনরূপ সাদৃশ্য একান্ত অনভিপ্রেত। কারো ভাবাবেগে আঘাত লাগলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।)
 
আচ্ছা 'চা'-এর নাম চা হল কেন? এটার না হয় সন্ধি না খোঁজা যায় বুৎপত্তি।
 
উৎপত্তি কোথায় জানতে চাইলে একজন বলল এটা চে-এর নামে নাম করা হয়েছে। চে গেভারা স্পেন থেকে এসে চিন দেশে কি একটা মতবাদ প্রচার করতে এলেন, তখন এই পানীয়টা খেতেন।
 
আমাদের দেশে তখন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সাম্যবাদের জোয়ার। সেই জোয়ারে ভেসে এলেন মাও - ওনার কথা শুনে সবাই চুপ। শুধু একটা বেড়াল বললো ম্যাও। সেই থেকে পুঁজিবাদীদের তাড়া খেয়ে সর্বহারা আদিবাসীদের সাথে ম্যাওরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।
 
পরের ভরা কোটালে এলেন লেনিন, যে রাস্তা দিয়ে এলেন সেই রাস্তার নাম হয়ে গেল লেনিন 'সরনি'।. মানে লেনিন ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়েছিলেন, সবাই পিছন থেকে হর্ন দিলেও একটুও সরে জায়গা দিতে পারেন নি। তাই সবাই ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিল 'লেনিন তুমি সরনি, মনে থাকবে'।. তাই হয়েছে, আমরা মনে রাখবো বলে সেই জায়গার নাম করেছি লেনিন সরণী।
 
আস্তে আস্তে অনেকে এলেন। যেমন হো চি মিন, ভিয়েতনাম থেকে কোলকাতা এখনো ডাইরেক্ট ফ্লাইট নেই বলে, সেই চিন দেশ ঘুরে। এতো লম্বা পথ, তাই আমরা চিন দেশের থেকে পাওয়া একটা লম্বাটে খাবারের নাম রেখে দিলাম ওনার নামে। তাই সেটার নাম হল – চাউমিন।
 
এবারে এলেন চে গেভারা। আমাদের তেলেভাজা খাওয়া জিভের ডগায় পড়ে ওনার নাম হয়ে গেল – চে গুয়েভারা বা চে গু-এ ভরা। এমা ছিঃ কি গন্ধ, মানে দুর্গন্ধ। উনি যে পানীয়টা খেতেন সেটাও কেমন যেন কেমন একটা খড়ধোয়া জলের মতো রং – মানে ঐ যে অনেকক্ষণ জল না খেয়ে টয়লেট গেলে যা উৎপন্ন হয় বা কমোডে অল্প জল ফ্লাশ করলে। তাই আমরা কল্লাম কি, সেই পানীয়র সাথে দুধ চিনি মিশিয়ে দিলাম। বেশ একটা কাদা কাদা রং এলো – মানে রঙের খোলতাই হল।
 
এবার নাম নিয়ে গবেষণা শুরু হল। 'গুয়েভারা' নাম তো আর দেওয়া যায় না - তাই শুধু চে। অনেকে বল্লেন চে বললে সেই গুয়েভারা মনে পড়েই যাবে আর তাছাড়া চে-এর নাম থাকলে পুঁজিবাদীরা পান করবে কি করে! তাই নাম পরিবর্তন করে রাখা হল – চা। সেই থেকে বঙ্গদেশে চা-এর প্রচলন হল।
 
তবে এই লেখা পড়ে যাদের চা খেতে কেমন কেমন লাগবে, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমি সাধারণতঃ চিনি ও দুধ ছাড়া চা-ই পান করি খড়ধোয়া জলের মতো সোনালী রং। তবে দুধ দেওয়া চিনি ছাড়া, আনমোল মারী সহ বা ছাড়া, সবুজ চা, জুঁই চা, থেকে শুরু করে সব ধরনের চা, এমনকি চিন দেশে চা বাগানে গিয়ে স্বচ্ছ কাঁচের কাপে বাগান থেকে সদ্য তোলা চা-এর পাতা গরম জলে ডুবিয়ে সেবন করেছি। সে এক অদ্ভুত স্বাদ। আর যারা বিরিয়ানি (সেই যেটা বিড়ি আনতে গিয়ে নিচেটা একটু ধরে গিয়ে আবিষ্কার হয়) খেয়ে ঠাণ্ডা পানীয় খান, তাদের বলবো তার বদলে চা পান করুন, খাদ্যনালী পরিষ্কার থাকবে আর স্নেহ পদার্থ আপনার শরীর জমে থেকে আপনার অকাল অসুস্থতা ডেকে আনবে না।  
 
 

Wednesday, November 20, 2013

বাবার ফেসবুক

বাবার ফেসবুক
=======
 
এটা "লেখালেখি" এবং "Jokes কৌতুক" গ্রুপ নিয়ে একটা লেখালেখি। আমার বাবা পশ্চিমবঙ্গ অর্থ দপ্তরের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী - দপ্তরের নাম রেজিস্ট্রেশান বা নিবন্ধিকরণ। বাবা ছিলেন অবরনিবন্ধক - মুল কাজ জমিজমা কেনাবেচা থেকে বিবাহ নথিভুক্ত করা। সাব রেজিস্ট্রোর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ডি আই জি হিসেবে অবসর নেন ২০০৮ সালে। বাবার কর্মজীবন নিয়ে এতো কথা বলার কারন - বাবা হলেন সেই ব্যক্তি জার অধীনে পাইলট প্রোজেক্ট হিসেবে প্রথম হুগলীর কিছু রেজিস্ট্রী অফিসের কম্পিউটার সিস্টেম চালু হয়। এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব অফিসেই কম্পিউটারে নথিভুক্তিকরণ হয়।
 
কিন্তু, বাবার নিজের কম্পিউটারের দক্ষতা ছিল অনেকটা আমার ক্রিকেট মাঠের মতো। মানে ঐ যে বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়া, কিভাবে বলটা খেলতে হবে, কেন যে শচিন লুজ বলে আউট হল থেকে কাকে দলে নেওয়া উচিত সব বলে দিতে পারি, কিন্তু ঐ মাঠে নেমে খেলতে বলবেন না, প্লিজ। বাবার হল সেই অবস্থা। পিছনে দাঁড়িয়ে যখন দেখতে বলি সব বুঝে যায়, তারপর ঘুমোতে গিয়ে সব ভুলে যায়। চেষ্টা করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খায় আর আমায় ফোন করে এমন এমন প্রশ্ন করে যে আমি ঘাবড়ে যাই।
 
কয়েক বছর আগে আমার গাব্দামতন কম্পিউটার বিক্রি করে একটা মোটামুটি নতুন কম্পিউটার আর প্রিন্টার কেনা হয়েছিলো, বাবা অবসর নেবার পর কম্পিউটার শিখবেন বলে। একদিন শুনলাম ওয়ার্ডে সেভ করা যাচ্ছে না। আমি বললাম ফাইল মেনুতে গিয়ে সেভ-এ ক্লিক করতে। বাবা ওয়ার্ড বন্ধ করে এক্সপ্লোরার-এর একটা ফাইলে গিয়ে রাইট ক্লিক করে বললেন কোন সেভ অপশন নেই। কম্পিউটার খারাপ হয়ে গেছে। যাইহোক তবু মাঝে কিছুদিন কম্পিউটার রপ্ত করলেন, মানে টুকটাক চিঠিপত্র টাইপ আর প্রিন্ট নেওয়া। মাঝে মাঝে অতি সঞ্চয়ী স্বভাবের জন্যে বেশ কিছুদিন প্রিন্ট না নেওয়ায় প্রিন্টার খারাপ হয়ে যেত। বাবাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন।
 
একপাতা টাইপ করে দুপিস প্রিন্ট নেবার বদলে, ১৫ মিনিট হেঁটে কোন কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে তাদের দিয়ে একটা টাইপ করিয়ে, আবার ১০ মিনিট হেঁটে একটা জেরক্স সেন্টার থেকে এক কপি জেরক্স করে আনা বাবার অনেক সহজ মনে হতো। আস্তে আস্তে কম্পিউটারের উপর ধুলোর আস্তরণ পুরু হতে লাগলো। আমি গেলে কখনো খুলতাম আর আমার মেয়ে বা ভাগ্নি গেলে গেমস খেলত। বাবা কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন, আর আমি বাবাকে কম্পিউটার শেখানোর প্রতি।
 
মনে মনে বাবার ডঙ্গেল লাগিয়ে ইন্টারনেট করার উপর এতো বেশী অনাস্থা ছিল যে ঐ পথেই হাঁটি নি। এবারে পুজোর কিছু আগে দেখলাম পাড়ায় কেবল ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপন পড়েছে। দরদাম করে বাড়ীতে লাগিয়ে ফেললাম। এটা জেনেই যে এরা যা বলে তার অনেকটাই আদপে দেয় না। বাবার একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিলাম আর দু-তিনদিন ধরে ধরেবেঁধে ট্রেনিং দিলাম। মাঝে মাঝে বাবার সব গুলিয়ে যায়, আর আমার মেজাজ হারিয়ে যায়। দূর তোমার হবে না বলে উঠে যাই। মাঝে মাঝে আবার বসি, বাবা বলে দূর এসব হবে না, বরং দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে আমার বেশী আগ্রহ। মা বলেন তোর বাবার ধৈর্য নেই। আমি বলি আমার মেয়েকে শেখালে শিখে যেত এতদিনে।
 
তবু এই ধাক্কা, চেষ্টা আর ইচ্ছে অনিচ্ছের মধ্যে দোলা খেতে খেতে বাবা একটু আধটু শিখে নিলেন কিভাবে ইন্টারনেট আর ফেসবুক খুলতে হবে। কখনো বিকেলে ঘুম থেকে উঠে, কখনো বা সকালে একটু ফাঁক পেলে বসে পড়েন ইন্টারনেট নিয়ে। তাতে আমি মনে মনে রোমাঞ্চিত হতাম এই ভেবে - এই তো হচ্ছে, হবে হবে। আবার মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম। বাবার ফোন - শোন ফেসবুকটা কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি বলি হারায় নি, ঠিক আছে, তুমি ভুল জায়গায় গেছ। বাবা অসহিষ্ণু হয়ে বলেন এইতো কম্পিউটার খুলেছি, ইন্টারনেট চালু আছে, এখানে শুধু গুগুল বলে দেখাচ্ছে। আমি বুঝলাম কি হয়েছে, বললাম অ্যাড্রেসে লেখ facebook.com। বাবা ঠিক আছে দেখছি বলে গুগুলের সার্চে টাইপ করলেন facebook.com।
 
একটু পরে আবার ফোন ফেসবুক খুলছে না। আমি বিরক্ত হয়ে বলি এতদিনেও বুঝলে না গুগুলের সার্চ কোনটা আর অ্যাড্রেস কোনটা। বাবা বললেন - কোনটা বল দেখি? রাগও হয়, মায়াও লাগে - আহা চেষ্টা করছে, পারছে না কি করবে। আবার বোঝাতে শুরু করি একদম উপরে দেখো কি লেখা আছে? বাবার উত্তর - কালোর উপর লেখা এ এস ইউ এস। আমি ঘাবড়ে গেলাম, কালো! এ এস ইউ এস! তারপর বুঝলাম বাবার চোখ গেছে আক্ষরিক অর্থেই মনিটরের একদম উপরের দিকে - যেখানে কালোর উপর লেখা আছে কোম্পানির নাম - আসুস। উফ পারা যায় না, ফোনেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো চীৎকার করতে করতে বোঝালাম মনিটর আর কম্পিউটার-এর ডিসপ্লে কাকে বলে।
 
এবারে আর আগের মতো বাবা ধৈর্য হারিয়ে ফোন কেটে দিতেন না বা রাগ করতেন না। মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী পাশ থেকে এসব শুনে হাসতে হাসতে বলতো, দেখো তবু তো এই বয়সে শেখার চেষ্টা করছে, আমার বাবার তো এসব আগ্রহ নেই, তাই শিখেও উঠতে পারলো না। আমার স্ত্রীর একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম বছর তিনেক আগে। এর মধ্যে যত মাস পেরিয়েছে, ততবারও ফেসবুক খুলে বসার আগ্রহ দেখায় নি। বললে বলে, কতো কাজ, মেয়ের পিছনে দৌড়ানো ইত্যাদি। আমি রেগে বলি আরে ইচ্ছে নেই সেটা বল, এসব অজুহাত দিও না।
 
আস্তে আস্তে বাবার নেশা শুরু হল। মুলতঃ "Jokes কৌতুক" বলে একটি গ্রুপ আর এই "লেখালেখি" গ্রুপের লেখা পড়া, একটু আধটু মন্তব্য করা। মাঝে মাঝে নিজের দেওয়ালে ঢুকে গুলিয়ে ফেলত মেন ফেসবুকে কি করে ফিরে আসবেন। আমি বললাম উপরের বামদিকে ফেসবুক লোগোতে ক্লিক করো। বাবা অবধারিত ভাবে উপড়ের ট্যাবে ক্লিক করে হয়তো সেটাকে ক্লোজ করে দিলেন। একদিন দেখলাম একজনের লেখার নিচে কমেন্ট করতে, কিন্তু কমেন্টের সাথে পোস্টের কোন মিল নেই। পড়ে বুঝলাম একটা পোষ্টে কমেন্ট করতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু তার নিচে যেহেতু কারও কমেন্ট নেই, ছোট্ট কমেন্ট বাটনটা খুঁজে না পেয়ে, পরের পোষ্টে যার নিচে কিছু কমেন্ট আছে সেখানে কমেন্ট করে বসলেন।
 
একদিন আমি একটা উইন্ডচিটার পড়া কুকুরের ছবি পোষ্ট করলাম "Jokes কৌতুক" গ্রুপে। নিচে দেখলাম বাবার একটা অদ্ভুত কমেন্ট। মনে হচ্ছে যেন একটা গল্পের মাঝের বা শেষের অংশ। পড়ে খোঁজাখুঁজি করে আর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম, একটা কৌতুক গল্প লিখতে লিখতে মাঝামাঝি এসে ভুল করে পোষ্ট হয়ে গেছে। বাবা খুঁজে না পেয়ে আর কোথায় মাউস ক্লিক হয়েছে না দেখে আমার ছবিটার তলায় বাকিতা লিখে দিয়েছেন। একদিন দেখি গ্যাস নিয়ে নিজের একটা প্রশ্ন স্ট্যাটাসে লেখার বদলে "লেখালেখি" গ্রুপে পোষ্ট করে দিয়েছেন আর একটা ছোট গল্প "লেখালেখি"-তে না লিখে নিজের দেওয়ালে লিখে পোষ্ট করেছেন।
 
কোলকাতায় থাকলে রাতে শোবার সময় আমি ফেসবুক খুলে ভালো কোন লেখা বা গল্প বা কৌতুক থাকলে পড়ে শোনাই আমার স্ত্রীকে। আমার মেয়েও নাক গলায়। একদিন বাবার একটা কৌতুক পড়ছি, পড়তে গিয়ে বুঝলাম সেটাও মাঝপথে পোষ্ট হয়ে গেছে আর বাবা হয় অন্য কোথাও বাকিটা লিখেছেন বা কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু জোকসের মজা পুরোমাত্রায় পেলাম একজনের কমেন্ট দেখে। তিনি লিখেছেন - "ও দাদা আপনি এমন হঠাৎ হঠাৎ থেমে যান কেন বলুন তো?" শুনে আমার স্ত্রী-কন্যার কি হাসি, এটাই সব থেকে ভালো জোকস বলে।
 
বাবা এখন পুরো মাত্রায় ফেসবুক চালিয়ে যাচ্ছেন। আগে বিকেলে একটা ঘুরতে যেতেন, ঠাণ্ডাও লাগতো এখন ফেসবুক নিয়ে বসেন। আমার মেয়ের লেখায় কমেন্ট না করলে মেয়ের রাগ হয় - দাদু কিছু বলেনি? আবার কোন পোষ্টে কমেন্টে শুনল দাদু লিখেছে - 'পাজি দুষ্টুটার এসবে বেশ মন'।. শুনেই আমার ফোন নিয়ে দাদুকে ফোন করে একটু ঝাড় দিল। আমরা রাতের দিকে বাবার কমেন্ট বা কৌতুক পড়ে মজা নি। মাঝে মাঝে বাবার লেখা কিছু কাহিনী পড়ে নতুন কিছু জানতে পারি। আমার স্ত্রী অধিকাংশ সময় এসবের শ্রোতা। কোন পোষ্ট পড়ে আমি বলি এটা ঠিক জমেনি। আমার স্ত্রী বলে কেন খারাপ নয়। আস্তে আস্তে ভালোই তো হচ্ছে।
 
কিছুদিন আগে একটা আড্ডায় "লেখালেখি"-র এক মাথা বললেন ওনার লেখা মধ্যে বানান ভুল প্রায় হয় না। তবে হয়তো লিখতে গেলেন 'আমি ভাত খেলাম'; বাংলা কীবোর্ডের দয়ায় হয়ে গেল 'আমই ভাট খেলাম'। তবে গল্প হলেও সত্যি এসব শুরু মাত্র এক মাস আগে। কে বলে চেষ্টা করলে ফল পাওয়া যায় না। তবে পরিশেষে ধন্যবাদ "Jokes কৌতুক" এবং "লেখালেখি" গ্রুপের সকলকে। আপনাদের লেখা পড়ার আগ্রহেই বাবার এই ফেসবুক শেখা।