Tuesday, August 13, 2013


২০১২- আবার তোতা কাহিনী
শঙ্খকর ভৌমিক


- ১ - এক ছিল জাতি। তাহারা ছিল আঁতেল। তাহারা বড় বেশি প্রশ্ন করিত, চক্ষু মুদিয়া থাকিত না। কাগজ পড়িত, টেলিভিশনে ও ইন্টারনেটে দেশবিদেশের সুলুকসন্ধান লইত, জানিত না চামচাগিরি কাহাকে বলে।


রানী বলিলেন, "এমন জনগণ তো ভোটাব্যাঙ্কের কাজে আসে না, অথচ রাজারহাটে, সেক্টর ফাইভে বসিয়া ফেসবুক করে, আর কার্টুন আঁকিয়া মাওবাদের প্রসার ঘটায়।"

মন্ত্রীদের ডাকিয়া বলিলেন, "ইহাদের শিক্ষা দাও।"

- ২ -
বিদ্বজ্জনদের উপর ভার পড়িল জাতিটাকে শিক্ষা দিবার।

শিল্পী, অভিনেতা ও শিক্ষাবিদেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই, উক্ত জনগোষ্ঠীর ত্যাঁদড়পনার কারণ কি?

সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য কম্পিউটারে জনগন যে তথ্য জানিতে পারে তাহা সুবুদ্ধির উদ্রেক করে না। তাই সকলের আগে দরকার ইন্টারনেট ব্লক করিয়া দেওয়া।

পন্ডিতেরা বিভিন্ন কমিটিতে সদস্যপদ পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন।

- ৩ -
পেয়াদা বসিল ব্যঙ্গচিত্রশিল্পীদের শায়েস্তা করিতে। এক দুর্বিনীত অধ্যাপকের শাস্তিটা হইল এমন আশ্চর্য্ যে, দেখিয়া দেশবিদেশের লোক চমকাইয়া উঠিল। কেহ বলে, “শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ।” কেহ বলে, “শিক্ষা যদি নাও হয়, খবরের কাগজে নাম তো ছাপিল। মাস্টারের কী কপাল!”

পেয়াদা বোঝাই করিয়া বকশিশ পাইল। খুশি হইয়া সে তখনই পাড়ি দিল বাড়ির দিকে।

পণ্ডিত বসিলেন জনগনকে বিদ্যা শিখাইতে। নস্য লইয়া বলিলেন, “থার্ড ডিগ্রীর কর্ম নয়।”

রানী তখন তাঁহার প্রিয় কাগজের সম্পাদককে তলব করিলেন। তাঁহার লোকেরা সম্পাদকীয় লিখিয়া এবং সম্পাদকীয়ের সম্পাদকীয় লিখিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল। ্যে দেখিল সেই বলিল, "সাবাস। পরিবর্তন আর ধরে না।"

সাংবাদিকের দল পারিতোষিক লইল বলদ বোঝাই করিয়া। তখনই ঘরের দিকে দৌড় দিল। তাদের সংসারে আর টানাটানি রহিল না।

অনেক সাধের সরকারটার জন্যে বিদূষকদের খবরদারির সীমা নাই। সাংবাদিক সম্মেলন, জনসভা ও মিটিং মিছিল তো লাগিয়াই আছে। তার পরে ১০০% কাজের হিসাব দেখিয়া অনেকেই বলিল, “উন্নয়ন হইতেছে।”

লোক লাগিল বিস্তর এবং তাদের উপর নজর রাখিবার জন্য লোক লাগিল আরও বিস্তর। তারা মাস-মাস মুঠা-মুঠা তনখা পাইয়া সিন্ধুক বোঝাই করিল।

রানীর ভাইপো খুশি হইয়া বোটনিক্যাল গার্ডেনে বেড়ু করিতে চলিল ও গার্ডেনের দারওয়ানকে বলিল "জানতা নেহি, হাম কৌন হ্যায়?"

- ৪ -
সংসারে অন্য অভাব অনেক আছে, কেবল নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলিল, "উন্নয়ন হইতেছে, কিন্তু মানুষগুলার খবর কেহ রাখে না।”

কথাটা রানীর কানে গেল। তিনি বিদূষকদের ডাকিয়া বলিলেন, “অনঙ্গ, অর্জুন, এ কী কথা শুনি।”

বিদূষকেরা বলিল, “মহারানী, সত্য কথা যদি শুনিবেন তবে ডাকুন বিদ্বজ্জনদের, পণ্ডিতদের, লিপিকরদের, ডাকুন যারা উন্নয়ন করে এবং উন্নয়ন তদারক করিয়া বেড়ায়। নিন্দুকগুলো ফেসবুকে লগ ইন করিতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে।”

জবাব শুনিয়া রানী অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখনি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া বিদূষকদের একশোতে একশো নম্বর দেওয়া হইল।

- ৫ -
উন্নয়ন কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রানীর ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। এদিকে, একদিন তাই পাত্র মিত্র অমাত্য লইয়া তিনি যখন সিংহাসনে বসিয়া আছেন তখন শ্লীলতাহানির অভিযোগ লইয়া এক রমণী আসিয়া উপস্থিত।

দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘণ্টা ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া তুরী ভেরী দামামা কাঁসি বাঁশি কাঁসর খোল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প। নগর কোটাল গলা ছাড়িয়া টুপি নাড়িয়া, সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিলেন।

কোটাল বলিলেন, “মহারাণী, কাণ্ডটা দেখিতেছেনে? এ সবই চক্রান্ত। ”

রাণী বলিলেন, “আশ্চর্য। সাহস কম নয়।”

মন্ত্রী বলিলেন, "শুনিয়াছি উক্ত রমণী স্বামী পরিত্যক্তা।”

রানী খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই ভাঙ্গা আম্বাস্যাডারে উঠিবেন এমন সময়, গোয়েন্দা প্রধান বলিয়া উঠিলেন, “মহারাণী, তদন্ত করিয়া দেখিয়াছেন কি?”

শুধু বলিলেনই না, অপরাধীকে ধরিয়াও ফেলিলেন।

এবারে রাণী গাড়িতে চড়িবার সময় বলিয়া দিলেন, গোয়েন্দাপ্রধানকে যেন বদলি করিয়া দেওয়া হয়।

- ৬ -
দেশের জনগন দিনে দিনে ভদ্র-দস্তুর-মতো আধমরা হইয়া আসিল। অভিভাবকেরা বুঝিল, বেশ আশাজনক। তবু স্বভাবদোষে মাঝে মাঝে সমালোচনা করে। এমন কি, এক-একদিন দেখা যায়, সে তার রোগা হাত দিয়া ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেটের চেষ্টায় আছে।

কোতোয়াল বলিল, “এ কী বেয়াদবি!”

তখন ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন লইয়া টি ভি চ্যানেল আসিয়া হাজির। কী দমাদ্দম প্রশ্নোত্তর! রাণীর চক্ষু রক্তবর্ণ হইল, তিনি সভা হইতে দ্রুত প্রস্থান করিলেন।

রাণী মুখ হাঁড়ি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “এ রাজ্যে ছাত্রছাত্রীরা কেবল যে প্রশ্ন করে তা নয়, উহারা মাওবাদীও বটে।”

তখন পণ্ডিতেরা এক হাতে কলম, এক হাতে বন্দুক লইয়া এমনি কাণ্ড করিল যাকে বলে শিক্ষা।

কোতোয়ালের হুঁশিয়ারি দেখিয়া রাণী তাকে শিরোপা দিলেন।

- ৭ -
জনগণ ক্ষেপিয়া উঠিল। কোন্‌কালে যে, কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, “জনতা ক্ষেপিয়াছে।”

মন্ত্রীকে ডাকিয়া রাণী বলিলেন, “মন্ত্রী, এ কী কথা শুনি।”

ভাগিনা বলিল, “মহারাণী, রাজ্যবাসীর শিক্ষা পুরা হইয়াছে।”

রাণী শুধাইলেন, “উহারা কি আর ফেসবুক করে?”

ভাগিনা বলিল, “আরে রাম! ”

“আর কি প্রশ্ন করে?”

“না।”

“আর কি মাওবাদীর মত কথা বলে?”

“না।”

“১০০% কাজের ফিরিস্তি শুনিলে কি অবিশ্বাস করে?”

“না।”

রাণী বলিলেন, “একবার উহাদের ডাকো তো, দেখি।”

বিদূষক জনগনকে ডাকিলেন। জনগণ বলিল "আসিব না।"

বিদূষক, মন্ত্রী, কোতোয়াল, ভাইপো, বিদ্বজ্জন- সকলেই বুঝিলেন, সুখের দিন অবিলম্বে শেষ হইতে চলিয়াছে।

শুধু রাণী বুঝিলেন না।

May 19, 2012 

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.