Tuesday, December 25, 2012

আ মরি বাংলা ভাষা ২ নং ... A mori bangla bhasa #2

আজকে আমার নিজের জেলা বর্ধমান। একটু ভাষা আর একটা মন খারাপ করা কাহিনি।
 
সেটা ১৯৮৩ সাল। আমার তখন ৭ বছর। মঙ্গলকোটে সদ্য বদলি হয়ে এসেছি। বাবা এসেই অফিসের দায়িত্ব বুঝে নিতে গেছেন। নতুন কোয়ার্টারে এসে কিছুদিন লাগত ঘরের মালপত্র ঠিকঠাক করতে। তখনো ছিলো তোলা উনুন। তখনকার কাজের মাসির বেশ গরিব ছিল তবে খুব বেশি হলে ২-৩ টে বাড়ির কাজ করতো, সময় নিয়ে। এখনকার মতো ১০-১৫ মিনিটের ঝড় তুলে বেরিয়ে যেত না।  প্রথম দিন কাজের মাসি এগিয়ে এলো উনুন ধরিয়ে দেবার জন্যে যাতে মা একটু অন্য কাজে সময় পায়। কেরোসিন দিয়ে ঘুঁটে জ্বেলে তার সাহায্যে কয়লার উনুন জ্বালানো ছিলো একটা বেশ ঝকমারি কাজ, যেটা মা, মাসিরা খুব সহজেই করতেন।
 
আমি আর আমার বোন তখন নতুন কোয়ার্টারের সব জায়গা দেখে নিতে ব্যস্ত। কিছু পরে সব ঠিকঠাক করে কাজের মাসি আমাকে বললো, "বাবু টানাকাঠি হবে"? আমি শুধালাম - "টানাকাঠি কি জিনিস মাসি"?
 
মাসি হেসে বললো "তাও জানো না। ওই যে একটা রঙিন বাকসোর মধ্যে অনেকগুলো কাঠি থাকে। বাকসের গায়ে ঘষলে জ্বলে উঠে। মাকে বোলো ঠিক জানে।" আমি ভাবলাম বাঃ বেশ মজার জিনিস তো। নিশ্চয় কোনো দারুন আতসবাজি হবে। তখন এত আতসবাজি বাজারে পাওয়া যেত না, আমরা কালিপূজার আগে বাড়িতে তুবড়ি তৈরী করতাম। দারুন মজা হত। আমি এটাও জানলাম এক বাক্সের দাম ৫ পয়সা। কিন্তূ আমি জানিনা এটা মানা যায় না। আমি জানি না আর মা জানবে এমন কোনো আতসবাজি হয় নাকি।
 
তাই মায়ের কাছে দরকারটা না বলে ১০ পয়সা চেয়ে এনে দিলাম আর বললাম "তোমাকে মা দুই বাক্স টানাকাঠি এনে দিতে বলেছে।" মাসি অবাক হলেও টীনাকাঠি আনতে চলে গেল। এখনকার মত তখন ২ মিনিট গেলেই দোকান পাওয়া যেত না। বেশ কিছু পরে যখন টানাকাঠি এনে হাজির তখন মায়ের মুখোমুখি। কথা শুনে বুঝলাম "টানাকাঠি" হলো দেশলাই কাঠি। শুধুশুধু কাজের দেরী করিয়ে দেওয়ার জন্যে মায়ের কাছে বেশ বকুনি খেলাম।
..................
..................
..................
মঙ্গলকোট ছিল অজয় নদ আর কোণার নদীর সংযোগস্থলে। পল্লীকবি কুমূদরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি। যিনি লিখেছিলেন "বাড়ি আমার ভাঙ্গন ধরা অজয় নদীর বাঁকে।" আমরা ওখানে ছিলাম ৩ বছর। বর্ষাকালে নদী ভরলেই ভয় হত। কোয়ার্টারের বারান্দা থেকে দেখতাম আস্তে আস্তে নদীর জল কিভাবে রাস্তা পেরিয়ে, বাঁধ ভেঙ্গে চলে আসছে গোটা শহরে। চারিদিকে তখন "জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিফল অবস্থা।"
 
আমাদের কোয়ার্টারটা জলের মাঝে আর কিছু বাড়ির মত একটা দ্বীপের মতো জেগে থাকত। সরকারী অফিস বলে আশেপাশের গ্রামের লোক মালপত্র, গরু, ছাগল নিয়ে এসে হাজির হত। বাবা পিওন আর নাইটগার্ডদের সাথে নিয়ে অফিসের ফাইলগুলো দোতলার ঘরে নিয়ে এসে নিচের অফিস আর দোতলার একটা ঘর খুলে দিত। তাতেও হত না, লোকজন ত্রিপল নিয়ে ছাদেও উঠে যেত। ২-৩ দিন বন্যার জল থাকত। মা সাধ্যমতো হাতে তৈরি রুটি, মুড়ি, গুড় আর ছোলাভাজা সাপ্লাই দিত।
 
এই রকম একদিনে, দুপুর বেলায় কাজের মাসি আমাদের বাড়িতে কাজ করছে, হঠাত বান এলো। মাসি আটকে পড়ল। বাড়ি যেতে পারছে না, কিন্তূ বাড়ির দিকেই মন। আমরা খাব, তাই বাবা বললো মাসিকেও কিছু খেয়ে নিতে। খেতে দিতে মাসি বলে উঠলো "এখানে তো আছি দাছি খাছি বাবু, বাড়িতে কি হছে দেছে বুঝতে লারছি।"
 
জল নামতে মাসি বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারপর আর আসে নি। পরে জেনেছিলাম মাসির এক ছেলে আর এক মেয়ে স্কুলে ছিল। কিন্তূ তৃতীয়জন তখন তিন বছরের সে ঘরে ছিল, মাসির বর কাছেই একটা দোকানে গিয়েছিল। ঢেউ কমতেই বাড়ি পৌছে গেলেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
 
ব্যর্থ আশা বুকে নিয়ে, মাসি বাড়ি গিয়ে কোলের মেয়েটিকে খুঁজতে খুঁজতে যেখানে কোণার এসে মিশেছে অজয়ের সাথে সেখানে চলে গিয়েছিল। হঠাত একটা পাড় ভেঙ্গে পরে। গ্রামের লোকেরা শব্দ শুনেছিল, কিন্তূ ওখানে পৌছে কাউকে দেখতে পায় নি। শুধু মা আর মেয়েকে গ্রাস করে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে অজয়ের খরস্রোত।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.