Monday, February 6, 2017

অসিক্কিত (সংগৃহিত)


ভেরি স্যাড.........। কখন ঘটলো?... খুব দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন বোস বাবু। বোস বাবু এই "শুভ-নীড় " আবাসনের এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট। খবরটা পেয়ে সকালে সুবিমলের ফ্ল্যাটে এসেছেন।
-- এই রাত ১২ টা নাগাদ...। দুজনে ঘুমিয়ে ছিলাম...... হঠাৎ বললো, বুকে ব্যথা। এম্বুলেন্সে ফোন করলাম... গাড়িটা আসতে এতো দেরী করলো......নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ...। স্ত্রী অপর্ণার মৃত দেহের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন বৃদ্ধ সুবিমল। সুবিমল আগে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এখন রিটায়ার্ড। প্রায় ১০ বছর হলো পুরানো বাড়ি ছেড়ে স্ত্রী অপর্ণা কে নিয়ে এই "শুভ-নীড়" এ বসবাস শুরু করেছেন। আগে একটি পুরানো বাড়িতে থাকতেন একমাত্র পুত্র শুভজিৎ কে নিয়ে। শুভজিৎ চাকরি পেয়ে আমেরিকায় সেটলড হবার পর থেকেই একাকীত্ব কাটাতে স্ত্রী কে নিয়ে চলে আসেন এই "শুভ-নীড় " এ। নামটা ছেলের সঙ্গে মিল থাকায় অপর্ণার পছন্দেই এখানে ফ্ল্যাট নেওয়া।
--কই পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি অথচ কিছু বুঝতে পারিনি তো ! বললেন বোস বাবু। পাশ থেকে মিসেস বোস কনুই এর খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আরে ঐ যে রাতে যখন চেঁচামেচি হচ্ছিল.... তোমাকে বললাম না ? তুমি তো টিভিতে তোমার শেয়ার মার্কেটের চ্যানেলে ডুবে ছিলে!
একে একে আশপাশের ফ্ল্যাট থেকেও কয়েকজন এসেছেন সমবেদনা জানাতে। সকলের একই জিজ্ঞাসা.. শুভ কখন আসছে? সুবিমল পাশের ঘরে গিয়ে শুভকে ফোন করলেন, রাতেও একবার করেছিলেন..।
--হ্যাঁ...শুভ...তুই তাহলে কখন...
--বাপি, এখানে অনেক কাজ পেন্ডিং ; সবকিছু গুছিয়ে যেতে যেতে দিন পাঁচেক লাগবে ! তুমি এক কাজ করো, মাকে.......
ফোন টা কেটে দিলেন সুবিমল। মনে পড়ে গেল পুরানো দিনের কথা...ছেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে না খাওয়া পর্যন্ত অপর্ণা দুপুরের খাবার মুখে তুলতো না, ছেলে রাত জেগে পড়াশোনা করলে মা ও জেগে বসে থাকতো ছেলের বায়নায়...। অপর্ণার জোরাজুরিতেই গ্রামের ভিটে মাটি সব বেচে দিয়েছিলেন যাতে শুভ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ! বছর দুয়েক আগে একবার শুভ এখানে এসেছিল স্ত্রী-পুত্র কে সঙ্গে নিয়ে.... পুরানো বাড়িটা বিক্রির ব্যাপার ফাইনাল করতে......।
শুভ কী বললো স্যার?..... অজিতের প্রশ্নে সুবিমল চকিতে ফিরে এলেন স্মৃতির পাতা থেকে...। অজিত "শুভ-নীড়" এর পাশেই রাস্তার ধারে একটা চা এর দোকান চালান। রাতে রুটিও বিক্রি করেন। সকালের চা আর রাতের রুটি টা সুবিমলের ফ্ল্যাটে এসে নিজে রোজ দিয়ে যান, যাতে বৃদ্ধ- বৃদ্ধার অসুবিধা না হয়। মাঝে মাঝেই বলতেন... বাবা আম্রিকা.....!! ছেলেকে মানুষ করেছেন বটে.... আম্রিকায় চাকরি পাওয়া মুকের কথা...!! ... আমরা অসিক্কিতই থেকে গেলুম...। স্যার যদি আমাদের ও একটু সিক্কে দিতেন তাইলে আর এই চা বেচতে হতো নি......
--শুভর এখন আসার সময় নেই রে অজিত, অনেক কাজ তো...! আর কারো জন্য অপেক্ষা করবো না.....চোয়াল শক্ত করে বললেন সুবিমল।

তা হলে আমি আসি সুবিমল দা...আমার আবার আজ অফিসের ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে... বললেন বোস বাবু। আমাকেও আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, জোনাল ম্যানেজার আসবেন...
রিভিউ রিপোর্ট প্রেজেন্টেশন আছে.... বললেন উপরের ফ্ল্যাট 3B এর মি. দাস...। একে একে সবাই বিদায় নিলেন। ঘরের মধ্যে সুবিমল, অজিত আর অপর্নার শায়িত নিষ্প্রাণ দেহ.....। অজিত নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন.... স্যার কিচ্ছু চিন্তা করবেন নে। আমরাই শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করতেছি.....
কিছুক্ষণ পর অজিত ৮-১০ জনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। কেউ মুদিখানার দোকান চালান, তো কারো জামা কাপড় ইস্ত্রির দোকান ৷ সকলেই তাদের দোকানপাট বন্ধ করে এসেছেন.... সঙ্গে দেহ সৎকারের সমস্ত উপকরণ .......
********
গনগনে চুল্লির মধ্যে অপর্ণার দেহটা ঢুকে গেছে...। একটা কোনে চুপ করে বসে চুল্লির দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন সুবিমল। অপর্ণার কি খুব কষ্ট হচ্ছে.... না কি বৃদ্ধ বয়সে সন্তান কে ছেড়ে থাকার একাকীত্বর যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আনন্দ.......? চোখের কোন থেকে জলের ধারা নেমে আসে সুবিমলের, চশমাটা ঝাপসা হয়ে যায়......।
দূর থেকে সুবিমলের চোখের জল দেখে কাছে আসে অজিতI স্যার নিজেকে শক্ত করুন...সবাই কেই তো একদিন যেতে হবে...! আমরা তো আছি...আর কী বলবো... আমাদের মতো অসিক্কিত দের কি আর অতো জ্ঞানগম্যি আছে.....?
এবার বাঁধ ভাঙলো সুবিমলের৷ অজিত কে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলেন..... । কাঁদতে কাঁদতে বললেন... ভাগ্যিস তোরা "শিক্ষিত" হসনি...! তোদের মতো "অশিক্ষিত " রা না থাকলে সমাজ টা তো থমকে যেত রে....!!
https://www.facebook.com/pproy76/posts/10212263813457469

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.