১. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা -সূর্য সিদ্ধান্ত
বৈদিক যুগে, আজ থেকে প্রায় দেড়হাজার বছরেরও আগে, চতুর্থ শতাব্দীতে এক বা একাধিক অজ্ঞাত হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানী 'সূর্য সিদ্ধান্ত' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কথিত বইটি রচনা করেন আর্যভট্ট, বরাহমিহির, মহাভিরা, ব্রহ্মগুপ্তর মতো বেশ কিছু ভারতীয় হিন্দু, যারা ছিলেন গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূতত্ববিদ ও জ্যোতিষী। এই বইটিতে আদিম জ্যোতির্বিদ্যা তত্ত্ব, নীতি ও প্রাচীন হিন্দু পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টির আদিপুরুষ ব্রহ্মার স্তুতি গেয়ে, রচিত এই কাব্যে উল্লিখিত যে ক্রেতা যুগের শেষপর্বে মায়াসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে সূর্যদেব তাকে এই রহস্যময়, সর্বোচ্চ, বিশুদ্ধ ও সমুচ্চ বিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞানদান করেন। গ্রন্থটির চোদ্দটি অধ্যায়ে গ্রহের গড় গতি ও প্রকৃত স্থানসমূহ; দিক, স্থান ও সময়ের পরিমাপ; চন্দ্রগ্রহণ; সূর্যগ্রহণ; গ্রহণের অভিক্ষেপ; গ্রহনক্ষত্রের সংযোগ, উদয় ও অস্ত; চন্দ্রের উদয় ও অস্ত; সূর্য ও চাঁদের নির্দিষ্ট বিষুবলম্ব দৃষ্টিকোন; সৃষ্টিতত্ব; ভূগোল এবং সৃষ্টির মাত্রা ইত্যাদি বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।
যদিও এর প্রায় তিনশ বছর আগে আলেক্সান্ড্রিয়ার গ্রীক রোমান লেখক টলেমি আল্মাগেস্ট নামে জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত এক মহান গ্রন্থ রচনা করেন যিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, কবি, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ ও জ্যোতিষী। এরও আগের আটশ বছরে ব্যাবিলনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ঘটনা গণনার জন্য পাটীগণিত এবং হিপ্পার্চুস সহ অনান্য গ্রীক বা সমসাময়িক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক গতিপ্রকৃতি গণনার জন্য জ্যামিতির সৃষ্টি করেন। তবু বলা যায় সূর্য সিদ্ধান্ত প্রাচীন ভারতের কিছু হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানীর মৌলিক গবেষনার ফসল। ভাবতে অবাক লাগলেও অনেকাংশেই সূর্য সিদ্ধান্তের গণনা আধুনিক কালের গণনার সঙ্গে প্রায় মিলে গেছে। যেমন সূর্য সিদ্ধান্তের হিসেবে সূর্যের আপন কক্ষপথে একবার পরিক্রমণ করতে সময় লাগে, ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ১২ মিনিট ৩৬.৬ সেকেন্ড; টলেমির হিসেবে এই সময় হলো ৩৬৫ দিন ৩৬ ঘন্টা ৯ মিনিট ৪৮.৬ সেকেন্ড এবং আধুনিককালে দেখা গেছে সঠিক সময় হলো ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট ১০.৮ সেকেন্ড।
সূর্য সিদ্ধান্তে অনেক গ্রহনক্ষত্রের ব্যাস নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন সূর্য সিদ্ধান্তে বুধ ও শনির ব্যাস যথাক্রমে ৩,০০৮ মাইল ও ৭৩,৮৮২ মাইল। আধুনিককালে দেখা গেছে এই দুটি গ্রহের সঠিক ব্যাস যথাক্রমে ৩,০৩২ মাইল ও ৭৩,৫৮০ মাইল, অর্থাৎ শতকরা মাত্র একভাগের তফাৎ। তবে আবার কিছু হিসেব সঠিক হিসেবের সাথে মেলে না। যেমন শুক্র ও বৃহস্পতির ব্যাস নির্ণয় করা হয়েছিলো যথাক্রমে ৪,০১১ ও ৪১,৬২৪ মাইল। সঠিক হিসেব যথাক্রমে ৭,৫২৩ ও ৮৮,৭৪৮ মাইল, অর্থাৎ শতকরা প্রায় পঞ্চাশভাগের তারতম্য। পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয় করা হয়েছিলো ১৬০০ যোজন, এক যোজন পাঁচ মাইলের হিসেবে ৮,০০০ মাইল। সঠিক হিসেব ৭৯২৬.৩৩৫২ মাইলের সঙ্গে শতকরা একভাগেরও কম তফাৎ।
আরো অনেক গাণিতিক হিসেবের মধ্যে 'পাই'-এর মান ধরা হয়েছিলো দশের বর্গমূল, মানে ৩.১৬২২৯। অষ্টাদশ শতকে 'পাই'-এর সঠিক মান নির্ণয় হয় ২২/৭ = ৩.১৪২৮৫৭, মানে মাত্র ০.৬% তফাৎ। আধুনিক ত্রিকোণমিতি মূল নিহিত সূর্য সিদ্ধান্তের মধ্যে। সর্বপ্রথম সাইন (জ্যা), কোসাইন (কজ্যা) ও ইনভার্স সাইন (অৎক্রম জ্যা)-এর উল্ল্যেখ পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। এছাড়াও এখানে ট্যানজেন্ট আর সেকান্টের প্রথম প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো পঞ্জিকা তৈরী করার সময় সূর্য সিদ্ধান্তের মতে গণনা করা হয়।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.