Wednesday, August 14, 2013

৪. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা - বাংলা ব্যাঙ্ক

. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা - বাংলা ব্যাঙ্ক

 

পুরনো ডাইরেক্টরী অনুসারে বানানটি ব্যাঙ্ক নয় 'বেঙ্ক' আমার অগ্রজ কুয়েতপ্রবাসী সন্তোষ কুমার সিনহা মহাশয় কিছুদিন আগে আমাকে একটা অন্তর্জালের হদিশ দেন, যেখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য নথি ও বইয়ের সন্ধান পাই। জীবনে প্রথমবার খুব মনযোগ দিয়ে যেটা পড়ে ফেলি সেটা ১৮৭৪ সালের একটা বাংলা পঞ্জিকা ও ডাইরেক্টরী। এটি পড়তে গিয়ে অনেক না জানা তথ্য জানতে পারি। ১৮৭৪ সালের পটভুমিকায় যেসব ব্যাঙ্ক কলকাতায় অবস্থিত ছিল, তাদের একটা পরিচয় নিচে দেওয়া হল।

 

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সরকারী বানিজ্যিক ব্যাঙ্ক চালু হয়েছিল কলকাতা শহরে ১৮০৬ সালের দোসরা জুন। নং ষ্ট্যান্ড রোডে এই ব্যাঙ্কটির তখন নাম ছিল "ব্যাঙ্ক অফ কলকাতা" মূল উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল ওয়েলেসলিকে টিপু সুলতান মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার পুঁজি যোগান দেওয়া। ১৮০৯ সালে নাম পালটে হয় "ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল" বা বেঙ্ক বাঙ্গাল। ১৮৪৬ সালে চালু হওয়া ঢাকা বেঙ্কের একত্রিকরণ হয় বাঙ্গাল বেঙ্কের সঙ্গে ১৮৬২ সালে।

 

১৮৪০ ১৮৪৩ সালে চালু হয় যথাক্রমে বোম্বাই বেঙ্ক মাদ্রাজ বেঙ্ক। এই তিনটি ব্যাঙ্ক ছিল তখন বোম্বাই, মাদ্রাজ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সরকারী বেঙ্ক এবং ব্রিটিশ রাজের সনদের বলে যৌথভাবে লন্ডনের শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত ছিল। ১৮৬১ সালে চালু হওয়া "কাগজের মুদ্রা আইন" পেপার কারেন্সী অ্যাক্ট অনুসারে এই তিনটি ব্যাঙ্ক ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কারেন্সি নোট বা কাগজের মুদ্রার ব্যবস্থাপনা সঞ্চালন করত। এই অধিকার একচেটিয়াভাবে এই তিনটি ব্যাঙ্কেরই ছিল ১৯৩৫ সালে রিসার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া চালু হবার আগে পর্যন্ত্য।

 

১৮৭৪ সালে কলকাতা (অধুনা কোলকাতা) প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বাঙ্গাল বেঙ্কের শাখা ছিল অমৃতসর, আগরা (আগ্রা), আকায়াব (অধুনা উত্তর মায়ানমারের সিত্ত্বে), এলাহাবাদ, ওয়ার্দা (ওয়ার্ধা), কারপুর (মধ্যপ্রদেশ), চট্টগ্রাম, জব্বলপুর, ঢাকা, দিল্লী, নাগপুর, পাটনা, বারাণসী, বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই), মজার্ফারপুর (অধুনা মুজাফ্ফরপুর), মৃজাপুর (অধুনা মির্জাপুর), মোলনিন, রেঙ্গুন (অধুনা দক্ষিন মায়ানমারের ইয়াঙ্গন), লক্ষণৌ, লাহোর, সেরাজগঞ্জ হাইদ্রাবাদ।

 

১৯২১ সালে বোম্বাই ও মাদ্রাজ ব্যাঙ্কের সাথে জুড়ে গিয়ে বাঙ্গাল বেঙ্কের নাম হয় "ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া"। কোনদিন দেউলিয়া না হওয়া ব্যাঙ্কটি আমরা অনেকেই চিনি ১৯৫৫ সাল থেকে হওয়া নতুন নাম "স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া" নামে।

৩. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা - সময় অঞ্চল (Time Zone)

. ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা - সময় অঞ্চল (Time Zone)

 

প্রাচীন নথিপত্রে ভারতবর্ষের মানক সময় ঠিক হতো সূর্য সিদ্ধান্ত মতে। এই হিসেবে শূন্য দ্রাঘিমাংশের রেখা কল্পনা করা হয় অবন্তী রোহিতাকার মধ্যে দিয়ে। অবন্তী (২৩°১০৫৮উঃ, ৭৫°৪৬৩৮পূঃ) হলো অধুনা উজ্জয়নী এবং রোহিতাকা (২৮°৫৪উঃ, ৭৬°৩৮পূঃ) হলো অধুনা রোহতাক। সূর্য সিদ্ধান্তে উজ্জয়নীর মানক সময় থেকে স্থানীয় সময় নির্ণয় করার পদ্ধতি বলা হলেও, তার ব্যবহার জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যেই সীমিত ছিলো। বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা সুবিধেমতো নিজেদের স্থানীয় সময় ঠিক করে নিতেন। যেমন ১৭৩৩ সালে জয়পুরে মহারাজা সোঁয়াই মান সিংহের তৈরী যন্তর মন্তর সঠিকভাবে স্থানীয় সময় নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হত।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম মানমন্দির তৈরী করে চেন্নাই বা তৎকালীন মাদ্রাজে, কারণ মাদ্রাজ ছিলো অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রায় মধ্যরেখায় অবস্থিত। উল্লেখ করা যেতে পারে তৎকালীন কেন্দ্র মাদ্রাজের দ্রাঘিমাংশ ৮০°১৭' আর অধুনা কেন্দ্র এলাহাবাদের নিকটস্থ মির্জাপুরের দ্রাঘিমাংশ হলো ৮২°৩০'  ১৮০২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম জ্যোতির্বিদ জন গোল্ডিংহ্যাম মাদ্রাজ মানক সময় চালু করেন। এটি ছিলো গ্রিনউইচ মান সময়ের থেকে ঘন্টা ২১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড আগে ছিলো। সেই অর্থে বলা যায় মাদ্রাজ সময় ( ইউটিসি + :২১) মাত্র প্রায় মিনিট তফাতে, স্বাধীন ভারতের মানক সময়ের সবথেকে নিকটতম অগ্রদূত ছিলো।

 

পরে যখন ইংরেজ শাসিত ভারতে কলকাতা বোম্বে নামে দুটি সময় অঞ্চল (টাইম জোন) চালু হয়, তখন ভারতীয় রেল মধ্যবর্তী সময় অঞ্চল হিসেবে মাদ্রাজ মানক সময় মেনেই সময়সূচী তৈরী করতো। তাই অনেকসময় মাদ্রাজ মানক সময়কে বলা হয় ভারতীয় রেলের মানক সময় প্রায় ৮২ বছর মাদ্রাজ মানক সময় ছিলো, ভারতের মানক সময়। তখন মাদ্রাজ মানমন্দিরের ঘড়ির সাথে একটা বন্দুক এমনভাবে জোড়া ছিলো যে, ঠিক রাত টার একটা বন্দুকের ঘোড়াটিতে টান পড়তো। এই গুলির আওয়াজ জানান দিতো যে সারাদিন মানক সময়ের সবকিছু ঠিকঠাক চলেছে। ১৮৯৯ সালে কোদাইকানালে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্র চালু হয়। এটি একটি সৌর পদার্থবিদ্যা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো। এই সময় থেকে মাদ্রাজ মানমন্দিরের সমস্ত কাজকর্ম কোদাইকানালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

১৮৮৪ সালে প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধের জন্যে দুটি ভারতের দুটি সময় অঞ্চল তৈরী হয়। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মেরিডিয়ান কনফারেন্স সময় ঠিক হয় একটি কলকাতা (এখন কোলকাতা), অপরটি বোম্বে (এখন মুম্বাই) কলকাতার সময় ঠিক হয় ৯০° পূর্ব দ্রাঘিমাংশের উপর ভিত্তি করে (আসলে ৮৮°২২') এবং বোম্বের সময় ঠিক হয় ৭৫° পূর্ব দ্রাঘিমাংশের উপর ভিত্তি করে (আসলে ৭২°৫৪') সেইমত কলকাতা সময় (ইউটিসি + :৫৩:২০ বা ইউটিসি + :৫৪) ভারতীয় মানক সময়ের (ইউটিসি + :৩০) থেকে চব্বিশ মিনিট আগে, বোম্বে সময়ের (ইউটিসি + :৫১) থেকে এক ঘন্টা এবং তিন মিনিট আগে এবং রেলের মানক সময় বা মাদ্রাজ সময় (ইউটিসি + :২১) থেকে ৩২ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগে ছিলো। 

 

১৮৭৪ সালের পঞ্জিকা ডাইরেক্টরীতে দেখা যায় রেলের সময় উল্লেখ করা হয়েছে "রেলওয়ে কোম্পানির গাড়ি গমনাগমনের নিয়মিত সময়, কলিকাতার টাইম হইতে ৩৩ মিনিট কম" তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতার সময় সারা ভারতবর্ষেই বহুল ব্যবহৃত সময় ছিলো। অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংবাদ সম্প্রচার হতো কলকাতা সময় অনুসারেই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জ্যোতির্বিদ্যা এবং ভূতাত্ত্বিক ঘটনার নথিতেও এই সময়ই মেনে চলা হতো। ব্রিটিশ অধিকারীকরাও সচরাচর এই সময়কেই মেনে চলতেন। ১৯০৬ সালে ভারতীয় প্রমাণ সময় (আইএসটি) গৃহীত হবার পরেও প্রায় ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত্য কলকাতা সময় চালু ছিলো।

 

বোম্বে সময়ও (ইউটিসি + :৫১) চালু হয় ১৮৮৪ সাল থেকে। ১৯০৬ সালে ভারতীয় মানক সময় চালু হওয়ার সময় স্বাধীনতা সংগ্রামী বাল গঙ্গাধর তিলকের একটি বোমা বিস্ফোরণের মামলায় বিচার চলছিলো। সরকারের বিরুদ্ধে জনমতের সুযোগ নিয়ে বিশিষ্ট ব্যারিস্টার ফেরোজশাহ মেহতা জোর করে সময় অঞ্চল পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সওয়াল করেন। সরকারও জনমতকে নিজেদের দিকে আনতে ব্যর্থ হয়ে এই ব্যাপারে হল ছেড়ে দেয়। এর ফলে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত্য  বোম্বে সময় চালু ছিলো।

 

এছাড়াও উনিশ শতকের শুরুর দিকে পোর্ট ব্লেয়ার গড় সময় চালু হয় বঙ্গোপসাগরে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্যে। ৯২°৪৩'৩৩.'' পূর্ব দ্রাঘিমাংশের উপর ভিত্তি করে এই সময় ছিলো সবথেকে আগে (ইউটিসি + :১১)  কলকাতা সময়ের থেকেও ১৭ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড আগে। তবে ১৯০৬ সালে থেকে ভারতীয় মানক সময় চালু হলে পোর্ট ব্লেয়ার গড় সময় লোপ পায়।

 

ভারতীয় মানক সময় (আইএসটি) চালু হয় ১৯০৬ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে। এটি উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের কাছেই অবস্থিত মির্জাপুরের একটি ঘড়ি টাওয়ার অনুসারে ৮২°৩৪'৪৮'' দ্রাঘিমাংশের ভিত্তিতে গণনা করা হয়, যাতে হিসেবের সুবিধের জন্যে এটি গ্রিনউইচ মান সময়ের সাথে ঠিক সাড়ে পাঁচ ঘন্টা আগে থাকে (ইউটিসি + :৩০) কোদাইকানাল থেকে মানমন্দির চলে আসে মির্জাপুরে। স্বাধীনতার পর প্রায় তিন বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) সহ সমগ্র পাকিস্তানেই ভারতীয় মোন সময় মেনে চলা হতো। ১৯৫১ সালের পর পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ অন্য সময় অঞ্চল মেনে চললেও ভারতীয় মানক সময় ভারত শ্রীলঙ্কার সর্বত্র মেনে চলা হয়।

 

সামরিক বিমান চালনা সময় আইএসটিকে বলা হয় * ("ইকো ষ্টার") ১৯০৬ সালেও কলকাতা ভারতের রাজধানী হওয়ার সুবাদে IANA Time Zone Database- ভারতীয় মানক সময় হলো এশিয়া/কলকাতা। অল ইন্ডিয়া রেডিও বা দূরদর্শনের মাধ্যমে সংবাদ সম্প্রচারের আগে ভারতীয় মানক সময় প্রচার করার রীতি আজও চালু আছে। ভারতে দিবালোক সংরক্ষণ সময় (ডিএসটি) বা কোনো ঋতু অনুসারে সময় সমন্বয় করা হয়না।  যদিও অসামরিক ক্ষেত্রে শক্তি খরচ কমানোর জন্যে ভারতে সংক্ষিপ্তভাবে তিনবার ডে লাইট সেভিং বা দিবালোক সংরক্ষণ সময় চালু হয়। এই তিনটি সময় হলো ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ ১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ।