Friday, April 26, 2013

১২. ভুখা হরতাল

 

-১২. ভুখা হরতাল 

 

প্রথম বছরের অনেক টুকরো টুকরো ঘটনা বাদ গেলো, যেগুলোর কথা পরের কোনো এক অধ্যায়ে থাকবে। এতদিন ধরে সবকটা হোস্টেলে প্রথমবর্ষ, দ্বিতীয়বর্ষ এবং কিছু তৃতীয়বর্ষের ছাত্র থাকতো। আর সবকটা হলে চতুর্থবর্ষ এবং বাকি তৃতীয়বর্ষের ছাত্র। ছাত্রীদের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। সবাই তখন পান্ডিয়াতে। প্রথম বছরের শেষে কলেজ কর্তৃপক্ষ একটা নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। ডিরেক্টর ছিলেন দৌর্দণ্ড্যপ্রতাপ ডঃ বিমল সেন। বি ই কলেজেরই পুরোনো ছাত্র, আমার দেখা সব থেকে জাঁদরেল ডিরেক্টর, যাঁকে আমরা সবাই একটু ভয়ে ভক্তি করতাম। প্রয়াত ডঃ বিমল সেন ছিলেন বি ই কলেজ ডিমড ইউনিভার্সিটির প্রথম ডাইরেক্টর।

 

আমাদের প্রথমবর্ষের সময় হোস্টেল ১৬-তে Ragging-এর একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে। এক মুরগিকে সিনিয়ররা Rag করার সময় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে। সেই ফার্স্ট ইয়ারকে চোখে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে কার্নিশের উপর দিয়ে হাঁটানো হয়। সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং হসপিটালে ভর্তি করতে হয়। পরিনামে তার বাড়ির লোক তাকে বাড়ি নিয়ে যায় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের নামে পুলিশে নালিশ করে। এসব ঘটনা কোথা থেকে তখন খবরের কাগজে প্রকাশ হয়ে যায়। সেই নিয়ে হইচই হবার পর বিমল সেন তদন্ত কমিটি তৈরি করেন বিভিন্ন অধ্যাপক এবং কিছু শিক্ষা দপ্তরের লোকজন নিয়ে। সেই কমিটি প্রস্তাব দেয় যে ১৯৯৪ সাল থেকে নতুন ছেলেরা ১৪, ১৫ আর ১৬ নং হোস্টেলে থাকবে। আর আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে মুচিপাড়ার হোস্টেলগুলোতে। সেবার সাহেবপাড়ার তৃতীয় বর্ষের সবাইকে হলে যাবার অনুমোদন বা নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে নাকি Ragging হবে না আর নতুনরা বেশী মন দিয়ে পড়াশুনো করতে পারবে। ভাবটা এমন যেন আমাদের যা বারোটা বাজার বেজে গেছে, নতুন ছেলেরা যেন দারুন তৈরি হয়।

 

যাইহোক আমরা যথারীতি এই প্রস্তাব মানলাম না, আওয়াজ তুললাম "কর্তৃপক্ষ জবাব দাও"কিন্তূ কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দিলো না। মুখ্যভূমিকায় আমরা মানে সাহেবপাড়ার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। আমাদের মনটা হু হু করছে। তার দুটো কারণ ছিল, একটা হলো নিজেদের হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হবে। তার থেকেও যেটা বেশী দুঃখের সেটা হলো আমরাই শেষ ব্যাচ যারা Ragged হলাম আর প্রথম ব্যাচ যারা জমিয়ে Ragging করতে পারব না। মনের মধ্যে কতো স্বপ্ন ছিলো কিভাবে নতুন মুরগীদের সাথে আলাপ করবো। শেষ দুঃখটা সমস্ত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের। কেমন যেন বোকা বনে গেলাম ভাব। আমাদের যেন পুরোপুরি বলাৎকার হয়ে গেলো। যাঃ শালা। 

 

যা মনে পরে আমাদের প্রায় ১২৮ জন সদ্য দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রকে আদেশ দেওয়া হয় অবিলম্বে ১৪, ১৫, ১৬ খালি করে মুচিপাড়ার হোস্টেলে চলে যেতে। কিন্তূ আমাদের কেউ সেই আদেশ মানিনি। দুয়েকজন কিন্তূ কিন্তূ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্ট ছিলো ততদিনে নিজেদের হয়ে ওঠা হোস্টেলেই থেকে যাবার। আন্দোলন শুরু হলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ আর ডিরেক্টর মানে ডিরুর নামে স্লোগানে কেঁপে উঠলো কলেজ চত্তর। ডিরুর নিপাত যাবার কামনা করে অনেক পোস্টার পড়লো ফার্স্ট লবি, ইনস্টিটিউট হল আর বকুলতলা জুড়ে। কিন্তূ বিমল সেন কোনোরকম আলাপ আলোচনায় বসতে আগ্রহী ছিলেন না বা বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে চাইছিলেন। সাহেবপাড়ার তৃতীয়বর্ষের ছাত্রদেরও কয়েকজন চলেও গিয়েছিলো নতুন হলে, কিন্তূ অনেকেই একটা আশায় বুক বেঁধে হোস্টেলেই রয়ে গিয়েছিলো আমাদের সাথে।

 

দ্বিতীয়বর্ষ মানে আমাদের সবার অবিভাগীয় বিষয়গুলো শেষ হয়ে নিজস্ব ডিপার্টমেন্টের বিষয়গুলো শুরু হতো। বেগতিক দেখে বিমল সেন সমস্ত বিভাগীয় প্রধানকে নির্দেশ সব সাহেবপাড়ার দ্বিতীয়বর্ষের ছেলেদের ডেকে বোঝাতে বা বোঝানোর নাম করে একটু ধমকাতে বা চমকাতে। সিভিলের প্রধান তখন ডঃ সুমন দাশগুপ্ত (এস ডি জি)। তিনি ছিলেন সৌম্যদর্শন অমায়িক ভদ্রলোক। আমাদের নিজের ঘরে ডেকে বোঝালেন যে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না মানলে বড় কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে আর আমরা তাড়াতাড়ি অন্য হোস্টেলে চলে গেলে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু করা যাবে। মানে খুব বাস্তবসন্মত অভিমত, কিন্তূ ছাত্রদের আবেগে সেটা খুব একটা দাগ কাটতে পারল না। ইলেকট্রিকালের প্রধান জ্যাকি মানে ডঃ জে কে সেন, সেই বিভাগের ছেলেদের ডেকে হুমকি দিলেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে সবাই নতুন হোস্টেলে চলে না গেলে ডিপার্টমেন্ট থেকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। সব ডিপার্টমেন্টেই এক অবস্থা। এই চাপের মুখে পরে স্বার্থসন্ধানী বা জীবনে উন্নতিলাভে আগ্রহী কিছু ছাত্র বা আমরা যাদের গাঁতু মাল বলতাম তাদের কয়েকজন সেই রাত্রে নতুন হোস্টেলে চলে গেল, যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম।

 

এরফলে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে ধমক চমক আরো বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো বিভাগীয় প্রধান তো ছেলেদের ডেকে উদুম তোর করেন এবং ভয় দেখান যে আমরা যারা হোস্টেল ছাড়িনি তারা কোনদিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোতে পারবো না বা কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দিশেহারা ছাত্রদের অনুরোধে এবং স্টুডেন্ট সেন্টিমেন্টের স্বার্থে ছাত্র ইউনিয়ন এগিয়ে আসে আমাদের সমর্থনে। তখন ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলো চতুর্থবর্ষ  মেকানিকালের ড্যাড মানে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। বেকসু (BECSU) থেকে তিনটে হোস্টেলেই প্রচারাভিযান করা হয় এবং বলা হয় এটা শুধু আমাদের ১২৮ জনের নয় এটা কলেজের সব ছাত্রছাত্রীর অহং-এর প্রশ্ন, এটা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আন্দোলন। কোনো ভয় নেই সবাই আমাদের সাথে আছে।

 

আমাদের বুকে বল এলো। এই পরিস্থিতিতে হলে বা নতুন হোস্টেলে চলে যাওয়া মুষ্টিমেয় জনগণ আবার নিজের নিজের পুরোনো হোস্টেলে ফিরে এলো - আত্মমর্যাদা অক্ষত রাখতে আর জনগনের কাছে আওয়াজ খেয়ে। তখন ডিরেক্টরের একটা বিজ্ঞপ্তি এলো যাতে বলা হলো, যারা স্থানপরিবর্তন করেনি তাদের সাস্পেন্ড করা হবে। সঙ্গে সঙ্গে বেকসু এর আপত্তি করে চিঠি দিল যে ইউনিয়ন এর প্রতিবাদ করছে। এইভাবে অচলাবস্থা চললো কয়েকদিন। ক্লাস চলছে, যে যার মতো হোস্টেল থেকে ক্লাস করছে। সারা সপ্তাহের পর শুক্রবারে অনেকেই নিজের বাড়ি চলে গেল সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে।

 

আমাদের লাস্ট পিরিয়ড শেষ হতো বেলা চারটেয়। হঠাৎ সেই শুক্রবার সাড়ে ছ'টা নাগাদ বিমল সেনের অফিস থেকে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি হলো যাতে বলা হলো যারা নতুন হোস্টেলে যায়নি তাদের কলেজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড করা হলো। একসাথে ১২৮ জন সাস্পেণ্ড, মাথায় বাজ পড়ল। মোবাইল, ইন্টারনেট না থাকলেও নিজেদের উদ্বেগে প্রায় সবাই কারো না কারো কাছ থেকে জেনে গেলো এই চরম দুসংবাদ। বাড়িমুখো ছেলের দল পড়িমড়ি করে ফিরে এলো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

 

ততক্ষণে বেকসুর ঘরে মিটিং শুরু হয়ে গেছে। বাম আমলে গুটিকয় কলেজের মধ্যে বি ই কলেজেরও স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ছিলো কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন "ছাত্র পরিষদের" (সিপি) হাতে। বেকসুতে সে বছর ২১টি আসনের সবগুলোতেই ছাত্র পরিষদের প্রতিনিধি। যার মধ্যে ১৮ টি শ্রেণী প্রতিনিধি বা ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ আর ৩টে সাধারণ পদ - সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং কোষাধক্ষ। এছাড়া মূল বিরোধী ছিল বামপন্থী বা মূলতঃ সিপিএমের ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এসএফআই)। আর ছিলো টিমটিম করে বিজেপির অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এভিবিপি), সিপিএমএলের অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন (এআইএসএ) ইত্যাদি।

 

যদিও আমার ব্যক্তিগত ধারনা তখন যারা ছাত্র পরিষদ করতো তারা যতটা না কংগ্রেসপন্থী ছিলো তার থেকে বেশী ছিলো বামবিদ্বেষী। মানে সচরাচর যা হয় যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের একটা বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী বা ভাবাবেগ কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আবেগ থেকেও অনেকে ছাত্র পরিষদ করতো। সেরকম অনেকে "ছাত্র পরিষদ" করা কারো ওপর ব্যক্তিগত রাগের বশেও এস এফ আই করতো। তবে অনেকেই আবার মন দিয়ে কোনো দলের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে ছাত্ররাজনীতি করতো।

 

আমার মতো অনেকেই ছিলাম তথাকথিত অরাজনৈতিক, মানে সার্বজনীন সমালোচক। Ragging পিরিয়ডে সিনিয়ারের চাপে এক দল, রুমমেটের আব্দারে অন্য দল আবার ক্লাসে বন্ধুদের পাল্লায় পরে তৃতীয় কোনো দলে ভিড়ে যেতাম। আমি যেমন ১৫ নং হোস্টেলের সিনিয়র মিদ্দ্যার দাবিতে এভিবিপির হয়ে কিছু পোস্টার লিখে দিতাম - Ragging থেকে নিস্তার পাবার জন্যে। কিন্তূ পরে কখনো সিভিলের নীলাঞ্জনের হয়ে সিপির প্রচারে যেতাম আবার রুমমেট সৌমিকের হয়ে যেতাম এসএফআই-এর প্রচারে। আমদের কাছে সিপি ছিল "ছিপি"; এসএফআই ছিলো "এসে-ফ্রাই" আর এআইএসএ ছিলো "আইস্যা"।

 

যাইহোক ফিরে আসা যাক পরের ঘটনায়। রাত ন'টা নাগাদ স্থির হয় হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করা হবে ফার্স্ট লবিতে। সেইমতো দশ'টা থেকে ড্যাডের নেতৃত্বে শুরু হলো হাঙ্গার স্ট্রাইক মানে ভুখা আন্দোলন। ফার্স্ট লবিতে সার বেঁধে রিলে পদ্ধতিতে চললো অনশন-ধর্মঘট। কেউ কেউ আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্যে অনশন করলো। শনি রবিবার জনগণ কম থাকলেও রবিবার রাত থেকে ফার্স্ট লবিতে ভিড় বাড়তে থাকে। সবাই এসে জড়ো হয় বকুলতলার আশেপাশে, ক্যান্টিনে আর ফার্স্ট লবিতে। প্রথমদিকে ব্যাপারটা পুরোপুরি অরাজনৈতিক ছিলো। দলাদলি ভুলে সবাই একসাথেই ছিলো এক দাবিতে যে এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করতেই হবে। যতদুর মনে পরে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনশনে বসে ১৭ জন আর তারসাথে প্রায় ৪০ জন শুরু করে রিলে পদ্ধতিতে। কিছুজনকে রাখা হয় অনশনের বাইরে, প্রধানত প্রশাসনিক বা অন্যান্য কাজের জন্য। আমি ছিলাম অক্ষম বা বিকলাঙ্গদের দলে। সদ্য জন্ডিস থেকে উঠেছি বলে হাঙ্গার স্ট্রাইকে যোগ দেবার অধিকার ছিলো না।

 

পরে দেখা যায় রিলে সিস্টেমটা খোরাক হয়ে গেছে। কেউ প্রাতরাশ সেরে এসে অনশন করছে মধ্যাহ্নভোজ পর্যন্ত্য; আর একজন মধ্যাহ্নভোজ সেরে এসে বসছে বিকেলের জলখাবার পর্যন্ত্য; এইভাবে কেউ বিকেলের টিফিন খেয়ে রাতের খাবার আগে পর্যন্ত্য বা কেউ ডিনার করে এসে পরদিন ভোরবেলা পর্যন্ত্য। তাই তিনদিনের মাথায় রিলে সিস্টেমে অনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনশনে বসা ১৭ জনের মধ্যে আস্তে আস্তে কয়েকজন প্রত্যাহার করে নেয় শরীর খারাপ হয়ে যাবার কারণে। এছাড়াও বাড়ি থেকে চাপ আসায় অনেকে অনশন প্রত্যাহার করে।

 

ক্লাস চালু ছিল, কিন্তূ অনেকেই ক্লাসে যেতাম না। ফার্স্ট লবিতে যোগ দিতাম অনশনরত বন্ধু বা সিনিয়ার দাদাদের সাথে। আড্ডা মারতাম, রাত বাড়লে একটু তাস খেলাও হতো। আর কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে সন্ধ্যের পর ফার্স্ট লবিতে সতরঞ্জির উপড় শুয়ে বসে নির্দ্বিধায় সুখটান দিতাম। সিগারেট আমাদের কাছে তখন বেশ দামি জিনিস। মানে শুধু স্বাস্থ্যের জন্য নয় পকেটের জন্যেও ক্ষতিকর। তাই আমরা বিড়ি টানতাম। একটা বিড়ি চার-পাঁচজন মিলে। আর একটা সিগারেট জুটলে তো কথাই নেই। আট দশজন ভাগ করে টান দিতাম। এমন হয়েছে কেউ হঠাত ফেলে দিয়েছে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটা সিগারেট, আগুন জ্বলতে জ্বলতে চলে এসেছে প্রায় ফিল্টারের কাছে, সেটাই তুলে নিয়ে দু-তিনজন একটান করে ফুঁকে নিলো।

 

তখন মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাগজে বি ই কলেজের খবর আর ছবি বের হচ্ছে। একদিন হঠাৎ আমার এক পিসতুতো দাদা এসে হাজির। তাড়াতাড়ি বিড়িটা লুকিয়ে পাশের জনের হাতে চালান করে উঠে এলাম। শুনলাম সেইদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে একটা কলেজের ছবি বেড়িয়েছে, তাতে দেখা গেছে আমিও নাকি 'অনশনে' বসে আছি। তখন খবর নেওয়ার উপায় বেশী না থাকায় বর্দ্ধমান থেকে দাদাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে ঘাড় ধরে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে। এরকম ঘটনা অনেকের সাথেই ঘটেছে। যাই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দাদাকে ফেরত পাঠানো হলো।

 

এই সময় হোস্টেল ১৪, ১৫ আর ১৬-র মেস সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক মনে নেই সেটা আমরা করেছিলাম না কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হয়েছিলো। তারপর অনেক হোস্টেল, হল এমনকি পান্ডিয়াতেও একবেলা করে মেস বন্ধ রাখা হতো এই আন্দোলনের সমর্থনে। এর মধ্যে হোস্টেল ১৪, ১৫ আর ১৬-তে  চালু হলো সমান্তরাল মেস সিস্টেম। একটা স্থানীয় ক্যাটারার বড় বড় গামলা করে খাবার নিয়ে আসতো আর মেস বন্ধ বলে দোতলার কমনরুমে পরিবেশন করতো। আমরা নিজেরাও হাত লাগাতাম পরিবেশন আর পরিষ্কারের কাজে।

 

এছাড়া এই সময় আরো বেশী করে আমাদের জীবনে দাগ কাটে শ্যামদার হোটেল। ফার্স্ট গেট থেকে ব্যাতাইতলার দিকে একটু এগিয়ে গেলেই একটা গোডাউন পড়তো আর একটা নয়নজুলি বা বড় নালা। তারপাশেই শ্যামদার হোটেল। তখন ছ'টাকায় নিরামিশ ভাত। নুন, লেবু, ভাত, ডাল, তরকারির সাথে ফাউ থাকতো পোস্ত দিয়ে আলুভাজা বা শুকনো লঙ্কা আর পিঁয়াজভাজা দিয়ে মাখা আলুভাতে - শ্যামদার ভাষায় 'স্মাসদ পটেটো'। সাতটাকায় ডিমভাত, আটটাকায় মাছভাত আর দশটাকায় দুপিস ছোটো ছোটো মুরগির টুকরো, একটা আলু আর অঢেল ঝোল। আমাদের অনশন আর মেস বন্ধ। শ্যামদার হোটেল রমরমিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে শ্যামদা বেশী লাভ হলে, আমাদের বোনাস দিত। বাঁধা খদ্দেরদের পাতে পড়ত ছোটো ছোটো একপিস করে বেগুনভাজা বা দু-তিনটে  মোরলা মাছভাজা। আহা, তখন কি অমৃত মনে হতো। 

 

চারটে টেবিল, এক একটায় চারজনের বসার কথা, কিন্তূ আমরা গাদাগাদি করে বসতাম ছ-সাতজন। পায়ের পাশ দিয়ে ইঁদুর আর টেবিল দিয়ে আরশোলারা পাশ কাটিয়ে পালাতো। মাঝে মাঝে পাশের মিষ্টির দোকান থেকে দেড়টাকা দিয়ে পঞ্চাশ গ্রাম দই কিনে নিয়ে এসে স্পেশাল লাঞ্চ বা ডিনার হতো। শ্যামদার সাথে থাকতো তার দুই ছেলে আর একটা হাবাগোবা পরিষ্কারের ছেলে। ২০১১ সালে একদিন কোলেজ যাবার পথেও দেখেছিলাম সেই আদি ও অকৃত্যিম শ্যামদাকে। পড়নে সেই অর্দ্ধেক গুটিয়ে পড়া মেটে কমলা রঙের লুঙ্গি আর হাতওলা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা শ্যামদার সেই এক পোষাক আর এক ভুমিকা। খুব শীত পড়লে স্যান্ডো গেঞ্জির উপড় একটা হাফ হাতা সোয়েটার। কদিন আগে ২০১৩-র এক এপ্রিল মাসে হঠাৎ হাজির হয়েছিলাম। সেই এক হোটেল, এক কাজ, শ্যামদা বেঁচে আছে শুনলাম কিন্তূ একটা স্ট্রোকের ধাক্কায় নিজের বাড়িতে শয্যাশায়ী। শ্যামদা শুধু বর্তমান - হোটেলের সাইনবোর্ডে।

 

………………………..

 

এভাবে দেখতে দেখতে অনশনের তিন চার দিন কেটে গেলো। বিমল সেন সকাল বিকেল আমাদের মধ্যে দিয়েই গটগট করে নিজের অফিসে ঢুকে যেতেন এবং কাজ শেষে বা মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে বেড়িয়ে যেতেন। আমাদের দিকে দৃষ্টিপাতও করতেন না। শুধু আমাদের হাসপাতালের ডাক্তার একবার করে এসে অনশনরত জনগণের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে যেতেন। ক্লাস খাতায় কলমে চালু থাকলেও আমরা খুব একটা যেতাম না। আর যারা অনশন করেছিল বা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলো তারা তো ২৪ ঘন্টাই লবিতে হাজির থাকতো।

 

তখন এতগুলো বাংলা নিউজ চ্যানেল ছিলো না। তবে খবরের কাগজগুলোতে এই নিয়ে খুব হইচই হয়। ধীরে ধীরে রাজনীতির খেলা শুরু হয়। শোনা গেল এসএফআই বলছে সিপি আন্দোলনটা ঠিক পথে চালাতে পারছে না কিন্তূ সব অধিকারটা নিজেদের হাতে রেখেছে, এতে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। আবার সিপির দিক থেকে শোনা গেলো এসএফআইকে আলিমুদ্দিন থেকে নির্দেশ দিয়েছে বলে ওরা আন্দোলন থেকে সরে যাচ্ছে আর এটাকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। তবে যাইহোক এসব চাপানউতর চললেও কোনো হাতাহাতি বা ওই জাতীয় নোংরামি হয় নি। আন্দোলন চলতে থাকে, আমরাও সবাই নিজেদের পুরোনো হোস্টেলেই থেকে যাই। আর এতোদিন পড়ে এসব রাজনৈতিক দাবী নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেও লাভ নেই।

 

এদিকে পুরনো ছাত্র, প্রাক্তন ডাইরেক্টর, বিদ্যুতমন্ত্রী এবং তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হবার সুবাদে শ্রীযুক্ত শংকর সেন এই ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়েন। শোনা কথা, উনি নাকি বিমল সেনের বিরুদ্ধগোষ্ঠীর ছিলেন এবং তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্ত জ্যোতি বসুকে প্রভাবিত করেন ছাত্রদের হয়ে, যাতে হোস্টেল বদলের নির্দেশ কার্যকরী না হয়। তখন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে একটা মিটিং হয়, যাতে সম্ভবত আমাদের কিছু সিনিয়র দাদা - ড্যাড, নির্ভীক সেনগুপ্ত, শুভময়, সঞ্জীব মণ্ডল আর দিব্যেন্দু এরা গিয়েছিলো। এটাও শোনা কথা ছাত্রদের সাথে মিটিং-এর পরেই অন্য একটা মিটিং-এ শ্রী জ্যোতি বসু নাকি বিমল সেনকে চাপ দিয়েছিলেন এই ব্যাপারটা নিয়ে জেদাজেদি না করতে আর যেমন হোস্টেল সিস্টেম ছিলো সেটাই রেখে দিতে। কিন্তূ বিমল সেন শেষ পর্যন্ত্য নাকি জ্যোতি বসুকে বোঝাতে সক্ষম হন যে ছাত্রদের চাপে নতিস্বীকার না করে, আন্দোলনের ফাটল ধরানোর একটা শেষ চেষ্টা করা উচিত।

 

সেইমত অনশনের সপ্তমদিনে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মিটিং আর সাংবাদিক সম্মেলনের পর ডিরেক্টরের অফিস থেকে একটা বিজ্ঞপ্তিজারী হয় যাতে বলা হয় অবিলম্বে নতুন হোস্টেলে চলে না গেলে ১২৮ জন ছাত্রকেই বহিষ্কার করা হবে। স্বভাবতই এই বিজ্ঞপ্তি ছাত্রদের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে আসে। এছাড়াও কিছু বিরুদ্ধ মানসিকতার জনগন প্রচার করে এই আন্দোলন করে কোনো লাভ নেই। দ্রুত ফাটল ধরে আন্দোলনের আবেগে এবং আমাদের মনোবলে। আমরা সেই ১২৮-জনের প্রায় সবাই খুব ভয় পেয়ে যাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

 

বেকসুর জরুরী বৈঠক শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত্য অনশন চালিয়ে গিয়েছিল ১৯৯৫ ব্যাচের মেকানিকালের ড্যাড (দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য), সিভিলের নির্ভীক সেনগুপ্ত ও রাদাম (রাজীব দাস মহাপাত্র); ১৯৯৬ ব্যাচের ETC-র পাম্পু (রণজয় রায়) এবং আমাদের ব্যাচের ইলেক্ট্রিকালের মামা (অমিতাভ দাস)। এদের নাম দেওয়া হয়েছিল ১৫৬ নট আউট, কারণ ১৫৭ ঘন্টায় এই অনশন প্রত্যাহার হয়ে যায়, বি ই কলেজের ইতিহাসে যতদুর সম্ভব সব থেকে দীর্ঘক্ষণ চলা অনশন ধর্মঘট। আর যা মনে আছে সত্যি করেই অনেক চেষ্টা বা আবেগ থাকলেও এই ধর্মঘট বিফলে যায় বলে যারা অনশন করেছিলো তাদের কেউ ফলের রস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করেনি। কি বিচিত্র পরিহাস।

 

সেই সন্ধ্যের কথা এখনো অনেকের মনে থাকবে। গোটা কলেজ জড়ো হয়েছে ক্যান্টিন, আই হল আর বকুলতলায়। মিটিং শেষ করে ড্যাড, নির্ভীকদা, পাম্পু এবং বাকিরা এসে হাজির হলো কলেজ কান্টিনে। একে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে সাতদিন অনশন করেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেরুদন্ডগুলো এক সন্ধ্যেতেই যেন ভেঙ্গে গেছে। ঘোষনা হলো, এখানে আমরা সবাই মা বাবার স্বপ্ন সফল করতে, অনেক কষ্ট করে পড়তে এসেছি। তাই অনশন ধর্মঘট অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হলো যাতে কোনো ছাত্রের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। কেউ প্রতিবাদ করেনি, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখে শূন্য থেকে কয়েকফোঁটা জল নেমে আসে। কয়েকমুহুর্ত মনে হয়েছিলো চারিদিকে শুধু রাশি রাশি শূন্য।

 

এরপর ভাগ্যের পরিহাসে আমরা সেই ১২৮ জন প্রায় সবাই চারবছরের জন্যে রয়ে গেলাম 'নতুন' ছেলেদের দলে। ফার্স্ট ইয়ারে হোস্টেলের রাশ সিনিয়ারদের হাতে আর আমরা মুরগি থেকে ফার্স্ট ইয়ার। তারপর থেকে আমরা অন্য হোস্টেলে গেলেও সেখানে আগে থেকেই থাকতো সেই হোস্টেলের সিনিয়ার বা আমাদের ব্যাচের সেইসব হোস্টেলের পুরোনো ছেলেরা। তাই আমরা বরাবর রয়ে গেলাম দ্বিতীয় শ্রেনীর বাসিন্দা। সবাই ভালো রুম, ভালো খাট বা ভালো লকার দখল করে নেবার পর পড়ে থাকা জিনিসপত্র জুটতো আমাদের কপালে।

 

বেকসু ঠিক করে দিয়েছিল তিনদিনের মধ্যে আমরা নতুন হোস্টেলে চলে যাব। আমরা কথামতো একবিকেলে, ভাঙ্গা লকার থেকে মালপত্র টিনের তোরঙ্গে ভরে আর জংধরা লোহার খাটের উপর থেকে বেডিংটা গুটিয়ে, বগলে ড্রয়িং বোর্ড আর কাধে টি নিয়ে একটা ভ্যানের পিছনে কয়েকজন মিলে যাত্রা করি মুচিপাড়ার দিকে। আমি চলে আসি সমিত রায়চৌধুরী আর সন্দীপ মণ্ডলের সাথে প্রথম বাসা হোস্টেল পনেরো থেকে হোস্টেল নয়-এর দিকে। তারপর নয় থেকে দশ ঘুরে চতুর্থ বছরে সেন হলে এলেও কোনদিন হোস্টেল ১৫ তে ঢুকিনি। ঢুকতে ইচ্ছে করেনি। খুব সম্প্রতি একবার কলেজে গিয়ে ১৪, ১৫ আর ১৬-র দিকে গিয়েছিলাম। দেখলাম ১৫ নং ছাড়া সব হল ও হোস্টেলেই নাম বা নম্বরের ফলক লাগানো। কিন্তূ শুধু হোস্টেল ১৫-ই নামগোত্রহীন। ১৪ আর ১৬-র মাঝে দাড়িয়ে আছে বলে বুঝে নিতে হয় এটাই ১৫। সব হোস্টেলে ঢুকলেও, ২০১৩-র এক এপ্রিলে গিয়েও হোস্টেল ১৫-তে ঢুকতে গিয়েও ফিরে এলাম। মনে পড়ে গেলো একদিন আমাকে এখান থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ঘাড় উঁচু করে ছেড়ে যেতে পারিনি। হোস্টেল ১৫ কে ছেড়ে যেতে হয়েছিলো নতুন মুরগীদের জন্যে সুরক্ষিত করার জন্যে। ঢুকেছিলাম সিনিয়ারদের মুরগি হয়ে মাথা নিচু করে, বেরিয়েছিলাম কর্তৃপক্ষ নির্দেশে মাথা নিচু করে। যেদিন এসেছিলাম মনে অনেক অজানা ভয় ছিলো, যেদিন বেরিয়ে গেলাম সেদিন মনটাই ছিলো না।

Wednesday, April 17, 2013

১১. চোতাকাহিনী


-১১. চোতাকাহিনী 

"ত দিন পরীক্ষা, তত দিন টোকাটুকি। যত দিন শিক্ষা প্রথা, তত দিন থাকবে চোতা। নিন্দুকরা চেঁচালে হবে না, টুকলি যুগ যুগ জিয়ো। একটি গ্রিক গল্প: পরীক্ষার খাতায় একটি ছাত্র লিখল— 'যুদ্ধে হারিয়া শাজাহান ভাঙিয়া পড়িতেন না।' পিছনে বসা ছাত্রটি সেটাই দেখে দেখে লিখল— 'যুদ্ধে হারিয়া শাজাহান জাঙিয়া পরিতেন না।' মর্মার্থ: টুকতেও শিক্ষা লাগে। প্রখ্যাত দার্শনিক বেনথ্যাম বলেছেন, যে দেশে মুখস্থ বিদ্যার ওপর শিক্ষার মান স্থির হয়, সেখানে টুকলিই সেরা অস্ত্র, সেরা প্রতিবাদ। শেলি বলেছেন: "পড়িলে টুকিতে হবে, সব মুখস্থ কার কবে, অতি স্থির কোন বীর হায় রে পরীক্ষার হলে"

বন্ধুগণ, এ বার আসি মূল বিষয়ে, টোকা কী ও কেন? টুকলি হইল এমন এক উপায় যা আপনাকে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহরে যেমন মেট্রো রেল। সবাই যখন ঘেমে-নেয়ে জ্যামজটে অস্থির হয়ে আপিসে যায় তখন মাটির তলা দিয়ে এক দল লোক গুড়গুড় করতে করতে অনেক আগেই দফতরে পৌঁছে চাউমিন সাঁটায়। কেউ কেউ আবার আরও দ্রুত যাবে বলে এসকেলেটরে উঠেও দৌড়য়। কিন্তূ ওগুলো বৈধ, সরকারি অনুদান-সমৃদ্ধ, আর টুকলি হল অবৈধ। এই কাণ্ডটি করলে পরীক্ষক ধরে, পুলিশ ধরে, নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরা ধরে এবং বাবা-মা ইত্যাদি জানলে ইমেজে ফাংগাস ধরে। কিন্তু না ধরতে পারলে, টুকলির মতো বন্ধু আর জগতে নেই। টুকলি হল ১২ বছরের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসে কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের একটা মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করে নিশ্বাস নেওয়ার মতো।"

উপরের অংশটা দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের একটা রবিবাসরীয় থেকে চোতা মারা। মানে দাড়ি, কমা, ফুলস্টপ সুদ্ধু হুবহু টুকে দেওয়া। যেটাকে পরীক্ষার হলে করলে বলি চোতা করা আর সাহিত্য বা সংস্কৃতির জগতে হলে বলা হতো, অমুকের অনুপ্রেরনায় বা তমুকের কোট করে। এই অংশটা বি ই কলেজের বিভিন্ন চোতা করার উপায় এবং নতুন কিছু উদ্ভাবনের উপড়। যেগুলোর আবিষ্কারকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কোনোরকম পেটেন্ট বা উৎপাদন শুল্ক ছাড়াই উদারমনে এইসব গুরূবিদ্যায় অকাতরে অপরকে দীক্ষিত করেছে।

আমরা অনেকেই ছিলাম সেই সব সর্বনাশের মূল মুখস্থ বিদ্যের উপড় নির্ভরশীল। গুটিকয় প্রতিভাবান ছিল যারা নাকি বিষয়টা বুঝে মন থেকে লিখতো। বাকিরা বা বলতে গেলে অল্পবিস্তর অনেকেই চোতার উপড় নির্ভরশীল। টোকার অনেক পদ্ধতি বা শ্রেণীবিভাগ আছে। ক্লাসের প্রথমদিকে থাকতো এমন অনেকে নিজে থেকে কষ্ট করে চোতা করত না বা কোনো টুকলি সাথে নিয়ে যেত না। কিন্তূ জানতো আশেপাশে কাদের কাছে চোতা আছে। আটকে গেলে বা সুযোগ পেলে ঘাড় ঘুরিয়ে টুক করে জেনে নিত কোনো জটিল সূত্র বা দু-একটা ছোটো উত্তর। এরা প্রথম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী, ক্লাসে ভালো ফল করতো, অধ্যাপকদের স্নেহধন্য, গর্ব করে বলত কখনো চোতা করেনি; কিন্তূ দরকারে বাজে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে ওই একটু সাহায্য না পেলে তাদের ফল হয়তো এতো ভালো হতো না। কিন্তূ তারা হলো মহাভারতের কৃষ্ণ, নিজে যুদ্ধ করলো না। তবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বোর্ডে বা বেঞ্চে বা দেওয়ালে লেখা থাকতো যেগুলো দরকারে যে কেউ তাকিয়ে দেখে নিতে পারতো।

এরপর ছিলো দ্বিতীয় শ্রেণী, যারা বিপদে চোতা করতো দু-একটা খুব শক্ত সুত্র। অথবা কিছু কাগজ নিয়ে যেতো যেগুলো বাথরুমে গিয়ে দেখে এসে, চটপট লিখে ফেলতো। অথবা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় আড়চোখে দেখে নিতো পাশের বা সামনের জনের খাতা বা কোনো সার্বজনীন উন্মুক্ত চোতা। তবে এরা অনেক বিষয় চোতা না করেই নামিয়ে দিতো, নিজস্ব ফান্ডা দিয়ে। একজনের এখানে বলবো যে আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র ছিলো পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের এক স্কুলে। পরে সে ডাক্তারি পরে এখন আপোলোতে কর্মরত। তার একটা প্রতিভা ছিলো প্রায় কুড়ি ফুট দূর থেকে কারো হাতের কনুই নড়া দেখে হুবুহু নকল করে ফেলতে পারতো। তবে যার দেখে লিখতো তার জামা ফুলহাতা থাকলে ফান্ডাটা কাজে লাগতো না। জনতার দাবীতে অনেকবার সে সেটা জনসমক্ষে করে দেখিয়েছিল। এরকম দুর্দান্ত প্রতিভা অনেকের না থাকলেও দূর থেকে হাতের নড়া দেখে অনেকে কোনো স্কেচ নকল করতে পারতো।

আর ছিল তৃতীয় শ্রেণী। যারা দরকার পড়ুক বা না পড়ুক, সব বিষয়ের চোতা তৈরি করে রাখতো। এদের মধ্যে কয়েকজন আবার হাতের লেখা খারাপ বলে নিজে চোতা না করে অন্য কাউকে দিয়ে চোতা করিয়ে নিতো। যে করে দিত সে বড়ো অক্ষরে লিখে দিলে সেটা আবার বি জি রোডের জেরক্স মেশিনের দোকান থেকে মাইক্রো জেরক্স করে আনতো। চোতা ছাড়া প্রায় কোনো বিষয় বা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত না। এরা ছিল একবারে মহাভারতের অর্জুন, যারা ছলেবলে পুরো ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধটা নিজেই করতো।

পাশ করার পর কেউ স্বীকার করেনা যে কলেজ জীবনে চোতা করেছিল। সবার কাছেই শুনি তার বন্ধুরা চোতা করতো। যেমন শুনি কলেজ জীবনে সবাই নাকি খুব ভদ্রসভ্য ল্যাজবিশিষ্ট ছিলো। ছেলে হলে বলে মেয়েদের অবজ্ঞা করতো বা জীবনে বউ ছাড়া অন্য মেয়ের প্রতি ফ্রাস্টু খায় নি বা প্রেম করে নি। মেয়ে হলে শোনা যায় সে জগৎসুন্দরী ছিলো বলে অনেক ছেলে তার পিছনে ঘুড়ঘুড় করতো, কিন্তূ সে নাকি কাউকে পাত্তা দিতো না। সেরকম বন্ধুদের বিভিন্ন চোতা করার গল্প থাকলেও, কেউ নিজের নকল করার গল্প বলতে লজ্জা পায়। তবে সত্যি বলতে আমার মনে হয় কিছু ধরনের চোতা করার পদ্ধতি রীতিমত প্রশংসার দাবী রাখে। নকল করা এক ধরনের হস্তশিল্প, যাতে তাৎক্ষনিক উপার্জন না হলেও, দীর্ঘমেয়াদী উপার্জনের রাস্তা তৈরি হয়। আর মুখস্থবিদ্যা বা সল্পমেয়াদী ভাবে মাথায় টুকে নিয়ে গেলে দোষ নেই, যত দোষ কাগজে লিখে নিয়ে গেলেই?

আমার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পিতামাতা ও পূর্বপুরুষেরা আমার নাম দিয়েছিলেন 'পার্থ প্রতিম', তাই আমি 'পার্থ সারথী' বা কৃষ্ণের মতো প্রথম শ্রেনীর হতে পারিনি। তা বলে আমি 'পার্থ' বা তৃতীয় শ্রেনীর অর্জুনদের মতো পুরোপুরি চোতা নির্ভরশীলও ছিলাম না। হয়তো 'পার্থ প্রতিম' নামের মর্যাদা রেখে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মতো মাঝামাঝি ছিলাম। দুয়েকটা বিষয়ে একটা দুটো শক্ত সুত্র বা তথ্য টুকে নিয়ে যেতাম। তার অধিকাংশই যদি ভুলে যাই তাহলে বাথরুমে গিয়ে দেখে আসবো ভেবে। আর অবিভাগীয় বিষয়ে খুব কম হলেও অল্প কয়েকটা একদম সঙ্গে নিয়ে। তবে সেটার মাধ্যম ছিল সাধারণ কলম। আমাদের সময় চালু ছিল ইউজ এন্ড থ্রো ষ্টারলাইন পেন, যার প্রস্থচ্ছেদটা ছিলো ষড়ভুজের মতো আর যে রঙের কালি ভরা সেই রঙের কিনারাযুক্ত বাইরের রং ছিলো সাদা। সেই পেনের এক এক পার্শ্বে ড্রয়িং-এর মাইক্রোটিপ পেন্সিল ব্যবহার করে এক সময় প্রায় দুই থেকে তিন লাইন লিখে ফেলতে পারতাম। মানে একটা কলমই যথেষ্ঠ টুকটাক টোকাটুকির জন্যে। একবার মনে আছে বেসিক ইলেকট্রিকালের কিছু নকশা এক দিকে ধরিয়ে ফেলেছিলাম। পরীক্ষাহলে সামনে পড়ে থাকলেও কারো বোঝার ক্ষমতা ছিলো না পেনের গায়ে কিছু লেখা আছে। এক পার্শ্বের লেখা শেষ হলে বামহাতে পেনটা অল্প ঘুরিয়ে নিয়ে পরের লাইনগুলো সহজেই দেখে নেওয়া যেতো।

এছাড়াও খুব জনপ্রিয় ছিল বা আজও আছে সাদা ডায়াগোনাল স্কেল। রথী মহারথীরা একদিক ব্লেড দিয়ে চেঁছে উঠিয়ে দিতো, আর সম্পূর্ণ সাদা অংশে ধরিয়ে ফেলতো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। অনেকে তো এতগুলো ডায়াগোনাল নিয়ে যেতো যে তার একটা সুচিপত্র হাতে বা কোথাও লিখে রাখতে হতো। প্রশ্ন মিলে গেলে সুচিপত্র দেখে হাত ঢুকে যেত, জামার পকেট বা পান্টের ডান বা বাম পকেটে। কেউ কেউ ছিল যে নিজে মনে রাখতে পারতোনা বলে পাশের রোল নম্বরের ঘরে এসে পরীক্ষার আগে দেখিয়ে যেতো কোন ডায়াগোনালে কি লেখা আছে। পরীক্ষার সময় জেনে নিতো অমুক প্রশ্নের উত্তরটা কোন ডায়াগোনাল দেখে লিখবে। এছাড়াও ছিল সাধারন কাগজে লেখা চোতা যেটা সাজানো থাকতো বামহাতের দুই আঙ্গুলের মধ্যে হারমোনিয়ামের বেলোর মতো করে, অদ্ভুত দক্ষতায় পরতে পরতে এক অংশ খুলতো আর তার আগের অংশ বন্ধ হতো। কেউ পুরো নোটটাই জেরক্স না করে লিখে রাখতো বিশেষভাবে তৈরি খুব ছোটো খাতার মধ্যে, যা আশ্রয় পেতো জ্যামিতি বাক্সের মধ্যে বা দুই ঊরুর মাঝে। অনেকের পরিক্ষার আগে হাত কেটে যেতো। ব্যান্ডেজের সাথে সেখানে পেঁচিয়ে থাকতো সার্ভে বা স্ট্রাকচারাল এনালাইসিসের কোনো প্যাঁচালো প্রসঙ্গ।

শুধু যে ছেলেরাই চোতা করতো তা নয়। অনেক মেয়ে পরীক্ষা দিতে আসতো শাড়ি পরে, আর শাড়ি আঁচল বা রুমালে লেখা থাকতো কোনো জটিল অঙ্ক বা কোনো খটমট নকশা বা কুটিল কোনো সুত্র। কয়েকজনতো এতো মরিয়া ছিল যে হঠাৎ পরীক্ষক কোনো হারমোনিয়াম চোতা দেখে ফেলে কেড়ে নেবার জন্যে এগিয়ে আসছে দেখে এমন জায়গায় সেটা টুক করে চালান করে দিতো যে পরীক্ষক ধরতে গেলে নিজেই শ্লীলতাহানীর দায়ে পড়বেন। এই সুযোগটা ছেলেরাও নিতো যদি কোনো ম্যাডাম দায়িত্বে থাকতেন। কেউ কেউ দেখেছি ধরা পরে গেছে বুঝতে পেরে বেমালুম চোতা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। এছাড়া ঘড়ির ব্যান্ডের তলায়, জামার গোটানো হাতের মধ্যে উঁকি মারতো দু-একটা নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর। আমাদের সময় জিন্স এতো প্রচলিত ছিল না। কিন্তূ কিছু বান্ধবী ডায়াগোনালে চোতা করলে পরীক্ষার হলে জিন্স পড়ে আসতো।

অনেকে প্রথম পরীক্ষাটা একটু খেটেখুটে দিতো, কিন্তূ তারপরের দিন থেকে দেখা যেতো সব পরীক্ষায় তাড়াতাড়ি খাতা জমা পরে যাচ্ছে আর বেশ ভালো নম্বরও পাচ্ছে। আসলে রোজ সে প্রচুর লুজ পেপার নিতো, যার মধ্যে অধিকাংশই সদ্যদিনে জমা পড়তো না। আলাদা আলাদা লুজ সিটে রাতে লিখে নিতো পরেরদিন প্রায় নিশ্চিত সেরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর। তারপর সুযোগ বুঝে মিলে যাওয়া প্রশ্নগুলোর পাতা মূল উত্তরপত্রের সঙ্গে জুড়ে জমা দিয়ে দেওয়া। কেউ কেউ বন্ধুর সঙ্গে সাঁট করে গিয়ে, এ কয়েকটা উত্তর লিখত, ও কয়েকটা। তার পর দু'জনেই খাতা 'এ বাবা' বলে মেঝেয় ফেলে দিয়ে, তোলার সময় বদল করে নিত। অবশ্য খাতা জমা দেওয়ার আগে ফের এক বার বদল করতে না পারলে কেলো! এর কিছু পাতা ওর কাছে যাওয়ার অবধারিত বিপদ হিসেবে মাঝে মাঝে রিলে হয়ে কোনো উত্তরপত্রের অংশ পৌঁছে যেত হলের অন্যপ্রান্তে। পরীক্ষার শেষে, খাতা জমা দেওয়ার সময় যার উত্তরপত্রের অংশ সে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে, 'ওরে, আমার কাগজ কই' কেউ কেউ আবার বাথরুম থেকে ঘুরে এসে সামনে দিয়ে যাবার সময় এক পর্বের উত্তরপত্র নিজের মনে করে তুলে নিয়ে চলে যেতো, টোকা হয়ে গেলে নিচে ফেলে বা আর একবার বাথরুমে যাবার পথে দিয়ে যেতো। এছাড়া মান্ধাত্তা আমলের উপায় - জুতোয়, মোজায়, কলারের ভাঁজে, পেনসিল-বাক্সে কাগজ লুকনো, ক্লিপবোর্ডে উত্তর লিখে নিয়ে যাওয়া, এমনকী অ্যাডমিট কার্ডের পিছনে থিয়োরেম।

তৃতীয় বছর থেকে আমি খুব কম সময়ই ক্লাসে থাকতাম আর বাকি সময়টা কম্পিউটার ল্যাবে কাটাতাম। কিছু সময় স্যারেদের কোনো কাজেও যুক্ত থাকতাম নিজের আগ্রহে। স্বভাবতই ক্লাস নোটের জন্যে ভরসা করতে হত অন্যদের উপড়। আবার কম্পিউটার এবং অনান্য সেশনালের জন্যে অনেকে ভরসা করতো আমার উপড়। তাই কয়েকজন পরীক্ষার আগে সব নোটের জেরক্স নিয়ে ঘাঁটি গাড়তো আমার ঘরে। বিশ্বজুড়ে 'যৌথ খামাড়' স্বপ্ন থেকে গেলেও, বাস্তবে আমার নেতৃত্বে শুরু হতো যৌথ গাঁতানোর আখড়া। এসব করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, নিজে পড়ে মুখস্থ করার থেকেও অন্যকে বোঝাতে গেলে সহজে মনে থাকে। আর নিজে খাতায় লিখে পড়া তৈরি করাটা বিরক্তিকর লাগলেও অন্যের হয়ে চোতা করা দিলে একটা পরোপকারও হতো আবার নিজেরও পড়া তৈরি করাটা সুবিধে হতো। দুয়েকটা সুত্র অনেকেই হাতের তালুতে বা নখে লিখে নিয়ে চলে যেতাম। লেখা হয়ে গেলে বা না মিললে সহজেই সেগুলো মুছে ফেলা যেতো। আর একজন ছিল সব চোতা নিয়ে যেতো শুধু 'ব্যাকআপ' হিসেবে। হাতের লেখা বেশ ভালো ছিলো আর লিখতো বেশ দ্রুত। এমনিতে সব মন থেকে লিখতো যতগুলো পারে। যেগুলো মনে থাকলো না সেগুলো বাথরুমে গিয়ে মুখস্ত করে এসেই চটপট লিখে ফেলতো। আর নাম্বারও পেত বেশ ভালোই, প্রথম দশজনের মধ্যেই থাকতো। আর সবশেষে সেই সব ভুলোমনের যারা ভুলে যাবে বলে চোতা করে নিয়ে যেত, কিন্তূ পরীক্ষাহলে সেটাও ভুলে যেতো যে আদপে প্রশ্নটা চোতা  করেছে কিনা বা করলেও কোথায় রেখেছে!

শেষ করি চোতা নিয়ে কিছু মজার ঘটনা দিয়ে। আমাদের সময় বর্দ্ধমান থেকে মেকানিকালের এক প্রতিভাবান ছাত্র ছিল, সে মাধ্যমিকে অংকে একশয় একশ এবং উচ্চমাধ্যমিকে অংকে দুশয় দুশ পেয়েছিল। কিন্তূ বি ই কলেজের চারটি সেমেস্টারের একটিতেও অংকে এক সুযোগে পাশ করতে পারেনি। সে ছিলো চোতায় স্বনির্ভর, কয়েকটা সাদা পাতাকে আটভাগ করে ছোটো ছোটো খাতা তৈরি করতো। তারপর পুরো সিলেবাসটাই ভালো ফল করে এমন কারো নোটবুক থেকে ছোটো ছোটো অক্ষরে লিখে ফেলতো। এটা তার সাড়া বছরের নিয়মিত অভ্যাস থাকায়, পরীক্ষার আগের রাতেও পড়ার বা চোতা করার চাপ নিতে হতো না। শুধু সকালে উঠে রুটিন দেখে সঠিক খাতাটা পকেটে পুরে শিস দিতে দিতে চলে যেতো।

সিভিলের এক সহপাঠী সুপ্রিয়র কাছে শোনা তার খুব কাছাকাছি বসা এক ছাত্রের কিছু মজাদার কাহিনী ছিল। সেও ছিলো পুরো চোতা নির্ভর এবং একটু তোতলা। একবার পরীক্ষার হলে একটু বিভ্রান্ত হয়ে একটা ডায়াগোনাল দেখিয়ে সুপ্রিয়কে জানতে চায় "এই তুপ্রিয় বলনা, ১ নম্বরটা কোতা থেকে তোতাবো"। অনিচ্ছাসত্বেও এবং পরীক্ষককে এড়িয়ে সুপ্রিয় ডায়াগোনালের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বলে আরে এতো পরিবেশ বা এনভায়রনমেন্টের চোতা, কিন্তূ আজতো পরিবহন মানে ট্রান্সপোর্টেশানের পরীক্ষা। সেই বর্ণময় চরিত্রের তাৎক্ষণিক উক্তি, "দ্যাৎ তালা, আদ লাতে দর্ণায় থিনেমা দেখতে দাবো বলে, দুতো বিতয়ের তোতাই তৈরি করে লেখেতিলাম। কিন্তূ আতার তময় বুল কোলে অন্যতা নিয়ে তোলে এততি"। প্রথম ঘন্টা পড়ার পর সে হোস্টেলে গিয়ে সেট বদল করে এনে বাকি পরীক্ষা দিয়েছিলো। আর একবার একটা দুনম্বরের প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় সুপ্রিয়কে জানতে চেয়েছিল "এই তুপ্রিয় বলনা এতা কোতা তেকে তোতাবো"। সুপ্রিয় সবদিক দেখে চট করে বাড়িয়ে ধরা ডায়াগোনালের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "এই তো প্রথম লাইন থেকেই লিখে দে"। বেশ কিছু পরে গোটা ডায়াগোনাল থেকে প্রায় দুতিন পাতা লিখে আবার খোঁচা "এই তুপ্রিয় বলনা কততা তোতাবো"। সুপ্রিয় অবাক হয়ে বলেছিল তোকে তো প্রথম অনুচ্ছেদটাই লিখতে বললাম আর ওটা তো দুনম্বরের প্রশ্ন!উত্তর ছিল, "দুত্ তালা তলবি তো। অতো বুললে কি আমাকে তোতাতে হয়"। সবথেকে সেরা ছিল চতুর্থ বছরের এক ঘটনা। হাতের লেখা খারাপ বলে আর ল্যাদ খেয়ে ইনি মাঝেমাঝেই অন্যদের দিয়ে চোতা বানিয়ে নিতেন। জল সম্পদ বা ওয়াটার রিসোর্সের পরীক্ষায় একটা প্রায় দুশভাগ নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর তাঁর ডায়াগোনালে টোকা ছিল। কিন্তূ তিনি সেটার উত্তর না করেই চলে এসেছিলেন। কারণ চোতায় ছোটো এল চিহ্ন দিয়ে অঙ্কটা করা থাকলেও প্রশ্নপত্রে সেই অঙ্কটা বড় এল চিহ্ন দিয়ে ছিল। পরে উল্ফেডেনে এসে দেখা যায় তিনি চিৎকার করছেন যে চোতা করে দিয়েছিল তাকে। "দুত্ তালা, তলবি তো। পলিক্ষায় তো ওতা বদো এল (L) তিলো, আল তোতায় তো তোতো এল (l)আমি কি কলে দানবো যে দুতোই এক"। এই ব্যাক্তি মন্ডল কমিশনের প্রস্তাবের সুফল হিসেবে টপাটপ বেশ কয়েকটা পদোন্নতি পেয়ে এখন পূর্ত বিভাগের উচ্চপদে আসীন।

পরীক্ষার হলে চোতানো ছাড়াও নকল জনপ্রিয় ছিল ল্যাব বা সেশনালগুলোতে। হোস্টেলের সব ফ্লোরে কিছু কাঁচ আর টেবিল ল্যাম্প থাকতো 'লাইট স্ট্রেসিং' করার জন্যে। এছাড়াও ড্রয়িং বা অনান্য ল্যাবের নকশাগুলো দুয়েকজন করতো আর বাকিরা কাঁটা মেরে তুলে নিতো শেষবেলায়। অনেকে তাই করে ফেললেও বাকিদের বলতো না, কারণ যারা নকল করতো তাদের খাতাগুলো অনেক ভদ্র অবস্থায় জমা পড়তো। আর যারা আগে করতো তাদের খাতা মাঝে মাঝে কাঁটার দাগে এত ছিড়ে যেতো বা লাইট স্ট্রেসিং-এর ফলে কালো হয়ে যেতো যে তাকে আবার অনেক সময় নতুন করে করতে হত।

আবার কিছু প্রফেসর ছিলেন যারা চোতা ধরার বেশ অভিনব উপায় বার করেছিলেন। প্রোঃ পি কে রায়, মানে পিকসা দেওয়ালে বা বোর্ডের সুত্রগুলোতে মাইনাস চিহ্নকে যোগচিহ্ন করে দিতেন বা একটা গুরুত্বপূর্ণ নম্বরকে মুঝে দিতেন। অনেক প্রফেসর দেওয়ালে বা বোর্ডে পেন্সিলে লিখে রাখা কোনো সূত্রের মধ্যে তিনকে একটু মুঝে দুই করে দিতেন। যারা সেটা দেখে লিখতো তারা সহজেই ধরা পরে যেত। কোনো কোনো প্রফেসর যার ড্রয়িং সব থেকে পরিষ্কার তাকে সব থেকে কম নম্বর দিতেন।

এছাড়া ছিলো আমাদের জরিপের সময় কারচুপি করা। সার্ভে কাম্পে বেশ হইচই হতো, যেটা পরে এক জায়গায় গুছিয়ে বলা যাবে। আমরা যেখান থেকে জরিপ শুরু করতাম সেখানে একটা চিহ্ন দেওয়া থাকতো। সেখানে ফিরে এসে ড্রয়িং করে ভুল শুধরে পুরো জায়গাটা আঁকতে হতো। সাধারনতঃ ফার্স্ট লবি থেকে শুরু করে কেউ চলে যেতাম রিচার্ডসনের দিকে, কোনো দল আবার ওভালের পাশ দিয়ে বিদিশা ঝিলের দিকে, কেউ কেউ হোস্টেল ১৫, ১৬-র পিছনদিকে। আমরা শুরু করে কিছুদুর এগিয়ে যাবার পর কোনো প্রফেসর এসে শুরুর চিহ্নটা পাঁচ ফুট সরিয়ে দিতেন। ভুল তথ্য নিয়েছি ভেবে, যারা সেটাকে মিলিয়ে দিতাম তারা ফাঁকি মারার জন্যে ধরা পড়তাম। যে দল মন দিয়ে জরিপ করতো তারাই বুঝতে পারতো পাঁচ ফুট হিসেব মিলছে না। পরে নারায়ন সান্যালের সত্যকাম পড়তে গিয়ে বুঝেছি এটা সার্ভের অনেক পুরোনো ফাঁদ। প্রোঃ পি কে রায় ডক্টরেট করেছিলেন সার্ভে নিয়ে। একবার দেখলাম আমরা তিনদিনে যা জরিপ করে এঁকেছি উনি ক্যালকুলেটরে টুকটুক করে দুমিনিটে কিসব হিসেব করে বলে দিলেন কোথায় ভুল হয়েছে। আমরা জানতে চেয়েছিলাম কি করে করলেন, উনি বলেছিলেন "বলে দিলে তো কাল থেকে তোরা আমার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বি, আর আমি ধরতেও পারবো না তোরা কোথায় ফাঁকি মেরেছিস"।

আর একজনের কথা না বললেই নয়। আমার ঠিক পরের রোল নম্বর প্রদ্যুত রায়। পরীক্ষায় কিছু দরকার পড়লে অনুরোধ না করে জোর গলায় দাবী করতো। "এই দেখি তোর খাতাটা, পাশে রাখতো, প্রথম পর্বের উত্তরগুলো মিলিয়ে নিই"। শেষ সেমেস্টারে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো আমার সাথে মিলিয়ে নিয়েছিলো যাতে পরীক্ষায় সুবিধে হয়। আমিও অবশ্য বেশ কয়েকবার ওর কাছে কিছু সাহায্য পেয়েছি। তবে খুব একটা চোতা করতো না, কারণ হলো ল্যাদ আর আশেপাশে এতজন থাকতে ওকে কেনো কাগজের ওপর নির্ভর করতে হবে এই দাবীতে। শেষ লিখিত পরীক্ষা ছিল টাউন প্ল্যানিং-এর ওপর। গার্ড খুব একটা কড়া না থাকায়, বেশ কয়েকবার দুয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানার পর যখন আমি খাতা জমা দিতে উঠে যাচ্ছি, জামার পিছন ধরে বসিয়ে দিয়ে আমার খাতাটা বেমালুম নিয়ে বাকিগুলো মিলিয়ে নিলো। আমি বাধ্য হয়ে পরীক্ষকের চোখের সামনে খাতা নেই নিধিরাম সর্দার হয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিলাম।

সেশনালে প্রদ্যুতকে দেখেছিলাম বেশ কয়েকটা সেমেস্টারে কারো থেকে নকল করেনি, আবার নিজেও ড্রয়িং করেনি। কিন্তূ ঠিকদিনে জমা দিয়ে দিতো। উৎসুক হয়ে চতুর্থ বছরে ওর ঘরে জমা দেওয়ার আগেরদিন গিয়ে যা আবিস্কার করি তাতে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ওর দিদিও আমাদের কলেজের সিভিলের ছাত্রী ছিলো, আমাদের থেকে তিন বছর আগে। সেই প্রতিমাদির সময়ে করা ড্রয়িংসিট গুলোতে ব্লেড মেরে শুধু নামটা বদলে জমা দিয়ে দিতো। অবশ্য তাতে দেখা যেতো ডিজাইনটা আমার দেখে নকল করা বলে, তার সঙ্গে কলামের সংখ্যা বা ব্যবধান ড্রয়িং-এর সাথে মিলতো না। অনেক সময় এমনও হয়েছে, খাতায় ডিজাইনটা আইসোলেটেড ফাউন্ডেশন, কিন্তূ ড্রয়িং-এ পাইল ফাউন্ডেশন। মানে মোদ্দা কথা ডিজাইন এক জিনিসের আর ড্রয়িং অন্য এক জিনিসের। আমরা সাবধান করলেও প্রদ্যুত নিশ্চিন্ত ছিল এই ভেবে যে, কেউ এতগুলো ছেলেমেয়ের ড্রয়িং এক এক করে খুলে দেখবে না এবং একটা গড়পরতা নাম্বার দিয়ে দেবে। সত্যি বলতে কি কোনো সেমেস্টারেই এতোবড় গলতা করেও ধরা পড়েনি। নকল করতে গেলে সবাই নিজের নাম, রোল নাম্বার বাদে বাকি বিষয়টা টুকে দিতো। প্রদ্যুত বাকি বিষয়টাতে শুধু নিজের নাম আর রোল নাম্বারটা টুকে দিতো।