Friday, December 6, 2013

- ২৩. শিবপুর পলিটেকনিক ও আমতলা স্টেট ওয়েলফেয়ার হোম

 

- ২৩. শিবপুর পলিটেকনিক ও আমতলা স্টেট ওয়েলফেয়ার হোম

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আনন্দের সাথে জুড়ে ছিল দেশভাগের বিষাদ। হাজার হাজার ভূমিহীন জীবিকাহীন নরনারীর ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো সীমান্তপার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে। পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম নয়। সরকার থেকে চালু করা হল পি এল ক্যাম্প পার্মানেন্ট লাইবিলিটি ক্যাম্প। বি ই কলেজের বকুলতলায় ছিল একটা সাময়িক পি এল ক্যাম্প। স্বর্গীয় নারায়ন সান্যালের লেখা বকুলতলা পি এল ক্যাম্প বা দণ্ডকারণ্য কাহিনী অনেকেরই নিশ্চয়ই পড়া। রাজনৈতিক বা সামজিক প্রেক্ষাপট ছেড়ে আসা যাক বি ই কলেজে এই ঘটনার ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিছু পরিবর্তনে।

 

দেশভাগের আগে থেকেই ছিল শিল্পের জন্যে দক্ষ কারিগরের চাহিদা। দেশভাগের পর নতুন প্রশাসনিক রদবদলে সেই চাহিদা আরও বৃদ্ধি পেল। সরকারের কাছে প্রস্তাব গেল যে অনেকেই অর্থ বা মেধার জন্যে স্নাতক পর্যায়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা গ্রহন করতে না পারলেও কারিগরি শিক্ষা পেলে একটা ভদ্রস্থ জীবনযাপন করতে পারে।  এছাড়াও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্যে যোগ্যদের ট্রেনিং দিয়ে শিল্পে কারিগরি কাজে লাগানো যেতে পারে। উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের অধীনে (ডিসপারসাল স্কিম) এই পরিকল্পনা রুপায়নের  প্রস্তাব নেওয়া হয়।

 

পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে বি ই কলেজ চত্বরেই চালু হয় শিবপুর পলিটেকনিকের ১২ ই জুলাই, ১৯৫০ সালে। মেইন বিল্ডিং-এর পিছনের ওয়ার্কশপগুলিতেই ক্লাস হতো পলিটেকনিকের। যার মধ্যে কিছু ওয়ার্কশপ এখন ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় টিকে আছে। বাকি কয়েকটি স্নাতকস্তরের ব্যবহৃত হয় অথবা পলিটেকনিকের নিয়মিত ক্লাস হয় বলে রক্ষনাবেক্ষন করা হয় এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নও হয়েছে।

 

প্রথম থেকেই শিবপুর পলিটেকনিক ছিল বি ই কলেজের একটি অংশ। বি ই কলেজের প্রিন্সিপাল পদাধিকার বলে শিবপুর পলিটেকনিকেরও প্রিন্সিপাল হতেন।  কলেজ ও পলিটেকনিকের বেতনক্রমও ছিল একইরকম। পুরনো অ্যাডমিন বিল্ডিং বা মেইন কলেজ বিল্ডিং-এই পলিটেকনিকের অফিস ছিল। ছাত্রদের এক বছরের ট্রেনিং নিতে হত যার মধ্যে একটা ভাগ ছিল প্রাথমিক শিক্ষা আর বাকিটা নিজ নিজ বিভাগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বৃত্তিমুলক শিক্ষা। দুটি সেশনে ছাত্ররা ভর্তি হতে পারতো, সেগুলি শুরু হতো পয়লা জুলাই আর পয়লা জানুয়ারী থেকে। ধীরে ধীরে একসময় প্রায় একশটি শাখায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

 

প্রশিক্ষণের এক চতুর্থাংশ জুড়ে থাকা প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে থাকতো সমাজ বিজ্ঞান, ইংরেজি ভাষা, সরল গনিত, সাধারন বিজ্ঞান, নকশা তৈরী, ব্লু প্রিন্ট পড়া ইত্যাদি। বাকি তিন চতুর্থাংশের প্রশিক্ষণ হতো কর্মশালায়। প্রথমদিকের কিছু বিভাগের মধ্যে ছিল

ক. অটোমোবাইল মেকানিক,

খ. ব্ল্যাকস্মিথ,

গ. কারপেন্টার,

ঘ. ইলেকট্রিশিয়ান,

ঙ. ইলেকট্রোপ্লেটার,

চ. ফিটার,

ছ. আই সি ইঞ্জিন মেকানিক,

জ. ল্যাবরেটরী হেল্পার,

ঝ. মেশিনিস্ট,

ঞ. ম্যাসন,

ট.  মোল্ডার,

ঠ. প্যাটার্ন মেকার,

ড. পেন্টার,

ঢ. প্লাম্বার,

ণ. রেডিও মেকানিক,

ত. রেফ্রিজারেশন মেকানিক,

থ. রনিও প্রিন্টার,

দ. শিট মেটাল ওয়ার্কার,

ধ. টুল মেকার,

ন. ট্রেসার,

প. টার্নার,

ফ. ওয়েল্ডার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শাখা।

 

পলিটেকনিক শুরু হবার অল্পদিন পরেই পঁচাত্তর জন অনাথ যুবকের টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কিমের অধীনে প্রশিক্ষণ শুরু হয় বি ই কলেজে ১৯৫১ সালের ২১ শে জুন থেকে। এই বিদ্যার্থীরা থাকতো কলেজ থেকে এক মাইল দূরে ক্যারি রোডে আমতলা স্টেট ওয়েলফেয়ার হোমে। একজন সুপারের দায়িত্বে এদের সমস্ত খরচ (থাকা, খাওয়া, জামাকাপড়, খেলাধুলো ইত্যাদি) বহন করতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  শিক্ষা দপ্তর। দুই থেকে পাঁচ বছরের বিভিন্ন পাঠক্রমে এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো বিভিন্ন শাখায়। শাখাগুলির যে তালিকা পাওয়া যায়, তা হল

ক. রেডিও মেকানিসম,

খ. রনিও প্রিন্টিং,

গ. ইলেকট্রোপ্লেটিং,

ঘ. ম্যাসনারি,

ঙ. পেইন্টিং,

চ. ওয়েল্ডিং,

ছ. টিন স্মিথি,

জ. টার্নিং,

ঝ. অটোমোবাইল মেকানিসম,

ঞ. ইলেক্ট্রিক,

ট. আই সি ইঞ্জিন মেকানিসম,

ঠ. প্যাটার্ন মেকার,

ড. ফিটিং,

ঢ. ব্ল্যাক স্মিথি,

ণ. কারপেনট্রি,

ত. মোল্ডিং,

থ. মেশিনিস্ট,

দ. প্লাম্বিং।  

 

পড়াশুনোর সাথে সাথে স্টেট ওয়েলফেয়ার হোমের ছেলেরা অভিনয়ে অংশগ্রহন করতো। এরা পলিটেকনিকের অন্যান্য বিদ্যার্থীদের সাথে বার্ষিক ক্রীড়া বা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো এবং কলেজের রাষ্ট্রীয় রণশৈক্ষবাহিনীর (NCC) প্রশিক্ষণ নিত। ১৯৫৪ সালের মার্চ নাগাদ ফার্স্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন এনসিসির অধীনে ৩৩ জন ক্যাডেটের একটা জুনিয়র ডিভিশন এনসিসি বাহিনী ছিল। তখন থেকে ধারাবাহিকভাবে এই বাহিনী বিভিন্ন বার্ষিক প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহন করতো।

 

আমতলা স্টেট ওয়েলফেয়ার হোম প্রথম থেকেই বি ই কলেজের অধীনে ছিল। পরে এই স্কিমটি বাতিল হয়ে যায়। সুত্র অনুসারে এখন হোমের একটিমাত্র কর্মচারী রাজ্য সরকারের অন্য একটি বিভাগে ডেপুটেশনে কর্মরত। স্টেট ওয়েলফেয়ার হোমের বাড়িটি পরবর্তীকালে পোড়ো বাড়ী হয়ে যায় এবং সমাজবিরোধীদের আখড়া হয়ে ওঠে। কলেজের থেকে দূরে হওয়ার জন্যে রক্ষনাবেক্ষন এবং নজরদারিরও সমস্যা হত। পরবর্তীকালে রাজ্য সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর কার্যালয় হিসেবে একটি জায়গার দরকার পড়লে, বি ই কলেজের শেষ প্রিন্সিপ্যাল এবং ডিমড ইউনিভার্সিটির প্রথম ডিরেক্টর ডঃ বিমল সেন এক চুক্তি অনুসারে এই জায়গাটি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে তুলে দেন।

 

প্রথম থেকেই শিবপুর পলিটেকনিকে পাশ করা ছাত্রদের বি ই কলেজের প্রিন্সিপ্যাল প্রশংসাপত্র প্রদান করতেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ভারতে আইটিআই পাঠক্রম শুরু হয় কারিগরি শিক্ষানবিশ তৈরি করার উদ্দেশ্যে। পাশ করা ছাত্রদের ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেনিং (ডিটি) থেকে প্রশংসাপত্র প্রদান করা হত। স্বাভাবিকভাবেই শিবপুর পলিটেকনিক থেকে পাশ করা ছাত্রদের প্রশংসাপত্রের বৈধতা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এই সমস্যায় ছাত্রসংখ্যাও যথেষ্ট হ্রাস পায়। ১৯৮৬ সালে শিবপুর পলিটেকনিককে বি ই কলেজের অধীনে রেখেই আইটিআই পর্যায়ে উন্নীত করা হয়, যদিও মোট অনুদানের অঙ্ক সমান থেকে যায়।

 

ঠিক হয় এই অনুদানে চালানোর জন্যে বিভাগের সংখ্যা কমিয়ে সাতটিতে নিয়ে আসা হবে

ক. ফিটার,

খ. ইলেক্ট্রিসিয়ান,

গ. টার্নার,

ঘ. মেশিনিস্ট,

ঙ. মেকানিক মটর ভেহিকেল

চ. টুল অ্যান্ড ডাইমেকার

ছ. ড্রাফটসম্যান

 

এছাড়াও সম্বন্ধযুক্ত কিছু শাখার অনুমোদন থাকলেও প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয় না, যেমন

ক. কারপেনট্রি,

খ. শিট মেটাল,

গ. মোল্ডিং,

ঘ. স্মিথি অ্যান্ড ওয়েল্ডিং।

 

১৯৯৩ সালে বি ই কলেজ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় - বি ই কলেজ (ডিমড ইউনিভার্সিটি)। নিয়ম অনুসারে তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল পলিটেকনিকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। পলিটেকনিকের প্রশিক্ষকদের মধ্যে একজনকে নির্বাচিত করা হয় পলিটেকনিকের দায়িত্বভার সামলানোর জন্যে। শিবপুর পলিটেকনিক ডিমড ইউনিভার্সিটির অধীনে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কলেজে পরিণত হয়। এতদিন স্নাতক স্তরের ক্লাসের পাশাপাশি ফাঁকা সময়ে একই ওয়ার্কশপে পলিটেকনিকের প্রশিক্ষণ ও পঠনপাঠন চলতো। ধীরে ধীরে ডিরেক্টর ডঃ স্পর্শমণি চ্যাটার্জির আমলে অব্যবহৃত দুর্গাপুর হোস্টেল ভবনের সংস্কার সাধন করে পলিটেকনিক ওয়ার্কশপ ও প্রশাসনিক ভবন নিয়ে আসা হয়। কিছুদিন পর থেকেই শুধুমাত্র পলিটেকনিকের জন্যে সম্পূর্ণ সময়ের প্রিন্সিপ্যালের পদ সৃষ্টি করা হয়। ২০০৩ সালে শিবপুর পলিটেকনিকের নাম পরিবর্তন হয়। নতুন নাম হয় শিবপুর আই টি আই।

 

শুরু থেকে প্রতি বিভাগের জন্যে একজন করে প্রশিক্ষক থাকতেন এবং এক ইউনিট মানে ১৬ টি করে বিদ্যার্থী ভর্তি করা হত। ২০০৮ সালে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) মডেলে ভারত সরকারের ডাইরেক্টর জেনারেল অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং  (Directorate General of Employment & Training - DGET) এর অধীনে এটিকে সেন্টার অফ এক্সেলেন্সে উন্নীত করার প্রস্তাবনা আনা হয়। পিপিপি মডেলে নতুন একটি বিভাগের অনুমোদন পাওয়া যায় ইলেক্ট্রিক্যাল। পূর্বোক্ত বিভাগগুলির মধ্যে ফিটার এবং ইলেক্ট্রিসিয়ান পিপিপি মডেলে চালু ইলেক্ট্রিক্যালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিভাগে ছয় ইউনিট বা ১২৬ করে ছাত্রছাত্রী নেওয়ার কথা ঠিক হয়। সম্মতি পাওয়া যায় আগেকার অন্যান্য বিভাগে ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়ে ২১ জন করে করার। যদিও কার্যক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে এককালীন একটা তহবিল বাদে অন্য কিছুর সুরহা হয়নি। দরকারি প্রশিক্ষকের অনুমোদন, উপযুক্ত জায়গা, রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে অনুদান এসব এখনও বিশ বাঁও জলে।

 

ইতিমধ্যে পুরনো ওয়ার্কশপ বিল্ডিং-এর পাশে পলিটেকনিকের একটি বাড়ী তৈরী শুরু হয়। কিন্তু বেশ কিছুটা কাজ হয়ে যাবার পরেও সরকারী নিষেধাজ্ঞায় সেটির কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। সম্প্রতি একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে, পলিটেকনিককে থার্ড গেটের কাছে, লো কষ্ট হাউসগুলির পাশে ২ বিঘা জমিতে স্থানান্তরিত করার। যদিও প্রয়োজনীয় অনুদান এবং চূড়ান্ত সইসাবুদের কাজ লাল ফিতের ফাঁসে বন্দী। যদিও আশার কথা এখন চালু সাতটি বিভাগের কোনটিরই আসন ফাঁকা পড়ে থাকে না। পরিশেষে ২০০৩ সালে শিবপুর পলিটেকনিক নামবদল করে শিবপুর আইটিআই নামে পরিচিত।

 

তথ্যসুত্রঃ বি ই কলেজর শতবর্ষ পূর্তি পত্রিকা এবং বর্তমান আইটিআই প্রিন্সিপ্যাল ও অন্যান্য প্রশিক্ষকবৃন্দ।

 

পুনঃ গত সপ্তাহে তথ্য সংগ্রহে আইটিআই গিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম। কিন্তু আইটিআই-এর দৈনদশা দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। আমাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেবার পরে এক প্রশিক্ষক জানতে চান এগুলো আমি শুধু জানতে এসেছি না কোথাও লিখবো। লিখবো বলতে খুব উৎসাহিত হয়ে করুণসুরে ওনারা বললেনঃ দেখুন ডঃ বিমল সেনের পরেও ডঃ স্পর্শমণি চ্যাটার্জি ও বর্তমান উপাধ্যাক্ষ ডঃ অজয় রায়ের সহযোগিতা এবং আন্তরিকতা থাকলেও পয়সার বড়ই অভাব। দেখুন আমাদের টয়লেট বা ক্লাসরুমের অবস্থা। আপনারা, প্রাক্তন ছাত্ররা তো কলেজের অনেক কিছুর উন্নতি সাধনের অনেক কিছু উদ্যোগ নেন। দেখুন না যদি আমাদের জন্যে কিছু করা যায়। যদি প্রতিশ্রুত সরকারী অনুদান একটু তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। চেষ্টা করবো বলা ছাড়া আমার কাছে কোন উত্তর ছিল না।